শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

একজন মাহাথির মোহাম্মদ

আখতার হামিদ খান : ৩১ অক্টোবর, ২০০৩। টানা ২২ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকার পর অবসর গ্রহণ করলেন ড. মাহাথির মোহাম্মদ। পেছনে রেখে গেলেন এক সমৃদ্ধশালী মালয়েশিয়া। বর্তমান বিশ্বে নেতৃত্ব দানের সঠিক গুণাবলী সম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের চরম অনটন চলছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বে, তথা মুসলিম উম্মাহতে বিশ্বমানের রাষ্ট্রনায়ক এখন নেই বললেই চলে। টানা দু’দশক মাহাথির অসাধারণ দূরদৃষ্টি সহকারে মালয়েশিয়াকে পরিচালনা করেছিলেন। এ সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিম-লে তিনি ছিলেন তৃতীয় বিশ্ব, তথা মুসলিম বিশ্বের অধিকার সংরক্ষণ ও স্বার্থ আদায়ের পক্ষে সবচে’ জোরালো বক্তা। তিনি প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য পেশ করতেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে। তার বিদায় উন্নয়নশীল বিশ্ব, তথা মুসলিম উম্মাহ’কে এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ও নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।
১৯২৫ সালের ১০ জুলাই মালয়েশিয়ার কেদাহ রাজ্যের অ্যালোর সেতার শহরে মাহাথির জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ ইস্কান্দারের ৯ জন সন্তানের মধ্যে মাহাথির ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। মোহাম্মদ ইস্কান্দার স্থানীয় বিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। মাহাথির তার পিতার বিদ্যালয়ে নিজ শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন। ছাত্রজীবনের শুরু থেকেই তিনি ইংরেজি ভাষায় যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করে সবাইকে চমকে দেন। ১৯৪২ সালে জাপান মালয়েশিয়া দখল করলে মাহাথিরের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়। তখন সংসার চালানোর জন্য তিনি ব্যবসায় নেমে পড়েন। তৎকালীন দোকান চালু করেন তিনি। এতে নানারকম মালয়ী খাবার তৈরি ও বিক্রি করা হতো। মাহাথিরের ক্রেতাদের কাছে সবচে’ জনপ্রিয় ছিলো সেন্ডাল নামের এক ধরনের কুলফি আইসক্রীম। কিন্তু মাহাথির তখন তার দোকানে জাপানী খাবার তৈরি করেননি। এমনকি তিনি জাপানীদের কাছে খাবারও বিক্রি করেননি।
১৯৪৫ সালে জাপান মিত্রাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করলো। মালয়েশিয়া ফিরে গেলে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসনে। তখন মাহাথির অ্যালোর সেতার শহরের সুলতান আবদুল হামিদ কলেজে ভর্তি হলেন। ঐ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর তিনি বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য সরকারী বৃত্তি পেলেন। তার ইচ্ছা ছিলো, লন্ডনের লিংকন্স ইনে আইনশাস্ত্রে অধ্যয়ন করা। কিন্তু মালয় সরকার দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনজীবী রয়েছে- এই অজুহাতে মাহাথিরের আইন শিক্ষা লাভের আবেদন নাকচ করে দিলো। সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী মাহাথির চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়ন করার জন্য ভর্তি হলেন সিঙ্গাপুরের কিং সেভেস্থ এডোয়ার্ড মেডিক্যাল কলেজে। এটি ১৯৪৭ সালের কথা। সিঙ্গাপুরে অধ্যয়নকালে মাহাথির মোহাম্মদের সাথে পরিচয় ঘটলো সিতি হাসমাহ’র। পরিচয় থেকে প্রেম, প্রেম থেকে পরিণয় ঘটলো পর্যায়ক্রমে। ১৯৫৩ সালে মাহাথির মোহাম্মদ এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করলেন। অ্যালোর সেতারে ফিরে এসে মাহাথির ও সিতি একটি চিকিৎসা কেন্দ্র খুললেন। এটি ছিলো মালয়েশিয়ার প্রথম মালয়ী মালিকানাধীন প্রাইভেট ক্লিনিক। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত মাহাথির সরাসরিভাবে ক্লিনিকটি নিজে পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সিতি ক্লিনিকটি পরিচালনা করেন। ১৯৮১ সালে ক্লিনিকটির মালিকানা পরিবর্তন ঘটে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ক্লিনিকটি ছিলো মালয়েশিয়ার সেরা চিকিৎসা কেন্দ্র।
১৯৪২ সালে জাপানী দখলের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় গড়ে উঠেছিলো ইউনাইটেড মালয়ী ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (উমনো) নামের একটি গুপ্ত সংস্থা। মাহাথির তখন সংস্থাটির স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে নাম লেখান। ১৯৪৫ সালে তিনি উমনোর সদস্যে পরিণত হন। ১৯৪৭ সালে মাহাথির সিঙ্গাপুরে চলে যান চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে। এদিকে উমনো ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম স্বাধীনতার পক্ষে ছদ্মনামে বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। ১৯৫৩ সালে তিনি মালয়ে ফিরে এসে নিজ শহরে চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করলেন। সে সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেন উমনোর নিয়মতান্ত্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট মালয়েশিয়া ব্রিটিশ শাসনের নিগঢ় থেকে মুক্তি পেলো। সে সাথে স্বাধীন মালয়েশিয়া চিরদিনের জন্য হারালো সিঙ্গাপুর ও ব্রুনাইকে। ১৯৬৪ সালে মালয়েশিয়ার প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এতে মালয়েশিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির কোটা সেতার সেলাতান আসন থেকে উমনো পার্টির টিকিটে জয়ী হলেন মাহাথির। শুরু থেকেই মাহাথির স্পষ্টবাদী ও নিজ নীতিতে অটল এক রাজনীতিবিদরূপে পরিচিত লাভ করেছিলেন। তার এই নীতি উমনোর প্রভাবশালী অংশটি আদৌ মেনে নিতে পারেনি। ফলে দলীয় অসহযোগিতার কারণে মাহাথির ১৯৬৯ সালের নির্বাচনে ৯৮৯ ভোটের ব্যবধানে ইসলাম পার্টি অফ মালয়েশিয়ার প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। এ বছরেই তার বই দ্য মালয় ডিলেমা প্রকাশিত হয়ে বিতর্কের ঝড় তোলে। এ বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর কুয়ালালামপুরে উমনো পার্টির এক সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে মাহাথির মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও উমনোর তদানীন্তন চেয়ারম্যান টুংকু আবদুল রহমানের নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। ফলে মাহাথিরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৭২ সালে মালয়েশিয়ার সেলানগর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হারুন ইদ্রিসের প্রচেষ্টায় মাহাথির মোহাম্মদ উমনো পার্টিতে পুনর্বাসিত হন। ১৯৭৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মালয়েশিয়ার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ও উমনো পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান টুংকু আবদুল রাজ্জাকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাহাথির কোটা সেতার সালাতান আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। নির্বাচনে মাহাথির বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন। সেইসাথে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৫ সালের দলীয় সম্মেলনে মাহাথির উমনো পার্টির জুনিয়র ভাইস- চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। ১৯৭৬ সালে তিনি মালয়েশিয়ার জুনিয়র উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৭৭ সালে টুংকু আবদুল রাজ্জাক মৃত্যুবরণ করেন হৃদয়ন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। ফলে উমনো পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিনিয়র উপ-প্রধানমন্ত্রী তুন হোসেন ওন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী উপনো’র চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন। অন্যদিকে মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার সিনিয়র উপ প্রধানমন্ত্রী ও উপমো পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন। তখন মাহাথিরের উপর শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়ের গুরুদায়িত্বভার অর্পিত হয়। ১৯৮১ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে তুন হোসেন ওন স্বাস্থ্যগত কারণে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তখন মাহাথির উমনো পার্টি নিরংকুর সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফলে ১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই দাতু সেরি ড: মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রীতে পরিণত হন। তখন তার বয়স ৫৬ বছর।
মাহাথির যেদিন মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণ করলেন সেদিন দেশটি বিশ্বের দরিদ্রতম রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম। তখন এর মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিলো মাত্র ১৩০ ডলার। একমাত্র রপ্তানিযোগ্যা সামগ্রী ছিলো কাঁচা রাবার। প্রধান ভাষা ছিলো ৬টি। যথা- মালয়, ইংরেজি, চীনা, তামিল, তেলেগু, মালয়ালয়। প্রধান ধর্ম ছিলো ৬টি। যথা- ইসলাম, বৌদ্ধ, তাও, হিন্দু, খ্রিস্টান ও শিখ। জনসংখ্যার ৩৫% দারিদ্রসীমার নিচে বাস করতো। মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিলো ২৫%। শিক্ষিতের হার ছিলো ২০%। জনসংখ্যার ৩৩.৩৩% ছিলো শহরবাসী ও শিল্পনির্ভর।
মাহাথির যেদিন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নিলেন সেদিন দেশটি বিশ্বের দ্রুত উন্নয়নশীর রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম। এখন এর মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৩৩৩০ ডলার। দেশটির প্রধান রপ্তানিযোগ্য সামগ্রী হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক্স, পেপ্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস, কেমিক্যালস, পাম অয়েল, কাঠের তৈরি সামগ্রী, টেক্সটাইল ও রাবারের তৈরি পণ্য। প্রধান ভাষা ও ধর্ম আগের মতোই রয়েছে। জনসংখ্যা ২ কোটি ৪৪ লাখ। এর মাত্র ৫% দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ মাত্র ২.৫%। শিক্ষিতের হার ৯৯%। জনসংখ্যার ৬৬.৬৭% নগরবাসী ও শিল্পনির্ভর। পুরুষদের গড় আয়ু ৭১ বছর, নারীদের গড় আয়ু ৭৬ বছর। জনসংখ্যার ৩৩.৩৩% ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এককথায়, মাহাথিরের ২২ বছরের শাসনামলে মালয়েশিয়া যে উন্নতি সাধন করেছে তা তৃতীয় বিশ্ব তথা মুসিলম উম্মাহ’র জন্য এক অনুসরণীয় ্দার্শ। আর এটাই হচ্ছে মাহাথিরের সবচে’ বড় সাফল্য।
মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী হয়েই মালয়েশিয়ার প্রতিটি অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবার পদক্ষেপ হয়েই মালয়েশিয়ার প্রতিটি অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। দেশটির প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীরূপে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, শিক্ষার বিস্তার বিনা উন্নতি অর্জন করা আদৌ সম্ভব নয়। তাই তিনি কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে গোটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ন্যস্ত করেছিলেন। তার শাসনামলে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পরিমাণ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ঘটেছিলো তাই-ই মালয়েশিয়ার উন্নয়নের ভিত্তিরূপে কাজ করেছে। মাহাথির নিজ শাসনামলের শুরু থেকেই ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতগুলোর উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছিলেন। এ কারণে ১৯৮৫ সালের মধ্যেই মালয়েশিয়ার শিল্প-বাণিজ্য খাতগুলোর ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটে। একই বছর থেকে দেশটিতে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৯০ সালে বিদেশী ও মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ীদের মধ্যে যৌথ উদ্যোগগুলোর সূচনা ঘটে। ১৯৯৫ সালের মধ্যে মালয়েশিয়া বৈদেশিক বাণিজ্যে উদ্বৃত্তের অধিকারী হয়। ২০০০ সালের মধ্যে দেশটি বহির্বিশ্বে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। মালয়েশিয়ার এই অভূতপূর্ব আর্থ-সামাজিক প্রগতি সম্ভব হয়েছে মাহাথিরের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা কারণে। যখন যেমন নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন তখন তেমন নীতি তিনি অবলম্বন করেছেন। এক্ষেত্রে কোনো বিরূপ সমালোচনাই তাকে তার পথ থেকে টলাতে পারেনি। সাহস, একনিষ্ঠতা ও দূরদর্শিতার শিক্ষা, শিল্প, অবকাঠামো ও প্রযুক্তি খাতগুলোর উন্নয়নের জন্য মাহাথির যে পরিমান রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করেছেন তার নজির তৃতীয় বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। এসব খাতে তার এহেন বিনিয়োগের কারণেই মালয়েশিয়া পরিণত হয়েছে দ্রুত উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্রে। বস্তুপক্ষে মালয়েশিয়া এখন বিশ্বের ১৭তম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারী।
মাহাথিরের শাসনামলের সবচে’ বড় সংকট ছিলো ১৯৯৭-৯৮ আর্থিক সালে বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থার ধস। এই ধসের কারণে গোটা বিশ্বেই ডলারের মূল্য প্রচ- গতিতে বেড়েছিলো। অবিশ্বাস্য গতিতে কমেছিলো অন্যান্য মুদ্রার নাম। একমাত্র মার্কিন শেয়ার মার্কেটগুলোর মূল্যসূচক স্থির ছিলো। বাকি সব শেয়ার মার্কেটের মূল্যসূচক পড়ে গিয়েছিলো। এই মুদ্রা সংকটের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আর সব দেশেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর সুপাশিমালা অন্ধের মতো অনুসরন করতে বাধ্য হয়েছিলো। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো মালয়েশিয়া। মাহাথির তখন মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে ডলারের বিপরীতে রিংগিটের মূল্যকে স্থির রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতে মাহাথির পশ্চিমা বিশ্বের তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন তার কঠোর মুদ্রানীতি মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের হাত থেকে রক্ষা করেছিলো।
মাহাথিরের এই অর্থনৈতিক নীতি তাকে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলো ১৯৯৮ সালে। তখন মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। তিনি একই সাথে উমনো পার্টির ভাইস-চেয়ারম্যানও ছিলেন। তখন আনোয়ার ইব্রাহিমকে মাহাথির মোহাম্মদের উত্তরসূরী বলে মনে করা হতো। আনোয়ার ইব্রাহিম বিশ্বব্যাংক আইএমএফ’র সুপারিশমালা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি মাহাথিরের মুদ্রামান নিয়ন্ত্রণ নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ফলে মাহাথির আনোয়ারকে পাশ কাটিয়েই নিজ নীতি বাস্তবায়িত করেন। ক্ষুব্ধ আনোয়ার তখন উমনো পার্টির সম্মেলনে নিজ সমর্থকদের নিয়ে আন্তঃদলীয় বিদ্রোহ ঘটানোর পদক্ষেপ নেন। ঠিক এ সময়েই আনোয়ার ইব্রাহিমকে গ্রেফতার করা হয় দুর্নীতি, সমকামিতা ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। এরপর মাহাথিরের অনুগত আবদুল্লাহ আহমদ বাদায়িকে অধিষ্ঠিত করা হয় বিদ্রোহী আনোয়ার ইব্রাহিমের পদগুলোতে।
আসলে টানা ২২ বছর নির্বাচিত একনায়কের মতো মালয়েশিয়াকে শাসন করেছেন ড. মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি কখনোই অজ্ঞানতা, সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেননি। কখনোই সতীর্থদের বিরূপ সমালোচনা সহ্য করেননি। এমনকি তিনি বিন্দুমাত্র ভিন্œ মতকেও দমন করেছেন লৌহকঠিন নির্মমতার সাথে। আর এ কারণেই মাহাথির তার শাসনামলে নিজের তিনজন সম্ভাব্য উত্তরসূরির রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিনষ্ট করেছেন বিদ্রোহ দমনের নামে। এদের মধ্যে আনোয়ার ইব্রাহিম ছিলেন সবচে’ সম্ভাবনাময়।
এ বছরের অক্টোবরে মালয়েশিয়ার পুত্রজায়া শহরে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠাণে স্বাগত ভাষণ দিতে গিয়ে মাহাথির বিশ্বের আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর ইহুদীদের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে খোলামেলা বক্তব্য দানের কারণে আন্তর্জাতিক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। তবে এটা পুরনো রোগ। ১৯৯৭-৯৮ সময়ের বিশ্বব্যাপী মুদ্রা সংকটের জন্য ইহুদী ব্যবসায়ীদের অভিযুক্ত করার কারণে তিনি একই রকম সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তবে আনোয়ার ইব্রাহিমের পতন ও বেমক্কা স্পষ্ট ভাষণের জন্য মাহাথিরকে দায়ী করা হলে তার প্রতি অবিচারই করা হবে মাত্র। বরঞ্চ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীরূপে তার সাফল্য ও তৃতীয় বিশ্বের দুঃসাহসী মুখপাত্ররূপে তার ভূমিকা সকল নেতিবাচিক সমালোচনার চেয়েও বড়। এক্ষেত্রে মাহাথির মোহাম্মদের কোনো তুলনা নেই।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মাহাথির সবসময়েই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনা নীতিমালার কঠোর সমালোচক ছিলেন। একই সাথে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সা¤্রাজ্যবাদী নীতিকেও নির্মমভাবে সমালোচনা করেছেন। তিনি জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয় ভূমিকাকে তীব্রভাবে অপছন্দ করতেন। তিনি নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ভেটো দানের ক্ষমতা বিলোপের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি জোরালো ভাষায় আফগান ও ইরাক যুদ্ধ দু’টির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তৃতীয় বিশ্ব তথা মুসলিম উম্মাহ’র আর কোনো রাষ্ট্রনায়কই এ ধরনের প্রতিবাদ জ্ঞাপনের কথা চিন্তাও করেননি। বরঞ্চ তারা প্রতিবারই নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন।
মাহাথির সবসময়েই এশিয়ান মূল্যবোধকে প্রচার করেছেন নিরলসভাবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তার নীতি সবসময়েই ছিলো পূর্বমুখী। তিনি সবসময়েই বিশ্বাস করতেন যে, অর্থনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ এশিয়া ইউরোপ ও আমরিকার সাথে সর্বক্ষেত্রের সমান তালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম। তিনি মুসলিম উম্মাহ যাতে নিজ সকল দুর্বলতা ঝেড়ে নিজ ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় নিজ সকল দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে নিজ ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় সেজন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। পুত্রজায়ায় অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, “এখন মুসলমানদের সংখ্যা ১৩০ কোটি। বিশ্বের ১৮০ টি রাষ্ট্রের মধ্যে ৫৭টিই মুসলিম রাষ্ট্র। মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশ্বের জ্বালানি ভান্ডার।
মুসলমানরা শিক্ষিত ও ধনী। তারপরেও মুসলমানরা সর্বক্ষেত্রে অত্যাচার, শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। বিজ্ঞান ও গণিত না জানার কারণে মুসলমানরা সকল ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছে। পরনির্ভরশীল, সংকীর্ণচিত্ত ও বিভক্ত হয়ে থাকলে মুসলমানরা কোনোদিনও নিজের দুর্দশা মোচনে সক্ষম হবে না।’ মুসলিম উম্মাহ’র আর কোনো রাষ্ট্রনায়ক এতোটা প্রাঞ্জলভাবে চিন্তা করেন বলে মনে হয় না।
এটাই হচ্ছে দাতু সেরি ড: মাহাথির মোহাম্মদের সবচে’ বড় সম্পদ। তিনি মনে করতেন যে, তৃতীয় বিশ্বকে প্রথম বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণের অসহায় শিকার হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে আত্মনির্ভরশীরতা অর্জন করতে হলে তৃতীয় বিশ্ব প্রথম বিশ্বের কাছ থেকে নিজ স্বার্থ কড়ায় গ-ায় আদায় করে নিতে সক্ষম হবে। আর যতোদিন তা না ঘটবে ততোদিন তৃতীয় বিশ্বকে বিশ্বায়নের কারাগারে বন্দী থাকতে হবে।
মাহাথির মোহাম্মদ যেভাবে গত দু’দশকে মালয়েশিয়ার উন্নতি ঘটিয়েছেন তা থেকে শক্তিশালী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণিত হয়েছে। তৃতীয় বিশ্ব তথা মুসলিম উম্মাহ কি পারবে মাহাথির মোহাম্মদের পদাংকে অনুসরণ করতে?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ