বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ইতিহাসকে এভাবে অবহেলা করা যায় না

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারো হুমকিদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও সাফল্য লাভে ব্যর্থ হয়েছে। ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে জেরুসালেম প্রশ্নে ভোট গ্রহণের আগে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্যদের হুমকি দিয়ে বলেছিল যে, কে কীভাবে ভোট দেয় তার হিসাব রাখা হবে। তারা বলেছিল, জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতির সমালোচনা করে যে প্রস্তাব সাধারণ পরিষদে উঠছে, কেউ যদি সে প্রস্তাব সমর্থন করে ভোট দেয়, তাহলে তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হেইলি বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে সুনির্দিষ্টভাবে আরো জানান, এই ভোটের হিসাব প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিয়ে ছাড়বেন।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, মার্র্কিন প্রেসিডেন্টের এই হুমকির পরও বিশ্ব সংস্থার ১২৮টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ক্ষুদ্র ও দরিদ্র মাত্র সাতটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করেছে। এই ভোটের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক পরাজয়। ইসরাইলি দৈনিক হারেৎস লিখেছে, এই ভোট ইসরাইলের জন্য ‘হালকা তিরস্কার’ কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য ‘রীতিমতো এক থাপ্পড়’। নিউইয়র্ক টাইমস মন্তব্য করেছে, এই ভোট ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি জাতিসংঘের (সদস্য রাষ্ট্রসমূহের) সম্মিলিত ‘প্রকাশ্য প্রত্যাখ্যান’। এদিকে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দানকারী দেশগুলোর মনোভাবকে তুলে ধরে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভাসোগলু বলেন, ‘আমাদের ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না, যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী হতে পারে, কিন্তু তাতে ভুল কাজকে ঠিক প্রমাণ করা যাবে না।’ প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যেসব দেশের রাষ্ট্রদূতদের উদ্দেশে নিকি হেইলি হুমকিবার্তা পাঠিয়েছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তবে সে চিঠি উপেক্ষা করে বাংলাদেশ শুধু যে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে তাই নয়, অধিকাংশ ইসলামিক কনফারেন্সভুক্ত দেশের মতো বাংলাদেশও এই প্রস্তাবের অন্যতম উত্থাপক বা কো-স্পন্সর ছিল।
জাতিসংঘের জরুরি বৈঠকে জেরুসালেম প্রশ্নে ভোটযুদ্ধে সত্য, ন্যায় ও ইতিহাসের জয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের সংগঠন ‘হামাস’। বৃহস্পতিবারের ভোটের পর হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া এই মন্তব্য করেছেন। হামাস প্রধান আরো বলেন, জাতিসংঘের এই ভোটে জনগণের আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও রাজনৈতিক ভীতি প্রদর্শন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এখন দেখার বিষয় হলো, ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ব জনমতকে কতটা গুরুত্ব দেয়। তবে এখানে বলার মতো বিষয় হলো, জনমতকে উপেক্ষা করে দাম্ভিক শাসকরা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। আর ‘সত্যের জয়’ বলেও তো একটা কথা আছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভ্রান্তনীতি বর্তমান সময়ে বিশ্বে সংকটের মাত্রা বাড়াচ্ছে, উত্তেজনায় আরো ইন্ধন দিচ্ছে। এমন কর্মকা-ের কারণে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে তা নয়, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও দেশটির সংকট বাড়ছে। হুমকি-ধমকি ও ভীতির রাজনীতি মানবিক মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ঘরে-বাইরে কোথাও এমন রাজনীতি টেকসই হতে পারে না। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিষয়টি বুঝতে পারছেন বলে তো মনে হয় না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিতর্কিত জেরুসালেম নীতি ঘোষণার জেরে ফিলিস্তিনীদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ইসরাইলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যকে ‘বর্ণবাদী’ বলে উল্লেখ করেছে ফিলিস্তিনী মুক্তি আন্দোলনের সংগঠন হামাস। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদুলো ও জেরুসালেম পোস্ট এ খবর জানিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রেইডম্যান ফিলিস্তিনীদের প্রতিক্রিয়াকে ‘কুৎসিত, অবাঞ্ছিত, উত্তেজক ও সেমিটিক বিরোধী’ বলে মন্তব্য করেন। শনিবার এক বিবৃতিতে হামাসের মুখপাত্র ফোউজি বারাহাউস বলেন, ‘ফিলিস্তিনীদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ফ্রেইডম্যানের বিবরণে বর্ণবাদ, ইতিহাসকে অবহেলা, ফিলিস্তিনীদের অধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবজ্ঞাই প্রতিফলিত হয়েছে। এই নীতিতে আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে সব ধরনের অপরাধ ও নিষেধাজ্ঞায় তারা (মার্কিনীরা) দখলদারিত্বের অংশীদার।’ ফ্রেইডম্যানের বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে ফিলিস্তিনের সম্পর্ক ছিন্ন করা ও অসলো চুক্তি বাতিলের বৈধতা দিয়েছে বলেও হামাসের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তিনী স্বাধীনতা সংস্থা ও ইসরাইলের মধ্যে অসলো শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। ওই চুক্তিতে পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনীদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়। চুক্তিতে ফিলিস্তিনীদের সশস্ত্র প্রতিরোধ থেকে বিরত থেকে ইসরাইলের সঙ্গে নিরাপত্তা সহায়তা বাড়ানোর কথা বলা হয়। প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মূলে রয়েছে জেরুসালেম। ফিলিস্তিনীরা পূর্ব জেরুসালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করে। আর গত ৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নতুন এক সংকটের জন্ম দেয়।
পৃথিবীবাসী ট্রাম্পের এই স্বীকৃতিকে সমর্থন করেনি। চীনসহ পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্র পূর্ব জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনীদের রাজধানী হিসেবে সমর্থন জানিয়েছে। এমন অবস্থায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত বর্ণবাদী মন্তব্য করে সংকটের মাত্রা বাড়ালো। এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাজ কি সংকটের মাত্রা বাড়িয়ে যাওয়া।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ