ছাত্রসমাজের কাছে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা
আখতার হোসেন আজাদ : ছাত্ররা একটি দেশের ভবিষ্যৎ। ছাত্রসমাজের কাছে দেশ ও জাতি চেয়ে থাকে। ছাত্রদের জাগরণে যেমন একটি সমাজ, জাতি ও দেশ জেগে উঠে ঠিক তেমনই ছাত্রসমাজের মাঝে ঘুণ ধরলে তার প্রভাব পুরো জাতির ওপরেই পড়ে।
ছাত্রজীবন : সাধারণ অর্থে যে শিক্ষাগ্রহণ করে তাকেই ছাত্র বা ছাত্রী বলা হয়। সেই দিক দিয়ে পৃথিবীর সব মানুষই ছাত্র-ছাত্রী। কারণ মানুষ মৃত্যু পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করতেই থাকে। তবে, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের সময়কে মূলত ছাত্রজীবন হিসেবে গণ্য করা হয়। ছাত্রজীবন মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়টিই তার ভবিষ্যৎ গড়ে দিয়ে থাকে। আজ যারা ছাত্র, তারা আগামী দিনে দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দেবে। তাই M.K Gandhi বলেছিলেন, “The students are the Future leaders of the country who could fullill country’s hopes being capable.”
সুশিক্ষার গুরুত্ব : ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, Education is the backbone of a nation. অর্থাৎ শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নয়ন করতে পারে না। যে জাতি যত বেশী শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। তবে, শিক্ষার সাথে যদি আদর্শিক শিক্ষার সংমিশ্রণ না ঘটে তাহলে ঐ শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করতে পারেনা। একজন অন্ধকে তার হাতে মশাল দিয়ে যদি বলা হয় তুমি লোকদের পথ দেখিয়ে এসো। চোখ না থাকার দরুণ সে যতটুকু না লোকদের পথ দেখাবে তার চেয়ে ঘর বাড়ি আগুনর লাগাবে অনেক বেশি। ঠিক তদ্রুপ একজন ছাত্রকে যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত না করা হয় তাহলে সে দেশের নেতৃত্ব হাতে নিয়ে দেশকে সামনের দিকে যতটুকু না এগিয়ে নিয়ে যাবে তার চেয়ে দেশ ও জাতিকে বিপথে পরিচালিত করবে।
ছাত্রজীবনের প্রধান দায়িত্ব : “ছাত্র নং অধ্যয়নং তপঃ” এটিই ছাত্রজীবনের মূলমন্ত্র। সংস্কৃত এই কথাটির অর্থ হলো-অধ্যয়নই ছাত্রজীবনের একমাত্র তপস্যা। মহান আল্লাহ্তায়ালা মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কুরআনের প্রথম শব্দটি নাযিল করেছেন “ইকরা” যার অর্থ পড়। ছাত্রজীবনে পড়ালেখার কোন বিকল্প নেই। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ইসলামিক বইপত্র, বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়ার চর্চা করতে হবে। তাহলে জ্ঞানের পূর্ণতা লাভ এবং মেধার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ হবে।
অন্যান্য দায়িত্বগুলো হলো
গুরুজনকে শ্রদ্ধা করা: মা-বাবা, শিক্ষক-শিক্ষিকা আমাদের গুরুজন। তাদের সাথে আমাদের সর্বদা সর্বোত্তম আচরণ করতে হবে। হাদীসে আছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত এবং পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ্র অসন্তুষ্টি। তাই, মাতাপিতার মনে কখনো কষ্ট দেওয়া যাবে না।
পিতামাতার পরেই শিক্ষকের স্থান। একজন শিক্ষকের কথা পালন করলে ভালো গুণের ছাত্র হওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, None but those who have the sprit of forbearance are fit to be teacher. তাই শিক্ষককে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন করতে হবে।
সামাজিক ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য : ছাত্রসমাজ হলো একটি দেশের সচেতন নাগরিক। ছাত্রদের মূল লক্ষ্য পড়ালেখা হলেও এর পাশাপাশি সমাজের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা উচিত। নিরক্ষরদের মাঝে অক্ষরজ্ঞান প্রদান, তাদেরকে জনসংখ্যাবৃদ্ধির কুফল ও তা রোধে করণীয়, স্বাস্থ্যসচেতনতা সম্পর্কে তাদের সাথে আলোচনা করে তাদেরকে সচেতন করতে হবে। শিক্ষিত যুবকেরা যদি কৃষি কাজ, মৎস্য চাষ, পশুপালন, নার্সারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগায় তাহলে তা একদিকে যেমন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে তেমনি সেটি দেশের বেকারত্বও হ্রাস করবে। ঝড়-বন্যা কিংবা দুর্যোগকালে সেবা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
ছাত্রসমাজ বরাবরই অন্যায়-অনাচার, দুর্নীতি, অবিচার, অত্যাচার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। আদর্শগতভাবেই একজন ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। রাজনীতির বিষবৃক্ষ মুলোৎপাটন করা ছাত্রসমাজের অন্যতম একটি দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতির একসময় সুনাম ছিল। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশ স্বধীনের পর স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ও নেতৃত্ব ছাত্ররাজনীতিকে এক অনন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানে এই ছাত্ররাজনীতি কেমন যেন একটু কলুষিত হয়ে পড়েছে। বর্তমান ছাত্ররা রাজনীতির প্রকৃত আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে ক্যাম্পাসে অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাসবাজি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন দুষ্কৃতিমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে যেয়ে নিজের প্রখর মেধাকে নষ্ট করার পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতিকে কলঙ্কিত করছে। যখন কোন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী চাদাবাজি করতে গিয়ে ধরা পড়ে বা সহপাঠীকে ধর্ষণচেষ্টাকালে গণঢোলাই খেয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে, তখন তা কেবল ঐ ছাত্রসংগঠনের জন্য দুর্নাম বয়ে আনেনা বরং তা পুরো ছাত্ররাজনীতির জন্য লজ্জাকর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান ছাত্রসমাজের কাছে ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তন করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
নিয়মানুবর্তিতা : “Work while you work, play while you play. And that is the way to be happy.” ছাত্রজীবনে এই নীতি অনুসরণ করে চললে অবশ্যই সাফল্যের শিখরে আরোহণ করা সম্ভব হবে। একদিনের কাজ পরের দিনের জন্য কখনোই রেখে দিলে চলবেনা। নিয়মিত পড়ালিখা করা, সময়মত ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠা, স্কুলে যাওয়াসহ সব কিছুই নিয়ম মেনে করতে হবে। ছাত্রজীবন থেকে এই নিয়মানুবর্তিতার মাঝে বেড়ে উঠলে কর্মজীবনে এর প্রভাব পড়বে।
বিনয় ও শিষ্টাচার অর্জন: নৈতিক মূল্যবোধ একজন ছাত্রকে সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী করে তোলে। সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে সে সমাজই সভ্য সমাজ। কথাবার্তায়, চলাফেরায়, পোশাক-পরিচ্ছদে বিনয়ী হতে হবে। শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ একজন ছাত্রকে ন¤্র ও ভদ্র করে তোলে। যারা এইগুলো অর্জন করতে পারবে, ভবিষ্যতে তারাই জাতির সুষ্ঠু নেতৃত্ব দিতে পারবে।
আদর্শ ছাত্রছাত্রীর বিশেষ সতর্কতা : একজন আদর্শ ছাত্রছাত্রী হবার জন্য সবসময় নিজেকে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, গীবত, মিথ্যাবলা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। বন্ধু নির্বাচনে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা একটি প্রবাদ আছে, সৎ সঙ্গে সর্গবাস এবং অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।
স্বাস্থ্য সচেতনতা : স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। শরীর যদি সুস্থ্য না থাকে তাহলে কোন কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়না। পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়া যায় না। শরীরকে সুস্থ্য রাখার জন্য নিচের অভ্যাসগুলো আয়ত্ত করতে হবে।
* প্রতিদিন ৬ ঘন্টা ঘুমাতে হবে।
* সব ধরনের ফাস্টফুড ও তৈলাক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
* সকালের খাদ্য তালিকায় ফল রাখতে হবে।
* শাকসবজি, ছোটমাছ খেতে হবে। সপ্তাহে দুইদিনের বেশী মাংস না খাওয়াটাই ভালো।
* অকারণে ঔষধ সেবন করা উচিত নয়।
* সকল প্রকার নেশার দ্রব্য থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। এগুলো শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি করে।
শেষকথা : দেশের স্বাধীনতা, সার্বোভৌমত্ব অটুট রাখতে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ছাত্রজীবন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে। নিজেকে একজন সৎ, আদর্শ ও নেতৃত্বযোগ্য দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্ট করতে হবে। জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হবে চিন্তা, কর্ম, মন এবং দেহে।
মনে রাখতে হবে কাজী নজরুল ইসলামের সেই মর্মবাণী-
“মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞাণের মশাল বাক
কন্ঠে মোদের কুন্ঠাবিহীন নিত্যকালের ডাক।
মোদের চোখে বিশ্ববাসীর স্বপ্ন হোক সফল
আমরা ছাত্রদল।”
লেখক : শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।