শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

১৯৩৭ সালের নির্বাচন ও একে ফজলুল হক

ইবরাহিম রহমান : [এক] মুসলমানদের সর্বভারতীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপের ফলে বাংলার মুসলমানরা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী একটি সংগঠনে প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। ১৯২৯ সালের নির্বাচনের পর তৎকালে বর্তমান বিভিন্ন দলের ২৭ জন মুসলমান সদস্য ‘বেঙ্গল মুসলিম কাউন্সিল এসোসিয়েশন’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কাউন্সিলে মুসলিম সদস্যরা আইন সভায় সরকার সমর্থক অন্যান্য সদস্য থেকে পৃথকভাবে আসন গ্রহণ করেন। এটিই শেষ পর্যন্ত নিখিল বঙ্গ প্রজাসমিতির নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। এই থেকেই ১৯২৯ সালে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি গঠিত হয়। স্যার আবদুর রহিম হলের  সভাপতি, মাওলানা আকরম খান হন এর সেক্রেটারি। সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন মুজিবর রহমান খান, আবদুল করিম, এ কে ফজলুল হক, আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী এবং আবদুল মোমেন। সহকারী সেক্রেটারি হন শামছুদ্দিন আহমদ ও তমিজ উদ্দিন খান। বাংলার অধিকাংশ মুসলমানের স্বার্থ যেহেতু কৃষক প্রজার সাথে জড়িত, তাই বাংলার রাজনীতি ক্রমশ প্রজানির্ভর হয়ে ওঠে। এখানে হিন্দু নেতারা হয়ে দাঁড়ায় হিন্দু জমিদারদের পৃষ্ঠপোষক আর মুসলমান নেতারা হয়ে ওঠে প্রজা সমর্থক। ঘন ঘন সম্মেলন হতে থাকে এবং ১৯৩০ এর পর থেকে মুসলিম নেতৃত্বে প্রজা আন্দোলন শুরু হয়।

বাংলায় মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাংশের জন্য প্রজাসমিতি একদিকে বর্ণহিন্দু, অপরদিকে প্রাচীনপন্থী মুসলিম নেতৃত্বকে আক্রমণ করার হাতিয়ারে পরিণত হয় এবং তারা এভাবে রাজনৈতিক মানদ- তাদের স্বপক্ষে আনতে সচেষ্ট হয়। সিআর দাসের নেতৃত্বাধীন স্বরাজ্য পার্টি আইনসভা থেকে ১৯৩০ সালে বেরিয়ে এলে মুসলমানদের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা কমে যায়। বৃটিশ সরকার আবদুর রহিম ও ফজলুল হকের ন্যায় প্রজা সমিতি নেতাদের বাদ দিয়ে খাজা নাজিম উদ্দিন, ফারুকী ও গজনভী প্রমুখ লোকদের মন্ত্রিত্বে আনে। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত নাজিমুদ্দিন মন্ত্রী বা নির্বাহী কাউন্সিলর হিসাবে কাজ করেন। 

১৯৩২ সালের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ অনুযায়ী বাংলার আইনসভায় মুসলমান সদস্য ৩৯ থেকে ১২০ এ উন্নীত হয় এটিকে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে মুসলমানরা বেশ সুবিধা লাভ করে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ হিন্দু সমাজ এর বিরোধিতা করে। এর মধ্য দিয়ে বাংলার রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম ব্যবধান বেড়ে যায়।

১৯২৭ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে অনেক মুসলমান বাংলার বিভিন্ন জেলায় লোকাল ও ইউনিয়ন বোর্ডে নির্বাচিত হয়। এর ফলে পৃথক সত্বা হিসেবে মুসলমানদের রাজনৈতিক পরিচিতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। শিক্ষা ও কৃষি বিষয়ক আইন দ্বারা তা আরও সুসংহত হয়। কারণ কৃষকরা অধিকাংশই ছিল মুসলমান। আইনসভায় সরকার জমিদার শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল হলেও ফজলুল হক ও আবদুর রহিমের নেতৃত্বে প্রজাপার্টি সরকারের কিছু কিছু প্রস্তাবে সমর্থন দেয়। প্রস্তাবগুলো আইনসভায় পাস হয়ে আইনে পরিণত হয়। এগুলো (১) বাংলার প্রজাস্বত্ব সংশোধন আইন ১৯২৮ (২) পল্লী প্রাথমিক বিদ্যালয় আইন ১৯৩০ (৩) মিউনিসিপ্যাল সংশোধনী বিল ১৯৩২ (৪) মহাজনী বিল ১৯৩২ এবং (৫) চাষী আইন ১৯৩৩।

এভাবে মুসলমানগণ ক্রমশ ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। অপরদিকে হিন্দুরা মনে করে সরকার মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। 

ফজলুল হকের আবির্ভাব : ১৯৩৫ সালে স্যার আবদুর রহিম কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় তিনি প্রজা সমিতির পদে ইস্তফা দেন। ফলে ফজলুল হক সর্বসম্মতিক্রমে প্রজা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃবৃন্দ এবং অধিকাংশ প্রজা ফজলুল হকের সমর্থক হয়ে ওঠে। জেলায় জেলায় বিশাল বিশাল সমাবেশে আবেগময় ভাষায় ফজলুল হক কৃষক প্রজাদের দুঃখের কথা বলেন। ফলে অচিরেই প্রজা আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং ফজলুল হক কৃষকদের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। ১৯৩৬ সালে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কৃষকদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে প্রজা সমিতির নাম পাল্টিয়ে এর নাম রাখা হয় কৃষক প্রজা সমিতি। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে পটুয়াখালী আসন থেকে খাজা নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে ফজলুল হক বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। কৃষক প্রজা পার্টি ৩৮টি আসন লাভ করে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ৪০টি আসন পায়। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় ফজলুল হক মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা করতে বাধ্য হন। প্রজা-লীগ কোয়ালিশন গঠনে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা ছিল মুখ্য। ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিভায় ১১ সদস্যের মধ্যে ৫ জন ছিল মুসলমান, ৫ জন হিন্দু। মুসলিম মন্ত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা হাবিব উল্লাহ।

মন্ত্রিসভা গঠন করেই তিনি ব্যাপক কাজ শুরু করেন। বিশেষ করে মুসলিম শিক্ষা ও মুসলিমদের কল্যাণে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। মুসলমানদের চাকরিতে প্রাধান্য দেয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ সংরক্ষিত রাখার জন্য আইন পাস করেন এবং পঞ্চাশ ভাগ কোটা বাস্তবায়ন তদারকি করার জন্য একজন স্পেশাল অফিসার নিয়োগ দেন। এর আগে মুসলমানরা চাকরি ক্ষেত্রে চরম অবহেলার শিকার ছিল। পঞ্চাশ ভাগ চাকরি মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত করার পর মুসলমানদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসে এবং মুসলিম সমাজ ঘুরে দাঁড়ায়।

কংগ্রেস সদস্যরা আগাগোড়াই ফজলুল হকের বিরোধিতা করে। ফলে তিনি মুসলমানদের মধ্যে আরও জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠেন। কিন্তু মুসলিম লীগের চাপে মন্ত্রিসভার প্রজা সদস্য শামছুদ্দিন আহমদকে বাদ দিয়ে জমিদার শ্রেণীর প্রতিনিধি মোশাররফ হোসেনকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করলে নিজের দলে ভাঙ্গন দেখা দেয়। বঙ্গীয় কৃষক প্রজা পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় ১৭ জন সদস্যকে বহিষ্কার করায় দলের প্রভাবশালী অংশের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ফলে কৃষক প্রজা পার্টি কোয়ালিশনে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ আইন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠে। এদিকে বৃটিশ সমর্থক দল ইউরোপীয় শ্রেণী ও কলকাতার অবাঙ্গালি মুসলিম শ্রেণী তার বিপক্ষে চলে যায়। ফজলুল হকের এই দুর্বল অবস্থানে মুসলিম লীগ খাজা নাজিম উদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী করার দাবি উঠে। 

এই প্রেক্ষাপটে ফজলুল হক ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে কৃষক প্রজাপার্টি ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ফজলুল হকের মুসলিম লীগে যোগদান বঙ্গীয় মুসলিম লীগের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ফজলুর হক মন্ত্রিসভায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রী। সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে ট্রেড ইউনিয়ন করার অনুমতি প্রদানের ফলে শ্রমিকদের মধ্যে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৮ সালের পর থেকে কংগ্রেস ও কৃষক প্রজাপার্টি হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে থাকে।

জাতীয় প্রতিরক্ষা পরিষদে সদস্য নিয়োগের প্রশ্নে জিন্নাহর সঙ্গে ফজলুল হকের মতবিরোধ হয়। সরকার ভারতীয়দেরকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিল গঠন করে। এতে ফজলুল হক ও সিকান্দার হায়াত খানকে সদস্য করা হয়। লীগ সদস্য ফজলুল হককে লীগের মাধ্যমে সদস্য করা হয়নি বিধায় জিন্নাহ ফজলুল হককে পরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে বললে ফজলুল হক অপমানিত বোধ করেন। যুগপৎ পরিষদ ও মুসলিম লীগ থেকেও পদত্যাগ করেন। এমতাবস্থায় আইনসভায় মুসলিম সদস্যদের নিয়ে প্রগ্রেসিভ পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৪১ সালে ১লা ডিসেম্বর কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা থেকে লীগ সদস্যগণ পদত্যাগ করলে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। [চলবে]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ