শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

সেচ মওসুমে ভারতে ডিজেল পাচারের আশংকা

কামাল উদ্দিন সুমন : আসন্ন বোরো মওসুমে উত্তারাঞ্চলে জেলাগুলো দিয়ে ডিজেল পাচারের আশংকা করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এজন্য সীমান্তবর্তী জেলার পেট্রোলপাম্পগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিজিবিকে এ ব্যপারে সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায় বোরো মৌসুমে (জানুয়ারি-মে) জ্বালানি তেল ডিজেলের চাহিদা বেড়ে যায়। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ডিজেলের সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। পার্শ্ববর্তী ভারতে দাম বেশি থাকায় এ সময় ডিজেল পাচারের আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের এক পরিচালক জানান, অন্য মৌসুমের তুলনায় সেচ মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে ডিজেলের চাহিদা তিন থেকে চার লাখ টন বেড়ে যায়। তিনি জানান, দেশের প্রায় ১২ লাখ সেচ পাম্পের ৮০ শতাংশ ডিজেলচালিত। এ সময় উত্তরের জেলাগুলোতে প্রায় দশ লাখ টন ডিজেল সরবরাহ করতে হয়।
তিনি বলেন, ভারতে ডিজেলের দাম বেশি। কলকাতার মার্কেট অনুসারে বর্তমানে দেশটিতে ডিজেলের দাম ৬১ রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৭৩ টাকা ১৭ পয়সা। আর বাংলাদেশে এক লিটার ডিজেলের মূল্য ৬৫ টাকা। ফলে সীমান্ত দিয়ে তেল পাচারের একটা শঙ্কা থেকেই যায়।
তিনি জানান, স্থানীয় পাচারকারী ছাড়াও স্থলবন্দর দিয়ে যে ট্রাকগুলো উভয় দেশে পণ্য আনা-নেওয়া করে সেগুলোর মাধ্যমেও তেল পাচারের সুযোগ রয়েছে। এ জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-বিজিবিকে সতর্ক করা হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী পেট্রোলপাম্পগুলোকেও বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, এবার বোরো মৌসুমে সেচযন্ত্র চালাতে ১৫ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন ডিজেলের প্রয়োজন হবে। আগামী বছরের মে মাস পর্যন্ত সেচ কাজের জন্য এই তেলের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এই জ্বালানি তেল সরবরবাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সেচের সুযোগ নিয়ে কেউ যাতে অতিরিক্ত তেল মজুদ করতে না পারে সেজন্য বিপিসির তদারকি দল কাজ করবে।
সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগে সেচ মৌসুমে জ্বালানি তেলের চাহিদা বিষয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ নির্দেশ দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অন্যদের মধ্যে জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান খালিদ মাহমুদসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে যেসব গভীর নলকূপ আছে, তার ৮০ ভাগ চালানো হয় ডিজেল দিয়ে আর বাকি ১০ ভাগ বিদ্যুৎ দিয়ে চলে। সেচের সময় ডিজেলচালিত গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, এলএলপি (লো লিফট পাম্প), পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর ব্যবহার করা হয়। সেচ মৌসুমে এ ধরনের ১৬ লাখ ৪৭ হাজার যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে দুই হাজার ৩২১টি গভীর নলকূপ আর অগভীর নলকূপ হচ্ছে ১১ লাখ ১২ হাজার ৯১টি।
বৈঠকে তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, সেচ মৌসুমে তেল সরবরাহের জন্য পর্যাপ্ত মজুদ রাখতে হবে। ডিজেলের যাতে কোনও সংকট না হয়। নির্দিষ্ট সময়ে নিরবচ্ছিন্ন তেল পরিবহন করা জরুরি।
বৈঠকে সেচ মৌসুমে দেশের সব স্থানে সঠিক সময়ে ও নির্ধারিত মূল্যে ডিজেল সরবরাহ অব্যাহত রাখতে বিপিসি, পিডিবি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা ও পরামর্শ দেয়া হয়। এজন্য প্রতি মাসে চট্টগ্রামে তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর প্রধান স্থাপনাগারে এবং ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ডিজেল মজুদ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি সেচ মৌসুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ দুই মজুদাগারে সার্বক্ষণিকভাবে তেল সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে, উত্তরাঞ্চলের প্রধান তেল স্থাপনা বাঘাবাড়ী ডিপোর তিনটি তেল বিপণন কোম্পানির স্টোরেজ ট্যাংকে ডিজেলের পর্যাপ্ত মজুদ রাখতে হবে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সেচ মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে ডিজেলের চাহিদা ২ থেকে ৩ গুণ বৃদ্ধি পায়। গ্রীষ্ম ও বর্ষায় দেশের ডিপোগুলো থেকে প্রতিদিন ৬ থেকে ৭ হাজার টন ডিজেল বিক্রি হয়। সেচ মৌসুমে দৈনিক বিক্রির পরিমাণ ১৪ হাজার টনও ছাড়িয়ে যায়। সঠিক সময়ে ও নির্ধারিত মূল্যে কৃষকের কাছে জ্বালানি তেল পৌঁছানোর জন্য চলতি মাসের শেষে বিপিসির চট্টগ্রামের প্রধান কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয় বৈঠকে। এছাড়া, দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্রুত জ্বালানি পৌঁছে দিতে নৌপথে ডিজেল পরিবহন ও খালাসে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বোরো মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে তেল সরবরাহ করা হয় নৌ ও রেলপথে। এজন্য রেলের বাড়তি ওয়াগন প্রস্তুত রাখাও নির্দেশ দেয়া হয়।
এদিকে আগামী মাস থেকে শুরু হচ্ছে বোরো মৌসুম। সেচের কারণে এ সময় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। এবারের সেচ মৌসুমে সাড়ে দশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশ আসবে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। গত মৌসুমে যা ছিল ৩৫ শতাংশ। গ্যাসের ঘাটতির কারণেই তেলের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি। জানুয়ারি মাস থেকে এপ্রিল-মে পর্যন্ত বোরো মৌসুম হিসাব করা হয়।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটি এবার বোরো মৌসুমের জন্য সব মিলিয়ে সাড়ে দশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও মার্চ-এপ্রিলে গরম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়বে। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর মতে, এবার গরমে দেশের বিদ্যুতের চাহিদা ১৩ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছতে পারে। এ পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে গত ১৮ অক্টোবর নয় হাজার ৫০৭ মেগাওয়াট।
পিডিবি চেয়ারম্যান খালিদ মাহমুদ বলেন, তাদের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চালাতে প্রায় ১৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু তারা সর্বোচ্চ ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পান। এ জন্য এবার তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে।
তিনি জানান, এবার বোরো মৌসুমের জন্য প্রায় পাঁচ হাজার ৯০০ মেগাওয়াটের তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। গত বছর সেচ মৌসুমে তেলচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে তিন হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ