বইপত্র
ছদ্মবেশী শয়তান
লেখক: আশরাফ পিন্টু
প্রকাশনী: অন্যধারা, ঢাকা
জাদুকর তার রহস্যময় হ্যাট থেকে শেষ মুহূর্তে বিস্ময়ের অবসান না ঘটালেও একজন রহস্য-ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসের শেষ পাতায় রহস্যের উন্মোচন ঘটিয়ে থাকেন। পাঠকের সংশয়-সন্দেহের তীর বিভিন্ন চরিত্রকে তাক করতে থাকলেও লেখক সহজে রহস্য উন্মোচন না করে পাঠককে নিয়ে আগাতে থাকেন। একেবারে কাহিনীর শেষ ধাপে এসে লেখক সুনিপুণভাবে তুলির আঁচড় দিয়ে রহস্য উন্মোচন করে উপন্যাসের ইতি টানেন। আর এটাই হলো রহস্য উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য।
সমাজের নানা অনিয়ম, দুর্গতি ও ভ- মানুষদের মুখোশ উন্মোচন একজন সচেতন লেখকের লেখনিতে ধরা পড়বেÑএটাই স্বাভাবিক। এটা তাঁদের নৈতিক দায়িত্বও বটে। বিভিন্ন সময়ে কবি-সাহিত্যিকরা এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। প্রতিবাদ বা লেখনির ভাষাও একেক জনের একেক রকম। কাজী নজরুল ইসলাম কবিতার জ্বালাময়ী ভাষায় প্রতিবাদ (বিদ্রোহ) করেছেন, পরশুরাম ও সৈয়দ মুজতবা আলী ব্যঙ্গের মাধ্যমে সমকালীন অসৎ মানুষের মুখোশ উন্মোচন করেছেন; আবার কাজী আনোয়ার হোসেন স্পাই মাসুদ রানাকে দিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রহস্যের জাল ছিন্ন করেছেন। গল্পকার ও গবেষক আশরাফ পিন্টুর “ছদ্মবেশী শয়তান’’ও কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা বা কুয়াশা সিরিজের মতো একটি রহস্যঘন উপন্যাস।
টঙ্গী শহরের কল্পিত ‘সালমা গার্ডেন’কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে “ছদ্মবেশী শয়তান”-এর কাহিনী। এর কিছু দূরে আলি আহমদ খানের বাসা। আলমগির ও লতা তার দু’ ছেলেমেয়ে। ওরা শৈশবে বেড়ে উঠেছে ঐ সালমা গার্ডেনে। সালমা গার্ডেন মূলত একটি পুরাতন জমিদার বাড়ি। এই সালমা গার্ডেনকে ভাড়া নেয় আগরওয়ালা নামে এ ভারতীয়। স্বাধীনতার এত বছর পরেও এদেশে বিদেশী বেনিয়াদের অবাধ ও অবৈধ বিচরণতা লক্ষ্য করা যায় এখানে। আগরওয়ালা দেখতে কেতা-দূরস্ত ভদ্রলোক হলেও সে বিভিন্ন দুষ্কর্মের সাথে জড়িত। তার কর্মচারি হিঙারু টাকা জাল করা কাজের সাথে জড়িত। আগরওয়ালার নির্দেশে সেই পাটোয়ারি সাহেবকে খুন করে। দোষ পড়ে লতার প্রেমিক চঞ্চল চৌধুরীর ঘাড়ে। এখানেই উপন্যাসটির কাহিনীকে জট পাঁকিয়েছেন লেখক; সে জট আস্তে আস্তে ছাড়িয়েছেন গোয়েন্দা সন্ধান চৌধুরী।
উপন্যাসের রহস্যঘন পরিবেশের সমান্তরাল ভাবে বিকশিত হয়েছে ছয়জন নর-নারীর প্রেম-ভালোবাসা। আলম-পান্না কিংবা সন্ধান-ফিরোজার প্রেমের চেয়ে লতা-চঞ্চলের প্রেম এখানে উজ্জ্বলতর। বিশেষ করে নায়ক চঞ্চলের চেয়ে নায়িকা লতাই উপন্যাসে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। লতা যেমন রূপসী তেমনি সাহসীও। সে একাকী আগরওয়ালার মতো দুূর্দান্ত লোকের মুখোমুখি হয়েছে। আগরওয়ালা শুধু রূপে নয় তার সাহসেও মুগ্ধ হয়েছে।
“ছদ্মবেশী শয়তান” গোয়েন্দা উপন্যাস হলেও এখানে রোমান্টিক প্রেম লক্ষ্য করা যায় আলম-পান্না ও সন্ধান-ফিরোজার মধ্যেও। পান্নাকে ছদ্মবেশে ছেলে সাজিয়ে রাখলেও আলম তা প্রথম পরিচয়ে টের পেয়ে যায়; আর এরপর থেকেই আলমের হৃদয়কোণে প্রেমের জন্ম হয়। ওদিকে আগরওয়ালা সন্ধানকে গাড়ি চাপা দিলে সেবা-শুশ্রƒষার ভার পড়ে নার্স ফিরোজার উপর। এরপর থেকেই দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। প্রেমের পাশাপাশি সন্ধানের রহস্য উদ্ঘাটনে ফিরোজাও বেশ ভূমিকা রাখে। আগরওয়ালা খল চরিত্র হলেও উজ্জ্বলতর। সে ভদ্র কেতা-দূরস্ত কিন্তু ঠা-া মস্তিষ্কের ভিলেন।
“ছদ্মবেশী শয়তান”- প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঔপন্যাসিক আশরাফ পিন্টু রহস্যের আবহ রেখেছেন; যার দরুণ পাঠকরা এক নিঃশ্বাসে উপন্যাসটি পড়ে ফেলতে পারবেন। লেখক রহস্যের জট খুলেছেন একেবারে শেষেÑপরিশিষ্টে। এখানে দেখা যায় আগরওয়ালার সাথে খান সাহেবও জড়িত। এখানে লেখক হয় তো বোঝাতে চেয়েছেন যে, একজন বিদেশি কখনো সে দেশের লোকের সাহায্য-সহযোগিতা অপরাধ করতে পারে না। এই বাস্তবতাকে লেখক রহস্যের ঘেরাজালে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন।
পরিশেষে বলা যায়, উপন্যাসটিতে যেমন অতিকথন নেই তেমনি অনাবশ্যক কোনো চরিত্রও নেই। উপন্যাসের প্রয়োজনেই লেখক সংলাপ ও চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। স্বল্প পরিসরের (৬৪ পৃষ্ঠার) এই উপন্যাসটি পাঠক এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।