বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

“কাফেরের তলোয়ার- চাও কতল করিতে আমারে”

শফি চাকলাদার : (২য় অংশ ) কবির অসুস্থতা নিয়ে ‘পড়িব একাকী’ গ্রন্থে লেখক প্রসিদ্ধ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জনাব মোস্তফা জামান আব্বাসী যে তথ্য তুলে ধরেছেন তাতে নজরুল-অসুস্থতা আরো রহস্যাবৃত হয়ে উঠল। আমার এ নিবন্ধের মধ্যে আরো কিছু তথ্য যুক্ত করছি, নজরুলকে ঘাড়ে আঘাত করা হলো ১০ই জুলাই ১৯৪২। ১৯৪২ এরই ০৫ অক্টোবর কবি ‘অপরূপা’ কবিতাটি রচনা করে বলেন, কাফেরের তলোয়ারÑ/চাও কতল করিতে আমারে’-

ঘটনার ৮৮ দিন পর। কিন্তু এর মধ্যেও নজরুলের আরো পত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত নজরুল জন্ম শতবার্ষিকী নবম খ- (১লা ফেব্রু.-২০০৯/১৯ মাঘ ১৪১৫)’তে রয়েছে-

পত্র নং সাতাত্তর (৭৭) প্রিয় হাইদরকে লেখা তাং ১০-০৭-১৯৪২

পত্র নং আটাত্তর (৭৮) প্রিয় ব্রজেনকে লেখা তাং ১৫-০৭-১৯৪২

পত্র নং ঊনআশি (৭৯) প্রিয় হাইদরকে লেখা তাং ১০-০৭-১৯৪২

পত্র নং আশি (৮০) শ্যামাপ্রসাদ মুখোপধ্যায়কে লেখা তাং ১৭-০৭-১৯৪২

পত্র নং একাশি (৮১) অনুজপ্রতিমেষু ¯েœহের হায়দারকে লেখা তাং ২২-০৭-১৯৪২

পত্র নং বিরাশি (৮২) প্রিয় কার্তিক বাবুকে লেখা তাং ১৪-০৮-১৯৪২

পত্র নং সাতাশি তারিখ নেই তবে পত্র নং-৫৩-তে তারিখ আছে একই পত্র ¯েœহের বুডুকে লেখা তারিখ মধুপুর ১৯৪২ এর ১২ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ এখানে সাতটি পত্র পাওয়া গেল ১০ জুলাই ১৯৪২ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪২ এর মধ্যে। যার সাতাত্তর নং পত্রে নজরুল একটি লাইনে হায়দারকে লিখেন ‘তুমি এখনই চলে এসো। অমলেন্দুকে আজ পুলিশ এরেস্ট করেছে। আমি কাল থেকে অসুস্থ।’ একই পত্রে ০৭-১০-৪২ তারিখও রয়েছে, এত অসাবধানতা তো বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দেয়, নয়কি? বাংলা একাডেমির সাবধান হওয়া দরকার মনে করি, এসব ছোটখাট ভুল নতুন রহস্য তৈরি করতে পারে? ১৭ জুলাইতেও নজরুল মধুপুর থেকে পাঁচশত টাকা পাঠাতে লিখেন। ১৪ আগস্ট ১৯৪২-এ কার্তিক বাবুকে মধুপুর থেকে রেকর্ড পাঠাতে লিখেন। বাংলা একাডেমির এই গ্রন্থের ৪৯নং চিঠি এবং ৮৬নং চিঠিই একই তবে ৪৯নং পত্রে তারিখ ২৩-০৮-১৯২৯ ছিয়াছি নং পত্রে একই ইংরেজি তারিখের সাথে বাংলা তারিখ ১৩৩৬ এর ০৭ই ভাদ্র উল্লেখ আছে। তবে এখানে চিঠির শেষে মধুপুর ১২-০৯-১৯৪২ উল্লেখ কেন করা হলো বুঝা গেল না। তেপ্পান্ন ও সাতাশি নং পত্র ¯েœহের বুডুকে লেখা। ৫৩ নং পত্রে মধুপুর ১২-৯-৪২ তারিখ রয়েছে, ৮৭’তে নেই। এই পত্রে কবি উল্লেখ করেছেন অক্টোবরের (১৯৪২) ১৫ তারিখের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে কলকাতা যাবেন। ¯েœহের বুডুকে তাই লেখা হয়েছে। চিঠিটি ১২ সেপ্টেম্বরে লেখা। এখানে আমি ‘পুড়িব একাকী’ থেকে সামান্য উদ্ধৃত দিচ্ছি-

‘দিনটি ১৯৪২ সালের ৯ই জুলাই। কয়েকজন ব্যক্তি নজরুলকে সেদিন গভীর রাতে পেছন দিক থেকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। কণ্ঠনালী সংযুক্ত পেছনের হাড় ও মাথায় ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। সম্বিত হারিয়ে ফেলেন তিনি।

জ্ঞান ফিরে এসেছিল, মাথার যে অংশে স্মৃতি তা হয় ভীষণভাবে পর্যুদস্ত। এরপরও কথা বলতে পারতেন, সামান্য কিছু লিখতেও, রাঁচিতে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য।’...

এখন এ লেখারই পর্ব উল্লিখিত অংশের সাথে আরো একটু আলোচনা যুক্ত করে বলতে চাই, ‘কে. মল্লিক, নজরুলের মানু মিয়া’র সাথে কথোপকথন-০৯ জুলাই এর লাঠির আঘাত, গভীর রাত-এরপও নজরুল কখানা লিখেছেন, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪২ পর্যন্ত পত্রগুলো পড়লে মনে হবে নজরুল এতবড় আঘাতের পরও সুস্থ হয়ে উঠছিল। ১৯৪২ এর ১২ সেপ্টেম্বর-এর পত্রও নজরুল সুস্থ হয়ে উঠছিল কিন্তু এর ২৩ দিন পর ০৫ই অক্টোবরে ১৯৪২-এ নজরুল ‘অপরূপা’ গীতি কবিতাখানি রচেন। সেখানেই নজরুল লিখেন একটি লাইন ‘কাফেরের তলোয়ার-চাও কতল করিতে আমারে’। আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই, ‘যে কয়েকজন ব্যক্তি’ আঘাত করে নজরুলকে অসুস্থ করতে নয় মেরে ফেলতেই করেছিল। কিন্তু এমন আঘাতের পর যখন নজরুল সুস্থ হতে লাগল তখন নেপথ্য অমানুষগুলো তাদের নজরুল-নিধনের দ্বিতীয় পরিকল্পনায় হাত দেয়। সেটা হলো স্লো পয়জনিং- যাতে নজরুলের শরীরে ঐ ওষুধের কার্যকারিতায় নানান রোগের সৃষ্টি হতে পারে এবং হয়েছেও। কারণ ডা. বিধান রায় ছিলেন নজরুলের প্রধান চিকিৎসক। কি ওষুধ কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে তা ডাক্তারদের নাগালের বাইরে নয়।  ‘নজরুল’কে গভীর রাতে লাঠির আঘাত করা হয়েছে- এ খবরটি তখন কোন সংবাদপত্রে এলো না কেন, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে এবং উঠেছেও। যারা নজরুলকে নির্লজ্জভাবে আঘাত করতে পারে তারা বিষয়টিকে গোপন করতেও পারে। ঘটনা ঘটার পরই তারা নজরুলকে হাসপাতালে নিয়েছে এবং কাউকে সেখানে প্রবেশ করতেও দেয়া হয়নি। পরিবারকেও সেভাবেই গোপন করে জানান হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন থাকে ‘নজরুল’ স্বয়ং এই আঘাতের কথা কোন পত্রে উল্লেখ করলেন না কেন? ১৭ জুলাই ১৯৪২-এর পত্রে নজরুল উল্লেখ করেন 'ঘঊজঠঊঝ ঝঐঅঞঞঊজঊউ' হয়ে গেছে এবং ০৫ অক্টোবর ১৯৪২ এর ‘অপরূপা’ গীতি কবিতার ‘কাফেরের তলোয়ার-চাও কতল করিতে আমারে’র মধ্যে সবকিছুই প্রকাশ হয়ে পড়ে। এই লাইনটি নিয়ে কবিতাটি প্রকাশের পর পরই আলোচনা হলে আমার মনে হয় ‘নজরুল চিকিৎসা’র পথ অন্যরকম হতে পারত। নজরুলের সুহৃদ-স্বজন-বন্ধু ছিলনা, এ কথাটি আমি আবারও দৃঢ়ভাবে বলে রাখলাম। আরো একটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে, ১৯৫৩ এর মে মাসে কবিকে লন্ডনে পাঠানো হয় তখনো তো আব্বাস উদ্দিন আহমদসহ কেউই তো কিছু বলেননি যে, নজরুলের ঘাড়ে আঘাত হয়েছিল? হয়তো চিকিৎসাটা এবং রিপোর্টও অন্যরকম হতো? হতে পারত। যারা এই জঘন্য কাজে লিপ্ত ছিল তাদের ছিল দু’টি পরিকল্পনা, যদি আঘাতের পর কবি বেঁচে যান তবে অন্যরকম পরিকল্পনায় তারা অগ্রসর হবে। উল্লিখিত তারিখ সহকারে পত্রগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে এটা উঠে আসে যে, ১৯৪২ এর ১২ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পত্রগুলোয় নজরুলের পত্র-লেখাতে তেমন কিছু অসংলগ্নতা খুব একটা নেই।

ড. ইসরাইল খান-এর গ্রন্থ ‘কবি নজরুলের অসুস্থতা-তর্ক-বিতর্ক ও দলিলপত্রে’ পাওয়া যায় ২৭-০২-১৯৪৪ তারিখে কবি লিখিত দু’টি ছোট্ট কবিতা উল্লেখ করা আছে, কয়েকজন ছাত্রীর ইচ্ছায় সাড়া দিয়ে কবি রচেন ‘তোমরা সকলে পুষ্পাঞ্জলির মত দেখিতে সুন্দর/তোমরা সকলে আরো সুন্দর হও, হও আনন্দিতা মনোহর/তোমরা আমাদের মাঝে মাঝে দেখিতে এসো,/তোমরা আমাদের পরম আত্মীয়ের (মতো) ভালোবেসো,/আল্লাহ্্ তোমাদের চিরঞ্জীব করে রাখুখ/আল্লাহ্ তোমাদের ফিরদৌস আলায় নসীব করে থাকু।’ ঘটনার ১৯ মাস পর কবির এমন একটা কবিতা পাওয়া যায়, যা তিনি ২৭-০২-১৯৪৪ এ রচেন। ঘটনার  পর দিন (কারণ ঘটনাটি ঘটে ০৯ জুলাই ১৯৪২ গভীর রাতে) পর সূফী জুলফিকার হায়দারের একটি পত্র থেকে উল্লেখ করছি, তিনি বিছানায় পড়ে রয়েছেন। প্রথমেই আমি লক্ষ্য করলাম তার ডান হাটা কাঁপছে, কখনো কিছু বেশি কখনো বা কম। আমাকে দেখেই তিনি হাত দু’টো বাড়িয়ে কাছে টেনে নেন। তারপর বললেন, তুমি এসেছো। 

কী আশ্চর্য। এতো কাজীদার স্বাভাবিক স্বর-ধ্বনি নয়। তাহলে জিহ্বায় আড়ষ্টতা দেখা দিয়েছে।’

এখানে সামান্য ২/৪ লাইন আক্ষেপি মনে বলতে চাই এই প্রচ- আঘাতের ঘটনাটি আলবৎ ঘটেছে কিন্তু কারো তরফ থেকে উল্লেখ নেই কেন? ১৯৪৪ এর চিঠি ঘটনার পরেও চিঠি গুলোতে মনে হয় নজরুল সুচিকিৎসায় থাকলে সুস্থ হতেন, এটা বলা যায়। কিন্তু নজরুলের ঘরেও তো গিরিবালা ছিলেন, তিনি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন, কিন্তু কেন? পানের মধ্যে সিঁদূর মিশালে দারুন ক্ষতি হয়, তাহলে কি নজরুলের উপর পান-সিঁদুর এবং ভুল ওষুধ চিকিৎসা নজরুলকে স্থায়ীভাবে অসুস্থ করার দিকেই নজরুল অসুস্থতার কারণ? তবে যাইহোক, নজরুল অসুস্থতার কারণ প্রথমে প্রচ- আঘাত এবং এরপরে এ কারণে ওষুধ-পথ্য-চিকিৎসা করা হয়। নজরুলকে ভালো করার লক্ষ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা হলে নজরুল সুস্থ হতেন, এটাই আমার কাছে মনে হয়। নজরুলের অসুস্থতার তিনটি কারণ নির্ণয় করা যায়,

প্রথম এবং মূল- আঘাত

দ্বিতীয় : পানের সাথে সিঁদুর মিশ্রণ

তৃতীয় : উদ্দেশ্যমূলক চিকিৎসা।

হয়তো কেউ বলবেন, নজরুলের পরিবার থেকে তো আঘাত নিয়ে কোন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেনি/কিংবা কোন পত্রিকা কিংবা সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি থেকে কোন মন্তব্য, প্রতিবাদ হয়নি? ঘটনাটি ঘটে গভীর রাতে। ঘটনার পর পরই চক্রান্তকারীরা দ্রুত নজরুলকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারে সম্ভবত চিকিৎসার জন্য নয়, আড়াল করার জন্যে এবং ব্যবস্থা এমনই হয়তো তৈরি করেছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে সিরিয়াস বলে ভিজিটরদের দেখা-সাক্ষাতে অনুমতি নেই? আর যারা এতনি¤œ জঘন্য কাজ করতে পারে তাদের কাছে ঘটনা লুকোনো বা আড়াল করা কোন কঠিন কিছুই নয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, একে ফজলুল হক তখন কলকাতায় এবং শ্যামা হক মন্ত্রিসভার একজন ক্ষমতাধর মন্ত্রী, তারও কি কিছুই করার ছিল না? এটা নিশ্চিত যে কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি বা মহল এই জঘন্য ঘটনার নেপথ্যে ছিল। বাতাসে গুঞ্জন বয়ে চলে কোন এক জনপ্রিয় চিত্রনায়কের নাম? ডা. বিধান নজরুলের চিকিৎসায় সে সময় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি হয়তো সুযোগের সদ্ব্যবহার করে থাকতে পারেন, প্রেসক্রিপশন তো তিনিই করতেন। কোন ওষুধের কি প্রতিক্রিয়া তাও তার জ্ঞানের সীমানাতেই ছিল। কারণ তিনিই এক সময় কলকাতা বেতারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘ডেস্ট্রয় অল দ্য ইসলামিক সংঘ এন্ড ওয়ার্কস অব কাজী নজরুল ইসলাম’। আর এমন সুযোগে নজরুলকে ডেস্ট্রয় করতে সুযোগ গ্রহণ করবেন না, তাকি করে হয়? নজরুলের আপনজনরা এত উদাস ছিলেন যে, এমন ঘটনাটি নিয়ে সামান্য টু শব্দটি পর্যন্ত করেননি?

নজরুল অসুস্থ হওয়ার তিনটি কারণ যা আমি উল্লেখ করেছি, তার মধ্যে ‘আঘাত’ বিষয়টি অসুস্থতার সূত্রপাত এটা নিশ্চিত। দ্বিতীয় পানের সাথে সিঁদুর মিশ্রণ- সহজেই অনুমিত হয় যে কাজটি নজরুল-শ্বাশুড়ি গিরিবালা দেবীই করেছেন এটা নিশ্চিত করা যেতে পারে, কারণ নজরুল ইসলামী গান লিখতেন। এতে তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন। ঘাড়ের আঘাতে নজরুল এমনিই অসুস্থ। এ অবস্থায় পানের সাথে (নজরুল পান খেতেন) সিঁদুর মিশ্রণ করা কঠিন কোন বিষয় ছিল না। হয়তো বা এমন কাজটি করার পরই গিরিবালা দেবী উধাও হয়ে যান-সুদৃঢ় ভাবনায় আসতেই পারে? কিংবা বরদাচরণ মজুমদার-এর ‘নাম’ যুক্ত হতেই পারে, কারণ তিনিও কবির চিকিৎসায় সদাই নিয়োজিত হতেন। আর নজরুলের ওষুধ যারা প্রেসক্রাইভ করতেন তাও কি খুব সঠিক ছিল? কারণ এখানে ছিলেন ডা. বিধান রায়, যিনি নজরুলের সমস্ত ইসলামী কর্ম এবং সঙ্গীতগুলো ধ্বংস করতে অলিখিত নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর এভাবেই একজন বিশ্বসেরা কবি’র মর্মন্তুদ বিদায় বিশ্ববাসী নীরবে প্রত্যক্ষ করল। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ