শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

নজরুল ছাড়াই বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের উৎসব শেষ হলো

শফি চাকলাদার : হয়ে গেল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব ২০১৭। মূলত নানান শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এক বিশাল আয়োজন। উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ সঙ্গীত আয়োজন। এক কথায় বিশাল আয়োজন। ডিসেম্বর ২০১৭ এর ২৬-৩০ পর্যন্ত মোট ৫ দিনের এই অনুষ্ঠানে বিবিধ সঙ্গীত সুর, যন্ত্রসঙ্গীত, নৃত্য মিলিয়ে সঙ্গীতের এক বিশাল আয়োজন। আয়োজকদের ধন্যবাদ যে এমন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন তারা সফলতার সাথে পরিসমাপ্ত করতে পেরেছেন। উচ্চাঙ্গ বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সাধারণত সাধারণ মানুষরা ততোটা বোঝে না। অধিকাংশ উপস্থিত দর্শক এই উচ্চাঙ্গ বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত যতটা শ্রুতিতে বুঝতে পেরেছেন তার চেয়ে বেশি তারা এত বড় পরিসরের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন এটাই বড় কথা। প্রথম সারিতে যারা উপস্থিত হয়ে থাকেন হোমড়া-চোমড়া সরকারি বা সংস্কৃতির তারাও তাদের উপস্থিতিকেই প্রাধান্য হিসেবে গণ্য করেন। তবুও শ্রুতিকে এই উচ্চাঙ্গ বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপযোগী করে তোলার জন্য এমন আয়োজনে উপস্থিত থাকাটাও কম নয়! যে কোন ধরনের অনুষ্ঠান যা বৃহৎ পরিসরে করা হয়ে থাকে সেখানে কিছু ভাববারও তাগিদ থাকে। যেমন: বাঙালি সংস্কৃতি এখানে নাম একটি হলেও এখানে ভিন্নতা স্পষ্ট লক্ষণীয়। যেমন: ইসলামী সংস্কৃতি, হিন্দু সংস্কৃতি, খৃস্টান সংস্কৃতি, বৌদ্ধ সংস্কৃতিসহ নানান উপজাতি সংস্কৃতি ঐ একটি সংস্কৃতিই বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রকাশ পায়। আয়োজকদের এসবের প্রতি সম্মানে ঘাটতি দেখা দিলে সেটাও গ্রহণীয় হয় কি?
বাংলা সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সময়কাল ধরা যাবে ১৯৩২ থেকে। অর্থাৎ আজ থেকে ৮৫ (পঁচাশি) বছর পূর্বে বাংলা ভাষায় এই উচ্চাঙ্গ বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গীত হয়ে আসছে এবং এই শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রচলন, প্রবর্তন করেন এই উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীত ¯্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম। সামান্য তথ্য এখানে উদাহরণস্বরূপ ব্যবহার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। নজরুলের ‘শিউলিমালা’ গল্পতে নজরুল বলেন, চরিত্র সংলাপে- ‘প্রফেসর চৌধুরী খুশি হয়ে বলে উঠলেন, ‘আহা হা হা! বলতে হয় আগে থেকে। তাহলে যে গানটাই আগে শুনতাম তোমার। আর গান হিন্দু ভাষায় না হলে জমেই না ছাই! ও ভাষাটাই যেন গানের ভাষা। দেখ, ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ভাষা বাংলা হতেই পারে না। কীর্তন, বাউল আর রামপ্রসাদী ছাড়া এ ভাষায় অন্য ঢংয়ের গান চলে না।’ আমি বললাম, ‘আমি যদিও বাংলা গান জানিনে, তবুও বাংলা ভাষা সম্বন্ধে এতটা নিরাশাও পোষণ করি না।’
এই যে প্রতিবাদ নজরুলের সেটা ছিল শ্রাবণ ১৩৩৭ (১৯৩১)। এরপরই নজরুল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের খ্যয়াল, ঠুমরি, ধ্রুপদী সঙ্গীত রচনা শুরু করেন অর্থাৎ বাংলা ভাষায় এ সকল গানের প্রবর্তন, প্রচলন করেন। এ এক মহা সংযোজন। কত কত সঙ্গীতই এলো-গেল কিন্তু নজরুলের দ্বারাই তা সম্ভব হলো। এতো গর্বের বিষয়, অহঙ্কারের বিষয় নয় কি? বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে নজরুলই উচ্চারন হলো না। সঙ্গীতের প্রচলিত ধারার সাথে নতুন নতুন কত কত যে প্রবর্তন-সংযোজন নজরুল করে গেলেন প্রায় ৮০/৮৫ রকমের সঙ্গীত, অথচ তার নামই সঙ্গীত আয়োজকরা উচ্চারণ করতে ইচ্ছেকৃতভাবে ভুলে গেলেন? অধিকন্তু নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তার অসামান্য অবদানগুলো বিশ্ব মাঝে তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের কর্তব্য। এমন একটি বিশাল আয়োজনে ‘নজরুল’কে উপস্থাপন করা হলে কবির অবদানসমূহ শিল্পীদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ত। নজরুলকে নিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গন সকল সময়ে দ্বিধাগ্রস্ত। অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে যাদের দেখা গেল সেখানে সংস্কৃতি মন্ত্রী, সহ বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীদের কাউকে কাউকে দেখা গেল। অর্থমন্ত্রীকেও উপস্থিত দেখলাম। মাঝে মধ্যে এদের মধ্যে কাউকে কাউকে বক্তৃতাও করতে দেখা গেল। কিন্তু ‘নজরুল’ বিষয়টিই বলতে ভুলে থাকলেন। এই নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি। আমি তো ভেবেছিলাম উপস্থিত ভদ্র সন্তানদের মধ্যে কারো মুখ থেকে শুনব ‘নজরুল-সঙ্গীত’ নেই কেন? হয়তো বা এরা জানেনই না নজরুল বাংলা সঙ্গীতে উচ্চাঙ্গ-শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জন্মদাতা। নজরুলই এমন অসাধারণকে সম্ভব করেছেন। সংস্কৃতি-অনুষ্ঠানে যোগ দিলেই যে সংস্কৃতি-মনা হবেন এতো বাজে কথা। পদাধিকার বলে কিম্বা স্পন্সর কারণে অনেকেই দাওয়াত পান?শুধু উপস্থিতরা নন বাংলাদেশের এত এত চ্যানেল, পত্রিকা-সাংবাদিক-উপস্থাপনকারীদের কারো মনেই কি ‘নজরুল’ নিয়ে বলতে বা পেপারে সামান্য লিখতে পারলেন না-সংস্কৃতির প্রাণ-পুরুষ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাংলাভার্সনের প্রবর্তক কাজী নজরুল ইসলামকে কেন সূচীক্রমে নেই। তারা হয়তো নজরুল সঙ্গীত শুনে থাকবে কিন্তু নজরুল যে শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রবর্তক তাই জানে না। অবশ্যই জানেনা আর এই ‘জানে না’তেই তারা গর্ব-অনুভব করে। অর্থাৎ ‘জাতীয় কবি’র অবদানসমূহ এখনো এদের কাছে অজানাই রয়ে গেল। আর এরাই সংস্কৃতি-অঙ্গনটাতে দায়িত্ব পালন করছে।
অনুষ্ঠানে একটি নৃত্যের স্বার্থে ব্যাকগ্রাউন্ডে রবীন্দ্রনাথের ‘হে নটরাজ নৃত্যের তালে তালে’ শোনা গেল। এই নটরাজ বিষয়তেও নজরুলের ‘সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ’ অনেক অনেক উন্নত-উচ্চাঙ্গ ছোঁয়াও রয়েছে। আমারতো মনে হয় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক অঙ্গনটার দখলকারী অংশটা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কিছুই চেনে না। আর রবীন্দ্রনাথের শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নেই বলে ‘নজরুল’কেও সেখানে নেই’ দলে রেখে দিয়েছে। এই হীনমন্যতা হিংসা-বিদ্বেষ-এর কবলে ‘নজরুল’ আজ বন্দী। ভাবটার মানসিকতা এই যে রবীন্দ্রনাথই যখন উচ্চাঙ্গ-শাস্ত্রীয়তে কিছু করতে পারেনি নজরুল পারবেন কি করে? কথাটা অদ্ভুত লাগতে পারে কিন্তু কথাটা ফেলে দেয়ার মতো নয়। তাদের কার্যক্রম তো এটাই বলে। নজরুলের কিছু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের (অর্থাৎ খ্যয়াল ঠুমরি) কটা গানের উল্লেখ করছি- বিশাল সঙ্গীত ভান্ডার থেকে-
১। মেঘ-বিহীন খর-বৈশাখে (সামন্ত সারং-ত্রিতাল), ২। তৃষিত আকাশ কাঁপেরে )বৃন্দাবনী সারং-ত্রিতাল), ৩। কে দুরন্ত বাজাও (হিন্দোল মিশ্র তেওড়া), ৪। নিরন্ধ্র মেঘে মেঘে অন্ধ গগন (মল্লার-কাওয়ালী), ৫। ধূলি পিঙ্গল জটাজুট মেলে (শুদ্ধ সারং-ত্রিতাল), ৬। এ ঘোর শ্রাবণ নিশি (কাজরী কাটা), ৭। গানে খেলায় সাপ (মেঘ), ৮। নয়নে ঘনাও মেঘ (মালবশ্রী কাহাররা), ৯। নিশিভোরে রিমঝিমঝিম (প্রতাপ-বরালী-দক্ষিণ ভারতীয় মিশ্র দেশ-খাম্বাজ-ত্রিতাল-আদ্ধা কাওয়ালী), ১০। পিয়া পিয়া পিয়া পাপিয়া ফুকারে (দেশ মিশ্র-কাহারবা), ১১। ফিরিয়া এস এস হে ফিরে (মিশ্র দেশ-ত্রিশাল), ১২। মেঘের ডমরু ঘন বাজে (মিশ্র-কেদারা কামোদ-ত্রিতাল), ১৩। অম্বরে মেঘে মৃদঙ্গ বাজে (মিশ্র তেওড়া), ১৪। গগনে সঘনে চমকিছে দামিনী (মেঘ ত্রিতাল), ১৫। ঘোর ঘনঘটা ছাইল গগন (হারি ঠেকা), ১৬। ঘন ঘোর বরিষণে মেঘ ডমরু বাজে (বৃন্দাবনী সারং ত্রিতাল), ১৭। ঘন দেয়া গরজায় গো (মিশ্র মল্লার-ত্রিতাল), ১৮। দখিন সমীরণ সাথে বাজো (মধু মাধবী সারং-কার্ফা), ১৯। পরদেশী মেঘ যাওয়ার ফিরে (দক্ষিণী রাগ-আদ্ধা ত্রিতাল সিংহেন্দ্র মধ্যমা দক্ষিণ ভারতীয় রাগ), ২০। বরষা ঐ এল বরষা (মেঘ-মল্লার-ত্রিতালী), ২১। মেঘ মেদুর বরষায় (জয়জয়ন্তী-ত্রিতাল), ২২। গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু (ধামার-মালকোষ গীতাঙ্গী পাখোয়াজ), ২৩। ঘেরিয়া গগন মেঘ আসে (মেঘ-ত্রিতাল), ২৪। অরুণ রাস্তা গোলাপ কলি (দাদরা-গজল), ২৫। আজি মিলন বাসর প্রিয়া (ত্রিতাল), অসংখ্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত রচেছেন নজরুল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ‘জিরো’ কাল থেকে ‘হিরো’ কালে উল্লীত করেছেন প্রবর্তনের সাথে সাথে। এবারের অনুষ্ঠানে পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীও কিছুদিন আগে বলেছিলেন এই অঞ্চলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রসার, প্রবর্তন উন্নয়ন একমাত্র নজরুল করেছেন, আর কেউ নয়। অথচ শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানে নজরুল নামই উচ্চারণ হল না- এ কেমন কথা?
নজরুল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছেন গভীর স্থানের সঙ্গীত মূর্ছনায়। রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে দেন। প্রায় সতরটি রাগ তিনি সৃষ্টি করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে হিমাদ্রীসম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এখানে নজরুল-সৃষ্ট রাগগুলো উদ্ধৃত করছি-
১। দোলন-চাঁপা- দোলন-চাঁপা বনে দোলে- ত্রি-তাল।
২। দেবযানী- দেবযানীর মনে প্রথম প্রীতির-নবনন্দন তাল।
৩। মীনাক্ষ্মী- চপল আঁখির ভাষায়, হে- ত্রি-তাল
৪। অরুণ-রঞ্জনী- হাসে আকাশে শুক তারা হাসে- ঐ।
৫। নির্ঝরিনী- রুমঝুমঝুম রুমঝুমু কে বাজায়- ঐ।
৬। রূপ-মঞ্জরী- পায়েলা বোলে রিনিঝিন- ঐ।
৭। সন্ধ্যা-মালতী- শোন ও সন্ধ্যামালতী বারিকা তপতী- সেতারখানি।
৮। বন-কুন্ডল- বন কুন্ডল এলায়ে- ত্রি তাল।
৯। অরুণ-ভৈরব- জাগো অরুণ-ভৈরব, জাগো হে- মাদ্রা।
১০। শিবানী-ভৈরব- ভগবান শিব শিবানী ভৈরব- ত্রি-তাল।
১১। রুদ্র-ভৈরব- এস শঙ্কর ক্রোধাগ্নি হে প্রলয়ঙ্কর--সুরফাঁক তাল।
১২। যোগিনী- কেন গো যোগিনী বিধুর অভিমানে- ত্রি-তাল।
১৩। আশা-ভৈরব-মৃত্যু নাই, নাই দুখ -ঐ
১৪। উদাসী-ভৈরব- সতীহারা উদাসী ভৈরব কাঁদে - ঐ।
১৫। আহীর-ভৈরব- অরুণ কান্তি কেগো যোগী - ঐ।
১৬। বেণুকা- বেণুকা কে বাজায় মহুয়া বনে- ঐ।
১৭। নীলাম্বরী- নীলাম্বরী শাড়ী পরি’ নীল যমুনায় - ঐ।
এছাড়াও পনরটি ‘তাল’ও সৃষ্টি করেছেন নজরুল। নজরুল শুধু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে যে অবদান রেখে গেছেন তার বিস্তারে আলোচনা-সঙ্গীত দিয়ে বেঙ্গল অন্তত এককভাবে পনর দিন অনুষ্ঠান করতে পারবে। তাই বলছি উপস্থিত বিদগ্ধরা কেউ কি বলতে পারলেন না এ দেশীয় সঙ্গীতের যিনি অতুলনীয়তায় মার্গে পৌঁছে দিয়েছেন তার সঙ্গীত ব্যতীত সঙ্গীত অনুষ্ঠান হয় কি করে? পরবর্তীতে আশা করব এমন অনুষ্ঠানের অন্তত একটি দিন শুধু ‘নজরুল’ এর জন্য নির্ধারিত থাকে। নজরুল-প্রচারে এমন সুযোগকে কাজে লাগাতে-এটা নজরুল-নামের প্রতিষ্ঠানগুলো কি এ বিষয়ে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আলোচনা-বৈঠক করেছেন? আমার তো মনে হয় ‘না’ সূচক কথাই আসবে তাদের থেকে। আরো আশ্চর্য সংস্কৃতি মন্ত্রীর উপস্থিতিতে নজরুলকে বাদ দিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে- এখানে কি তার কোন ভূমিকা থাকার কথা নয়?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ