শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি

দেশের মুদ্রা বাজারে হঠাৎ করেই মার্কিন ডলারের মূল্য বাড়তে শুরু করেছে। গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, ডলারের মূল্য শুধু বাড়ছেই না, বাড়ছেও লাফিয়ে লাফিয়ে। বৃদ্ধির বিষয়টিকে ‘উল্লম্ফন’ হিসেবে চিহ্নিত করে অর্থনীতিবিদসহ বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাস্তবে এরই মধ্যে সে প্রভাব পড়তে শুরুও করেছে। অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার একটি কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশি পরিমাণে ডলার বিক্রি করার পন্থা নিয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে যেখানে ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল, সেখানে গত সপ্তাহের শেষদিন বৃহস্পতিবার একদিনেই বাংলাদেশ ব্যাংক বিক্রি করেছে চার কোটি ডলার। কিন্তু গড় চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি হলেও বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডলার ৮২ টাকা ৯০ পয়সা দরে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে কোনো কোনো ব্যাংক প্রতি ডলারের জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে ৮৪ থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত আদায় করেছে। তা সত্ত্বেও ডলারের দাম যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনি ডলার বিক্রিও হচ্ছে অনেক বেশি পরিমাণে। 

হঠাৎ কেন মার্কিন ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে তার উত্তর দিতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ ও তথ্যাভিজ্ঞরা বলেছেন, অবৈধ পথে টাকার পাচার এমন অবস্থার প্রধান কারণ। চলতি ২০১৮ সাল যেহেতু নির্বাচনের বছর সেহেতু স্বাভাবিক নিয়মেই বিদেশে টাকা পাচার অনেক বেড়ে গেছে। ক্ষমতার সম্ভাব্য রদবদল, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিশোধসহ সহিংসতার আশংকায় বড় দলের নেতা, ঠিকাদার ও অসৎ ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাসহ আরো অনেকেই দেশে টাকা রাখার চাইতে বিদেশে পাচার করে দেয়াকে নিরাপদ মনে করেন। বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা থাকায় এ ধরনের ব্যক্তিরা হুন্ডিসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। বর্তমান পর্যায়েও তেমন অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছে। আর টাকা যেহেতু পাচার করা যায় না এবং করা গেলেও সেটা যেহেতু লাভজনক ও নিরাপদ নয় সেহেতু সংশ্লিষ্টজনেরা মার্কিন ডলারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। একই কারণে রাতারাতি ডলারের দামও বাড়তে শুরু করেছে। তথ্যাভিজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, পাচারের এই ধারা প্রতিহত না করা গেলে ডলারের দাম তো বাড়তে থাকবেই, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, মাত্র মাস কয়েক আগেও যে মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল ৮০ টাকার নিচে, সে একই ডলারের মূল্য ৮৫ টাকা পর্যন্ত উঠে যাওয়ার  বিষয়টি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আশংকাজনক। কথা শুধু এটুকুই নয়, অর্থনীতিবদসহ বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন এবং এমন অনুমান সত্যও যে, নির্বাচনের বছর বলে ডলারের মূল্য আরো বাড়তেই থাকবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে আমদানি ও রফতানিসহ পণ্যের মল্যের ওপর। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে বলে পণ্যের মূল্যও বাড়তে থাকবে। অন্যদিকে রফতানি করতে গিয়ে একই ডলারের কারণে ক্ষতির শিকার হবেন ব্যবসায়ীরা। 

নির্বাচনের বছরের দোহাই দেয়া হলেও আমরা কিন্তু বিষয়টিকে গ্রহণযোগ্য মনে করি না। কারণ, গত বছরই ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) তার এক রিপোর্টে জানিয়েছিল, টাকা পাচারের ক্ষেত্রে মাত্র এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৮তম অবস্থান থেকে ২৬তম অবস্থানে উঠে এসেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে টাকার পাচার বেড়েছে অবিশ্বাস্য পরিমাণে। বছরে পাচার হয়ে যাওয়া টাকার পরিমাণও চমকে ওঠার মতো। জিএফআই-এর রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর পাচার হয়ে যাচ্ছে গড়ে ৪৪ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা, যার পরিমাণ ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের সমান। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য-পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে জিএফআই তার রিপোর্টে জানিয়েছিল, আমদানি ও রফতানির উভয় ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে প্রতি বছর ৪৯১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৩৮ হাজার আটশ কোটি টাকা পাচার করা হচ্ছে। জিএফআই-এর রিপোর্টে আরো জানানো হয়েছিল, ‘নির্বাচনের বছর’ ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছিল ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। 

মার্কিন সংস্থার এই রিপোর্টের আলোকে পর্যালোচনা করতে গিয়ে তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, এত বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার ফলে দেশের ভেতরে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। সৃষ্টি হয়নি চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগও। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও সংঘাতের কারণেই দেশি-বিদেশি কোনো শিল্প উদ্যোক্তাই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার সাহস পাচ্ছেন না। তথ্যাভিজ্ঞরা প্রসঙ্গক্রমে সরকারের প্রতিহিংসামূলক নীতি ও কর্মকান্ডকে পরিস্থিতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো জনপ্রিয় দলগুলোর বিরুদ্ধে সরকার প্রচন্ড দমন-পীড়ন চালিয়ে এসেছে বলেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। তেমন সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে এগিয়ে আসছে নির্বাচনের সময়। সে নির্বাচন ঠিক কোন সরকারের অধীনে হবে এবং নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হতে পারবে কি নাÑ তা নিয়েও এরই মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। একই কারণে ব্যবসা ও বিনিয়োগে আগ্রহীদের মধ্যেও ভীতি-আতংক বেড়ে চলেছে। তারা তাই দেশ থেকে অবৈধ পথে পাচার করছে লক্ষ-হাজার কোটি টাকা। এভাবে চলছে বলেই শিল্প-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির প্রতিটি খাতে সংকট ক্রমাগত আরো মারাত্মক হয়ে উঠছে। 

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতো আমরাও মনে করি, টাকার পাচার বন্ধ করার পাশাপাশি পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে হলে সরকারের উচিত অবিলম্বে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বন্ধ করে দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা দরকার, কাউকেই যাতে অবৈধ পথে টাকা পাচার করার কথা চিন্তা না করতে হয়। আমরা প্রসঙ্গক্রমে টাকা পাচারকারীদের চিহ্নিত করার এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনসঙ্গত ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও দাবি জানাই। এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হলেই টাকার পাচার যেমন কমবে তেমনি কমে আসবে মার্কিন ডলারের মূল্যও।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ