শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাকে হার মানিয়ে কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য আহরণে অভাবনীয় সাফল্য

রাঙামাটি থেকে আনোয়ার আল হক : প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও চলতি অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে কাপ্তাই হ্রদ থেকে মৎস্য আহরণ ও রাজস্ব আয়ের হার অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করায় হ্রদ ঘিরে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে পার্বত্যবাসীর মনে। বিএফডিসির স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনা, অবৈধ মাছ আহরণ-বিপণন ও প্রজণনে বর্তমান হ্রদ ব্যবস্থাপকের সাহসী পদক্ষেপ এবং গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর কারণেই এই সাফল্য এসেছে বলে মত প্রকাশ করেছে সাধারণ জেলে ও মৎসজীবীরা। তারা জানায়, কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির অর্ধ শতাব্দি পর হ্রদ ব্যবস্থাপনায় নতুনত্ব আসার প্রেক্ষাপটে এই হ্রদ ঘিরে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য সম্পদ থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব অর্জনের পথ উন্মুক্ত হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল।
বিএফডিসি সূত্রে জানা গেছে, দেশে মিঠা পানির মাছের অন্যতম আধার এই কৃত্রিম জলাশয়ে এবছর বিগত বছরের চেয়ে অন্তত এককোটি টাকা বেশি অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতে চলেছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, রাঙামাটি বিএফডিসিতে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হচ্ছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাশয় কাপ্তাই হ্রদের ইতিহাসে রাজস্ব আয়ের এই হার হবে গত অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ। মৎস্য ব্যবস্থাপনায় বিএফডিসি কর্তৃক বিভিন্ন কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে হ্রদের মৎস্য উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যেই বিগত কয়েক বছরের অতীত রেকর্ড অতিক্রম করেছে কাপ্তাই হ্রদের সার্বিক চিত্র।
১৯৬০ এর দশকে স্বল্পমূল্যে জলবিদ্যুৎ সৃষ্টির লক্ষে কর্ণফুলি নদীর উপর বাঁধ দিয়ে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সৃষ্টি করা হলে সৃষ্টি হয় কাপ্তাই হ্রদ। ৫৪ হাজার হেক্টর কৃষি জমি গিলে খাওয়া তথা ১,৭২২ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই হ্রদের অন্যান্য লক্ষ্য ছিল মিঠাপানির মাছের উৎস্য সৃষ্টি তথা দেশের পুষ্টির চাহিদার যোগান এবং দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে পানিপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার সৃষ্টি করা। হ্রদের মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনকে (বিএফডিসি)। কিন্তু বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণে হ্রদ থেকে মাছ আহরণের হার এবং উৎপাদন ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিএফডিসি ব্যবস্থাপনায় মৎস্য প্রজনন মৌসুমে অবৈধ মৎস্য আহরণ ও পাচার রোধ, মৎস্য আইন বাস্তবায়ন, কার্প জাতীয় মাছের পোনা অবমুক্তি এবং অভয়াশ্রমে কার্যকর ব্যবস্থাপনার ফলেই এমন সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। অথচ হ্রদ সৃষ্টির পর  কয়েক বছরের সাফল্যের ধারাবাহিকতাকে ব্যাহত করে বিগত কয়েক বছর এই হ্রদে মৎস্য উৎপাদন ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আশানরূপ সাফল্য না থাকায় হতাশ হয়ে পড়েছিল স্থানীয় প্রশাসন, মৎস্যজীবী ও সরকারের উর্ধ্বতন মহল। সূত্রমতে এবছর সাফল্যের যে ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হয়েছে, তা আরো স্পষ্ট হতো যদি না বিগত মওসুমে পাহাড় ধসের মতো বিপর্যয় বা কাপ্তাই বাঁধে পানি অপসারণের হার নিয়ে টানাপোড়ন সৃষ্টি না হতো। মৎস্যজীবীরা জানায় পাহাড় ধসের কারণে হ্রদের পানিতে যে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা দেখা দিয়েছে; তথা জেলেদের জাল প্রক্ষেপনে স্রোতের যে প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাতে সকলেই মনে করেছিল এবার মাছ ব্যবসা লাটে উঠবে। কিন্তু সকলের ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে রাজস্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো বেশি ওজনের কার্প জাতীয় মাছের বৃদ্ধি এবং বিপণন ব্যবস্থায় দুর্নীতি অপনোদন।
মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চলতি মৌসুমের শুরুতে তারা হ্রদে মাত্র এক দশমাংশ জাল ফেলতে সক্ষম হন। এছাড়াও হ্রদের পানির উচ্চতা স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে কাপ্তাই জল বিদ্যুত কেন্দ্রে স্পিল ওয়ে সমূহ খোলা রাখা হয় এবং এতে করে হ্রদের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাছ স্পিল ওয়ে দিয়ে বাহির হয়ে গিয়ে হ্রদে উৎপাদিত মাছের পরিমাণ কমে যায়। তাছাড়া ভূমি ধসের কারণে পাহাড় ধসে গিয়ে সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যপক ক্ষতি সাধিত হয় এবং রাঙামাটি জেলা সড়ক পথে সারা দেশ হতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। পরবর্তীতে প্রশাসনের সহায়তায় দ্রুত যান চলালের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও নিরাপত্তার স্বার্থে ০১-১.৫ টন এর অধিক ক্ষমাতা সম্পন্ন গাড়ি চলাচলের অনুমতি প্রদান করা হয়নি এবং রাত ০৮.০০ ঘটিকার পর হতে সকল প্রকার গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। যা ২২ আগস্ট ২০১৭ খ্রি. পর্যন্ত বলবৎ ছিল। বিগত বছরে ভয়াবহ পাহাড় ধসে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি সাধনের পাশাপাশি হ্রদ বেষ্টিত রাঙামাটির নানা এলাকায় পাহাড় ধসের মাটিগুলোর সবগুলোই কাপ্তাই হ্রদের পানিতে পড়ে হ্রদের তলদেশ অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে। এমতাস্থায় হ্রদের নির্দিষ্ট একটি স্তরে বাসকরা মাছগুলোর একটি প্রজন্ম অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে যায়। একারণে বিগত পাহাড় ধসের পর থেকে প্রায় তিন মাস পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য আহরণের সাথে জড়িত জেলেদের একটি বড় অংশ মাছ আহরণ করতে পারেনি। ফলে উক্ত সময়ে আহরিত মৎস্যের স্বাভবিক বিপণন কাজ ব্যহত হয় এবং ব্যবসায়ীগণ পরিস্থিতির বিবেচনায় তুলনামূলক কম মৎস্য বিপণন করতে বাধ্য হন। এতোকিছুর পরেও বর্তমান সময়ে কাপ্তাই হ্রদের বিগত বছরগুলোর তুলনায় বিপুল পরিমাণ মাছ আহরিত হচ্ছে। কারণ হিসেবে জেলেরা জানিয়েছেন, বিগত বছরে গণহারে সৃষ্ট অবৈধ ঝাঁক অপসারণ, কঠোর নজরদারি, ব্যবসায়ী ও জেলেদের মধ্যে সচেতনাবৃদ্ধি করায় তদুপরি তাদের সার্বিক সহযোগিতার ফলে মাছ আহরণ বন্ধ মৌসুমে মা মাছ নির্ঝঞ্জাটে ডিম ছেড়েছে কাপ্তাই হ্রদে। এতে করে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি পরিমাণে বড় বড় মাছ বিশেষ করে রুই, কাতাল, মৃগেল, কালিবাউস, চিতল, বোয়াল, বাচা-পাবদাসহ ছয় ইঞ্চিরও বেশি পরিমাপের চাপিলা মাছ ধরা পড়ছে জালে।
স্থানীয় মৎস্যজীবী, ব্যবসায়ীসহ বিএফডিসি’র সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বর্তমান সময়ে কাপ্তাই হ্রদ থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ মেট্রিক টন মাছ আহরিত হলেও রাঙামাটি বিএফডিসি তথা মৎস্য অবতরণ ঘাটে মাছ আসছে গড়ে ১৮ থেকে ২০ মেট্রিক টন। বাকি মাছ গুলো স্থানীয় বাজারসহ নানা স্থান দিয়ে অন্যত্র পাচার হয়ে যাচ্ছে। এতে করে স্থানীয় বাসিন্দারা স্বল্পমূল্যে মাছ সংগ্রহ করতে পারছে এবং অত্রাঞ্চলে আগত পর্যটকরাও কাপ্তাই হ্রদের মাছগুলোর স্বাদ গ্রহণ করতে পারছে সাধ সাধ্যের মধ্যেই।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি)র রাঙামাটি কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক নৌ-বাহিনীর কমান্ডার মোঃ আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, এছর রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে অন্যান্য বছরের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আয় হবে। তিনি বলেন, নানা প্রতিকূলতা ও বৈরি পরিবেশের মধ্যেও সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়  সময়োগযোগী পদক্ষেপের কারনেই এই সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। তিনি জানান, আমাদের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থ বছরে কাপ্তাই হ্রদ থেকে অন্তত দ্বিগুণ পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। কারণ হিসেবে কমান্ডার আসাদ উল্লেখ করেন, বিগত বছরগুলোতে আমরা দেশের সমতল এলাকা থেকে কার্প জাতীয় মাছের পোনা সংগ্রহ করে রাঙামাটিতে এনে কাপ্তাই হ্রদে অবমুক্ত করতাম। এতে করে প্রায় সময় পোনার একটি অংশ পরিবহনেই মারা যেত, আবার আরেকটি অংশ হ্রদের পানিতে অবমুক্তের কয়েকদিনের মধ্যেই মরে ভেসে উঠতো। সেই বিষয়টি সার্বিকভাবে অনুধাবন করেই সরকার রাঙামাটিতে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে পোনা উৎপাদন কেন্দ্র তথা পূর্ণাঙ্গ হ্যাচারি স্থাপন করেছে। জেলা লংগদু উপজেলাধীন মারিশ্যাচর এলাকায় স্থাপিত এই হ্যাচারিতে দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদনের ইতিমধ্যেই আমরা আশানুরূপ সফলতা অর্জন করেছি। এই হ্যাচারীর মাধ্যমেই আমরা বর্তমানে বছরে ৬০ মেট্রিক টন মাছের পোনা উৎপাদন করতে পারছি। তিনি বলেন, আমরা বাহির থেকে ক্রয় করে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ মেট্রিকটন পোনা কাপ্তাই হ্রদে অবমুক্ত করলেও এবছর আমাদের নিজস্ব হ্যাচারিতে উৎপাদিত আগের ক্রয়করা গুলোর চেয়ে দ্বিগুণ মাছের পোনা কাপ্তাই হ্রদে অবমুক্ত করবো ইনশাআল্লাহ। তিনি দাবি করেন, আমাদের উৎপাদিত মাছের পোনাগুলো উৎপাদন করা হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদের পানি ব্যবহার করেই। তাই এতে পোনার মৃত্যুর হারও মোটামুটি শূন্যের কৌটায় নেমে আসবে। এই কারণেই সামনের দিনগুলোতে কাপ্তাই হ্রদে মাছের উৎপাদন বর্তমানের চেয়েও অনেকগুণ বেড়ে যাবে এবং সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব আয়ও সম্ভব হবে উল্লেখ করে কমান্ডার আসাদ বলেন কাপ্তাই হ্রদ আমাদের আগামী বছরগুলোতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয়ের হাতছানি দিচ্ছে। বর্তমান ধারাবাহিকতায় রক্ষায় সকলের সম্মিলিত সহযোগিতার কোনো বিকল্প জানিয়ে কাপ্তাই হ্রদের সার্বিক পরিবেশ তথা মৎস্য সম্পদ রক্ষা সকলের সার্বিক সহযোগিতাও কামনা করেছেন তিনি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ