শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বাংলাদেশে উন্মুক্ত শিক্ষায় নারী

আখতার হামিদ খান : শিক্ষাকে এদেশের আপামর জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে ১৯৯২ সালে আইন পাসের মাধ্যমে উন্মেষ ঘটে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের। দেশের যেকোন আর্থ-সামাজিক অবস্থার এবং যে কোন সময়ের জনগণ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে প্রচলিত শিক্ষার বাইরেও শিক্ষিত হয়ে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারেন। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে বর্তমানে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় উন্মুক্ত শিক্ষার সকল সুযোগ করে দিতে পারছে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি প্রোগ্রামে আজ অবধি প্রায় দু’লাখ ৭৫ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমে। অনেকে ইতোমধ্যে কৃতকার্য হয়ে নিজ কর্মসংস্থান করে নিয়েছেন। অনেকেরই পেশাগত উন্নতি হয়েছে এবং আরও অনেকেই বর্তমানে এ পদ্ধতিতে লেখাপড়া শিখছেন ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের আশায়।
বর্তমানে এদেশে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন লোকের হার প্রায় ৫৭ শতাংশ। তবে এ কথা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে মৌলিক দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষিতের হাত বর্তমানে ৪৪.৩%। যেখানে পুরুষ শিক্ষার হার ৫০.৪% সেখানে নারী শিক্ষার হার ২৮.৫%। গ্রামে এই অবস্থা আরও নি¤œমুখী। গ্রামে শিক্ষার হার ৩৬.৬% এবং শহরে ৬৩.০%। শিক্ষার এ সুযোগ উন্মুক্ত হওয়ায় বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারী সমাজের অংশগ্রহণ কতটা আশাব্যঞ্জক তা প্রতিফলিত হয়েছে অতি সম্প্রতি পরিচালিত এক জরিপে। জরিপে কিছু নারী মুখের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা একই সাথে সংগ্রামী, পেশাজীবী এবং সামাজিক সুবিধা বঞ্চিত। এমন কিছু সংগ্রামী নারীই এই প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য। আমরা রাস্তার পাশে ইট ভাঙছেন এমন বহু নারী দেখি। দেখি গার্মেন্টস শ্রমিক, শহরে বাসাবাড়িতে কর্মরত নারী ফুটপাত হোটেল চালানো, পানওয়ালা, হকার নারীও দেখি। এদের কারও কারও ব্যক্তিগত জীবন হয়ত বা সুন্দর অথবা কারও ব্যক্তিগত জীবন নেই। এছাাড়ও সমাজে এমন কিছু নারীও আছেন যাদের অস্তিত্ব রক্ষার পেছনে বাবা, স্বামী, ভাই বা পুত্র এদের কারও সাহায্য নেই। এরা একাই লড়ছেন, নিজেদের ভাঙছেন, গড়ছেন এবং সমাজে টিকেও থাকছেন।
তথ্যচিত্র : এক
সুরমা বেগম, বয়স চল্লিশ। তিনি চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টে প্রায় এক যুগ ধরে সময় রক্ষক পদে কর্মরত। যখন তিনি এই চাকরিতে যোগদান করেন তখনও এস.এস.সি পাস করেননি। কিন্তু সে সময় তাকে শুধু পেটের দায়ে এবং দুটো সন্তানকে বাঁচানোর তাগিদে এই চাকরিতে যোগদান করতে হয়েছিল। সুরমা বেগম কথোপকথনে এক পর্যায়ে জানালেন যে, তার স্বামী প্রায় ১২ বছর আগে তাকে ত্যাগ করে চলে গেছেন। উপয়ান্তর না দেখে তার এই চাকরিতে যোগদান। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি পত্রিকাতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে পেরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কেন্দ্রে দেখা করেন এবং চট্টগ্রামে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নির্ধারিত কেন্দ্রে এস.এস.সি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে যান। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথানুযায়ী কেবল শুক্রবারে ক্লাস এবং পরীক্ষা অনুষ্ঠানের বিধান থাকায় তার পক্ষে ক্লাস- এ অংশগ্রহণ এবং পরীক্ষা দেখা সম্ভব হয়। নিয়মিত পড়াশুনা ছাড়া পাস করা সম্ভব নয় কারণ প্রতিমাসে শুধু ২টি টিউটোরিয়াল সার্ভিস দেয়া হয়, তাই সুরমা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। পড়াশুনার সুবিধার্থে তিনি অফিস থেকে ঋণ নিয়ে টেবিল চেয়ার কেনেন, বিদ্যুৎ বিভ্রাট পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটায় তাই তিনি কেনেন একটি চার্জার। একাকী নারীর জীবনে সংসারের সমুদয় কাজই তাকে করতে হয়,তাই ঝামেলাও সইতে হয় বেশি। প্রতিদিন অফিস করে কাঁচা বাজার কা পড়াশুনা সময়ের অপচয় ঘটায়। তাই তিনি সে ঋণ নিয়ে কিস্তিতে কেনেন একটি ছোটখানো ফ্রিজ।
এভাবে চাকরি, সংসার এবং বাচ্চাদের দেখে সুরমা লেখাপড়া চালিয়ে যান। তিনি নিয়মিত ক্লাস করেছেন, পরীক্ষা দিয়েছেন এবং দ্বিতীয় বিভাগে এস.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। ছেলে মেয়ে দু’টোও পড়াশুনা করে। মেয়েটি কলেজে বি.এ এবং ছেলেটি এইচ.এস.সিতে অধ্যয়নরত। তিনি বাউবিতে এসেছেন তার সনদপত্র সংগ্রহ করতে। আমি তাকে দেখে চমকিত হই, আমার ভাবনার পেন্ডুলাম এদিক-ওদিক দোল খায়। একজন ছিমছাম নারী। মনে হয় না ছোটখাটো চাকরি আমি আপনাদের এইচ.এস.সি প্রোগ্রামে ভর্তি হব। লেখাপড়া করবো। আপা আপনাদের এখানে পড়তে তো বয়সের কোন বাধা নেই, কেবল প্রয়োজন চেষ্টায়। হাতে কি? প্রশ্ন করতে হেসে বলেন বোরকা, কেন? আবার হেসে বলেন, বোরকা পরে স্বামীকে খোঁজ করবো। যে আমাকে ফেলে গেল, তাকে আমার প্রয়োজন নেই আর্থিক বা অন্য কোন কারণে। কিন্তু সামাজিক কারণে তাকে আমার প্রয়োজন। কারণ আশপাশের মানুষের কৌতুহলী দৃষ্টি থেকে পরিত্রাণের জন্য তাকে প্রয়োজন। কারণ আশপাশের মানুষের কৌতুহলী দৃষ্টি থেকে পরিত্রাণের জন্য তাকে প্রয়োজন। আমি বললাম কি লাভ? যে দায়িত্ব জ্ঞানহীন স্বামী ১২ বছর আগে আপনাকে, বাচ্চা দু’টোকে অবহেলা ভরে ফেলে গেছে তাঁজে খোঁজ করার কি কোন প্রয়োজন আছে? উত্তরে তিনি নিশ্চুপ থাকেন। আমি বলি শুনুন- নারীকে একা দেখলে (এদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণেই) অনেকেই কৌতূহলী হন, কেউ সমবেদনা, কেউ স্থল উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই এহেন আচরণ করেন। এ ক্ষেত্রে আপনার প্রয়োজন কিছুটা ধৈর্য এবং বাড়তি সহ্যশক্তির। সময়ে সবাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সুরমা উঠে দাঁড়ালেন, ধীরে ধীরে আমার রুম থেকে বের হয়ে গেলেন, আমার দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করলো যতটা তাকে দেখা যায় ততটাই। বাতাসে রুমের ক্যালেন্ডার দুলে উঠল।
তথ্যচিত্র: দুই
রেহানা খাতুন, বয়স ৩৫। দুই সন্তানের জননী। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি শাখায় এম. এল.এস.এস.এস পদে কর্মরত। একমাত্র এই আয়েই তিনি তার পরিবারের ভরণ-পোষণ করেন। ছেলে দু’জনের একজন প্রাইমারি লেভেলে পড়াশুনা করছে এবং অন্যটি ছোট, বয়স ৩ বছর। পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রেহানার যখন বিয়ে হয় তখন তিনি শুধু প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করেছেন। আরও পড়ার ইচ্ছা থাকলেও বাবার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তিনি আর লেখাপড়া করতে পারেননি, দু’সন্তানের জন্মের পর যখন দুর্ভাগ্যক্রমে তার স্বামীর মৃত্যু হয়, তখন তার ছেলে দুটো নিয়ে বাঁচার কোন উপায়ই ছিল না। সেই দু:সময়ে তার বর্তমান চাকরিদাতা তাকে স্বামীর স্থলাভিষিক্ত করে একই পদে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু স্বল্প আয়ে রেহানা কিছুতেই তার বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বাড়ি ভাড়া দিয়ে তিন বেলার অন্নসংস্থান করতে পারছিলেন না। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ালো যে, একদিকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার যেমন কোন সুযোগ তার ছিল না, অন্যেিদক তার কোন ডিগ্রী না থাকাতে কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভবনা ছিল না। এই সংকটময় মুহূর্তেই রেহানা বাউবি সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি তার স্বল্প আয় থেকে কিছু টাকা সঞ্চয় করে নির্দিষ্ট সময়ে পত্রিকায় ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস.এস.সি প্রোগ্রামেও ভর্তি হয়েছে, ইচ্ছে আছে এই প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে পেশাগত উৎকর্ষতা অর্জনের। রেহানার চোখেও আগামী দিনের সোনালী স্বপ্ন দোল খায়। রেহানা সনদপত্র সংগ্রহ করে চলে যান। আমি হই তার স্বপ্নের সহযাত্রী।
তথ্যচিত্র: তিন
সুফিয়া বেগম, বয়স ৪৫। অনেক দিন আগে স্বামীর সঙ্গে বিবাহিত জীবনের বিচ্ছেদ ঘটেছে। দু’সন্তানের জননী। তার প্রথম সন্তান মেয়ে বি.কম পরীক্ষার্থী, ছোট ছেলে একটি কলেজে পড়াশুনা করছে। সুফিয়া তার বিয়ের আগেই এইচ.এস.সি এবং বি.এ. পাস করেছিলেন। বিবাহিত জীবনে স্বামীর সংসার, সন্তান এসব সামলে তিনি কিছুতেই পড়াশুনার জন্য সময়-সুযোগ করতে পারেননি বলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তার পড়াশুনার কোন অগ্রগতি হয়নি। যখন তার স্বামী তাকে পরিত্যাগ করে, তখন চিরাচরিত নিয়মে বাপের বাড়িতে দু’সন্তান নিয়ে ফিরে আসা ছাড়া তার অন্য কোন উপায় ছিল না। কিন্তু একজন ভাগ্য বিড়ম্বিতা মানুষ হিসেবে বাবার বাড়িতে তিনি কখনই স্বস্তিবোধ করতেন না। প্রশ্ন করি কেন? বাবার পরিবারে কি আপনার কোন অধিকার নেই? উত্তরে সুফিয়া বলেন, আপা যখন কোন মেয়ের বিবাহিত জীবন ভেঙে যায় তখন সে বাবার বাড়ি কেন, কোথাও সে পরনির্ভর অবস্থায় স্বস্তি পায় না, পেতে পারে না। বাবা-মার সঙ্গে থাকা অবস্থাতেই তিনি একদিন বাউবি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং পুনরায় পড়াশুনা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বাউবির বিএড প্রোগ্রামে ভর্তি হন। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, জীবনের ঘাত প্রতিঘাতকে মোকাবেলা করেই তিনি নিয়মিত পড়াশুনা করে প্রথম সিমেস্টারে গ্রেড এ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু পরবর্তী ঝবসবংঃবৎ গুলোতে তিনি ততটা কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। কেন তিনি পড়াশুনার পূর্বে মান ধরে রাখতে পারেননি, জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, আমার পারিবরিক বিপর্যয় যেটা আমার এই একাকী জীবনের মূল তার ফলে সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক চাপই আমার মানসিক বিপর্যয়ের কারণ, যার প্রভাব পড়ে আমার প্রদেয় পরবর্তী পরীক্ষাসমূহে। তবুও সুফিয়া যথেষ্ট আশাবাদী যে, তিনি পরবর্তী সিমিস্টারে ভাল করবেন। সুফিয়ার বিশ্বাস তিনি বি.এড পাস করে অবশ্যই একটি চাকরি যোগাড় করতে পারবেন, যেটা তাকে নিজের পায়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার সুযোগ করে দেবে। পরবর্তীতে তিনি বাউবি থেকে এম.এড কোর্স করারও আশা রাখেন। আমিও সুফিয়ার সঙ্গে আশাবাদী হয়ে স্বপ্ন দেখি যে সুফিয়া আত্মমর্যাদা নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন।
তথ্যচিত্র: চার
ফাইল-পত্র গুছিয়ে দ্রুত নিজের রুমে প্রবেশ করার সময় এক মহিলার ডাক শুনতে পেলাম, আপা একটু দাঁড়ান তার দিকে তাকই। একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা মুখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু চোখ দুটো অসম্ভব উজ্জ্বল। অনীতা রোজিরিও, বয়স ৪৭। পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্বামী এবং দু’জন ছেলেমেয়েসহ চারজনের পরিবার তার উপার্জনেই পরিচালিত হচ্ছে। অনীতা বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনার এক প্রকল্পে ব্লক সুপারভাইজার পদে কাজ করছেন। তিনি বর্তমানে যা আয় করছেন (সর্বসাকূল্যে ৩৫০০/-) তার পরিবারে ভরণ পোষণ, বাসস্থান এবং শিক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। ঘরে অক্ষম এবং বেকার স্বামী, কলেজ পড়–য়া দু’ছেলে মেয়ে এদের নিয়ে জীবন যখন এক্কেবারে পর্যন্ত অবস্থায় পতিত তখন অনীতা বুঝতে পারেন যে লেখাপড়া এবং উচ্চতর ডিগ্রী ছাড়া তারপক্ষে পেশাগত শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়াশুনা সুযোগ পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। তাই তার মাঝে বেঁচে থাকার আগ্রহ, উৎসাহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। এমতাবস্থায় একদিন এক সহকর্মীর কাছেই তিনি বাউবি সম্পর্কে জানতে পারেন। জানতে পারেন যে এখানে পড়াশুনা করতে হলে বয়সের কোন বাধাই বাধা নয়, প্রয়োজন কেবল একাগ্রতা এবং ঐকান্তিক চেষ্টার। বাউবি তার সম্মুখে সম্ভাবনার নতুন দরোজা খুলে দেয়। অনীতা বাউবির এস.এস.সি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে যান। তিনি প্রথম পর্ব কৃতিত্বের সঙ্গেই সম্পন্ন করেন। ২য় বর্ষ পরীক্ষার পূর্বে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবুও তিনি ২য় বর্ষের চারটি বিষয়েই পরীক্ষা দেন। তিনি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ৫ম বিষয়টি পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরেতার গল-ব্লাডার অপারেশন হয়ে। আমার সঙ্গে অনীতা যখন কথা বলছিলেন তখনও তিনি বেশ দুর্বল। এসেছেন বাউবিতে খোঁজ নিতে যে পুন:পরীক্ষা দেয়ার কোন সুযোগ আছে কি-না। আমি হ্যাঁ সূচক উত্তর করতেই তার চোখে মুখে উপচানো ঢেউয়ের মতই আনন্দ ছলকে উঠলো। কাল বিলম্ব না করেই ছুটলো ব্যাংকে পুনঃপরীক্ষা ফি জমা দিতে। যাতে করে সহজইে তিনি ২য় বর্ষ পাস করে যেতে পারেন। যাওয়ার আগে অনীতা জানিয়ে গেলেন আপা, স্বল্প আয়ের সংসার। ছেলেমেয়ে দু’টোকে লেখাপড়া করানো ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করাতে পারছি না তবুও মেয়েটাকে ঢাকায় একটি কলেজে পড়াচ্ছি আমার বোনের সাহায্য নিয়ে। ছেলেটি কলেজে ভর্তি হয়েও পড়াশুনা করতে পারছে না আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। আর আমিও বুঝি আপা বর্তমানে মেয়েদের জন্য পড়াশুনা অত্যন্ত জরুরি। তাই ভাবচি ছেলেকে যেহেতু পড়াতে পারিনি, তাকে কোথাও কাজের ব্যবস্থা করে দেব। মেয়েটি তার মাসীর কাছ থেকে পড়াশুনা করুক যতটা সম্ভব হয়। ইতোমধ্যে আমি পাস করে গেলে হয়ত আমার কিছুটা বেতন বাড়বে, আমি হয়ত পরিবারকে আরও বেশি সাহায্য করতে পারবো, অনীতা এই আশা করেন। আপা যাই বলতে, আমি উঠে দাঁড়াই। অসুস্থ অনীতাকে খানিকটা এগিয়ে দেই।
তথ্যচিত্র: পাঁচ
বছর উনিশের টগবগে তরুণী মীনা রহমান। বাবা-মা নেই। সবার ছোট ভাইটিকে নিয়ে একা থাকেন। ভাইটি একটি দোকানে সেলস্ম্যান এ চাকরি করেন। আপনার অন্য কেউ নেই? জিজ্ঞেস করতেই উচ্ছল তরুণীর মুখে বিষাদের ছায়া উঁকি দেয়। উনারা প্রত্যেকেই নিজে পরিবার নিয়ে আলাদা থাকেন। আমাদের দায়িত্ব কেউ নিতে না চাওয়ায় আমরা দু’ভাই বোন একা বাঁচার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনাদের কি করে চলে? উত্তরে মীনা জানালেন আমি একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি। কিন্তু আপা এসব জায়গায় চাকরিতে ইংলিশ বলা এবং লেখার উপর বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়। একদিন অফিসেই মীনা পত্রিকায় বাউবির সেল্প প্রোগ্রামের সম্পর্কে জানতে পারেন এবং নির্ধারিত সময়ে গিয়ে একটি কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে যান। প্রোগ্রামের কোর্স ফী সংগ্রহ করতে মীনা দু’টো টিউশনী যোগাড় করে নেন। মীনা বাউবি এর নির্ধারিত করতে মীনা দু’টো টিউশনী যোগাড় ভর্তি হয়ে যান। মীনা বাউবি এর নির্ধারিত কেন্দ্রে টিউটোরিয়াল ক্লাস এ অংশগ্রহণ করেন। মীনার প্রত্যাশা তিনি কৃতিত্বের সঙ্গেই পাস করবেন। মীনা কথোপকথনের এক পর্যায়ে বলেন আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ যে অন্তত আমাদের মত সাধারণ মানুষের জন্যও স্বল্প খরচে পড়াশুনার সুযোগ রয়েছে। যেটা আমাদের মত মানুষের ক্যারিয়ার তৈরিতে সাহায্য করবে। মীনার প্রত্যাশা তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করে বাউবির বেল্ট প্রোগ্রামে ভর্তি হবেন, পাস করে কোন স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকতা করার চেষ্টা করবেন। মীনার আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে আমিও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠি। ভাবি আমাদের সমাজে অনেক মহিলাই আছেন যারা পারিপার্শ্বিকতার চাপে নিজেদের মানুষ ভাবার মত মানসিক শক্তিও পান না, বাউবির শিক্ষা হয়ত অচীরেই তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াবার মত দৃঢ়প্রত্যয়ী করে তুলবে। নতুনভাবে বাঁচতে শেখাবে। তাদের ইচ্ছেকে লক্ষ্যে দেয়াই হোক আমাদের কর্তব্য।
বাংলাদেশের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে গণমানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিভিন্ন সমস্যা এবং প্রতিকূলতার কারণে বর্তমানে আমরা গণমানুষকে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে হয়ত ততটা সফল হতে পারছি না। তবে দেশের দূরশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটি একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেটি সমাজের যে কোন অবস্থানের, বয়সের পেশাজীবী, শ্রমজীবী অথবা বেকার মানুষকে শিক্ষিত করে দক্ষ জনগোষ্ঠী সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উদ্দেশ্য যেহেতু বাস্তব ও মহৎ সেহেতু কাংখিত লক্ষ্যে অচিরেই আমরা পৌঁছে যাব। প্রয়োজন কেবল সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার।
আমি এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে দেশের কোন শ্রেণীর মানুষ উন্মুক্ত শিক্ষায় এগিয়ে আসছেন। বিষয়টি নিয়ে জরিপ করতে গিয়েই কিছু মানুষের সন্ধান পাই যারা সমাজে বঞ্চিত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী একটি অংশ। যারা নীরবে নিভৃতে নিজেকে গড়ে নিয়ে সমাজের উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে নিজের ও দেশের উন্নয়নকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার সততই সচেষ্ট। হাজাও সমস্যা পঙ্কিলতা, সমালোচনাকে তীব্র ভ্রুকুটি হেনে যারা সীমিত শিক্ষার সুযোগ ব্যবহার করে নিজেদের গড়ছেন, তাদের সঙ্গে আমার সততই পথচলা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ