শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

সর্বত্রই শঙ্কা অস্বস্তি

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : চলতি বছর অথবা আগামী বছরের শুরুতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা বছরখানেক আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে এবং বিদেশে নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। অন্যদিকে বিরোধী জোট নির্বাচনী প্রচারণা তো দূরের কথা অনশন পর্যন্ত করতে পাছে না। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে সভা-সমাবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। দলটি মানববন্ধন, অনশন, কালো পতাকা মিছিল এমনকি ঘরোয়া কর্মসূচিও পালন করতে পারছে না। লিফলেট বিতরণেও বাধা দিচ্ছে, গ্রেফতার করছে। দলটির চেয়ারপার্সন ও সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দুদকের একটি হাস্যকর মামলায় কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে বলে বিএনপির নেতারা অভিযোগ করছে। নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার করা হচ্ছে। আরেক বিরোধী দল জামাযাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের অধিকাংশ কার্যালয়ই তালাবদ্ধ। দলটির আমীরসহ সিনিয়র নেতারা কারাগারে। এছাড়া জামায়াত সমর্থিত নেতাকর্মীদের নানা অজুহাতে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশে-বিদেশে সবাই হতাশার মধ্যে আছে। গ্রাম, শহর এমনকি বিদেশী কারো মাঝেও স্বস্তি নেই। সবার মধ্যে একটাই শঙ্কা বিরাজ করছে, আদৌ কি দেশে জাতীয় নির্বাচন হবে? যদি নির্বাচন হয় তাহলে কিভাবে হবে? সংকট সমাধানে কোনো আলোচনা নেই। সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, কূটনৈতিক কারো কথাই সরকার শুনছে না। নির্বাচন ইস্যুতে সৃষ্ট সংকট সমাধানে সরকার সংলাপে বসতে রাজি নয়। অভিজ্ঞ মহল বলছেন, অতীতের কোনো সময়ের সাথেই যেন মিল নেই। নির্বাচনের আগে গোটা দেশে একটি পজেটিভ আমেজ তৈরী হবে। মিছিল-মিটিংয়ে পুরো দেশ উত্তাল থাকবে। কোথাও কাউকে বাধা দেয়া হবে না। কিন্তু কোথাও এমনটি দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষসহ রাজনৈতিক বোদ্ধারা ভাবছেন, সরকার যেভাবে এগুচ্ছে, তাতে দেশে নির্বাচন হ্বার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর যদি হয়ও তাহলে সেটি নিরপেক্ষ হবে না। আবারো ২০১৪ সালের ৫ জানুযারিরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। যেখানে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে অংশ নেবে না।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশে নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। সরকার সারাদেশকে একটি কারাগারে পরিণত করেছে। এখানে বিরোধীদের কথা বলার ন্যূনতম কোনো অধিকার নেই। আমরা সভা-সমাবেশ করতে পারি না। আমাদের নেত্রী কারাগারে। দলের সিনিয়ির নেতাদের মিথ্যা মামলায় আটক রাখা হয়েছে। এখনো প্রতিনিয়ত নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী জনগণের টাকা খরচ করে সরকারি টাকায় নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন। যা সংবিধান পরিপন্থী। নৌকায় ভোট চাওয়া আমার রাজনৈতিক অধিকার- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনৈতিক অধিকার কতটুকু, তা সংবিধান ও নির্বাচন কমিশনের আরপিওতে স্পষ্ট করা আছে। কিন্তু, তিনি ( শেখ হাসিনা) তো সরকারি টাকা খরচ করে নৌকায় ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। আর অন্যরা কোনো সুযোগই পাচ্ছেন না। এটা কখনো মেনে নেয়া যায় না।
দীর্ঘ প্রায় ছয় বছরেরও বেশী সময় ধরে নিরপেক্ষ নির্বাচন ইস্যুতে বিরোধী জোট আন্দোলন করে আসছে। দেশের সুশীল সমাজ এমনকি বিদেশীরা সংকট সমাধানে সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট অবসানে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সরকার এটিকে রাজনৈতিক সঙ্কট বলে মনে করে না। পক্ষান্তরে বিরোধী জোট এটিকে সবচেয়ে গভীর রাজনৈতিক সঙ্কট বলে মনে করে। বিরোধীদের দাবি, এই সঙ্কট সমাধানের জন্য অবিলম্বে সংলাপে বসতে হবে। তার আগে বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে হবে। তাদের এই বক্তব্যের সাথে দেশের সুশীল সমাজসহ বিদেশীরাও একমত। সবাই বলছে, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যত দিন পর্যন্ত প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল দুই বিপরীত মেরুতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত আমরা সমস্যা সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাব না। একটি কার্যকর গণতন্ত্রের সমস্ত বিবদমান ইস্যু শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হয়। শক্তি প্রয়োগ করে সহিংসতার মাধ্যমে হয় না। আলোচনা এবং সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় এই যে, অতি সম্প্রতি সংলাপ এবং শক্তি প্রয়োগের মধ্যে একটি বিভাজন রেখা টানা হচ্ছে। তিনি বলেন, সহিংসতা এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আর রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার নিষ্পত্তি করবে রাজনৈতিক দলসমূহ। আর সেই নিষ্পত্তি হবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সেটি দেখা যাচ্ছে না। এখন সংকট আরো ঘণীভূত হচ্ছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, অ্যামিকাস কিউরি এবং দেশের সাধারণ মানুষের মতামত উপেক্ষা করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে একটি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা, বা অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় অবাধ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান হুমকির মুখে পড়ে। সে কারণে তখন থেকে প্রধান বিরোধী দলসহ আরও অনেক দল নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু সরকারি দল ওই দাবি আমলে না নিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতায় রেখে, সংসদ কার্যকর রেখে, দুর্বল নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ও দলীয়করণকৃত প্রশাসনের অংশগ্রহণে বিরোধীদলীয় বর্জন ও বিরোধিতার মুখে একটি নামকাওয়াস্তের সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সরকার গঠনের পর ওই সরকার এখন পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায়।  গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে একটানা অবরোধ ও উপর্যুপরি হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করে সরকারের ওপর তাদের দাবি মানতে চাপ সৃষ্টি করে। ফলে বিবদমান উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির ফয়সালা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকটটি স্বীকার করেনি। পরিবর্তে, বিষয়টিকে নিছক সহিংসতা আখ্যা দিয়ে বিএনপিকে সহিংসতা সৃষ্টিকারী দল গণ্য করে ওই দলের সঙ্গে সংলাপে অনীহা প্রকাশ জানিয়ে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট দমনের ভুল নীতি গ্রহণ করেছে। এখন আবারো একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটছে। নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করলেও সরকার আলাপ-আলোচনার পথ থেকে সরে এলে দেশে দীর্ঘমেয়াদি সহিংসতা ও অচলাবস্থা  তৈরি হওয়ায় দেশবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
বাংলাদেশের সংবিধান রচয়িতাদের অন্যতম রাজনীতিবিদ গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল বলেছেন, দেশে অসুস্থ রাজনীতি চলছে। এই রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একইভাবে এসবও বন্ধ করতে হবে। সংকটের সর্বশেষ পরিস্থিতি এ রকম যে, সরকার সংলাপের সমঝোতার বদলে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করতে চাইছে। আমরা এর সমাধান চাই। কাউকে গ্রেফতার করে, সভা-সমাবেশের অনুমতি বন্ধ করে সরকার যদি মনে করে তারা সঠিক পথে আছে তাহলে তারা ভুল করবে।
প্রচারণার বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে নৌকায় ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন, গত রোববারও চাঁদপুরে সরকারি টাকা ব্যয়ে জনসভা করে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়েছেন যা আইনের সুস্পষ্ট লংঘন। দুদিন আগে গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। দুটি নির্বাচনই দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হবে। ফলে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের যে প্রান্তেই নৌকার পক্ষে ভোট চান না কেন তা ঘোষিত তফসিলের মধ্যে পড়ে এবং সেটা নির্বাচন আচরণ বিধিমালার সুস্পষ্ট লংঘন। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বিনা ভোটের প্রধানমন্ত্রী আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর বন্দুকের নলই হচ্ছে তার ক্ষমতার ভিত্তি, তাই তিনি সব কিছুই করতে চাচ্ছেন হুংকার আর ধমক দিয়ে। সকল আইন, নিয়ম-নীতি ভেঙ্গে নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদ- দিয়েছেন আদালত। সেই সাজা বাড়াতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে এরই মধ্যে রুলও জারি করেছেন হাইকোর্ট। খালেদার কারাদ- প্রদানের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূচনা হয়েছে, যেখানে এরইমধ্যে  বৈরিতা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করেন সাংবাদিক ও গবেষক আফসান চৌধুরী। তিনি সম্প্রতি একটি লিখায় বলেছেন,  জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার মেরিট নিয়ে মাথা ব্যথা শুধু আইনজীবীদের। কিন্তু এর প্রভাব পড়ছে সবার ওপর। খালেদা জিয়ার ৫ বছর কারাদন্ডের কারণে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারাবেন কি না, সেই সুরাহা পরে হবে উচ্চ আদালতে। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগের বাকি সময়টা আরও দীর্ঘ হয়ে উঠবে।
তিনি বলেছেন, দেশের খুব কম মানুষই বিশ্বাস করে যে, খালেদা জিয়ার এই মামলা দুর্নীতিতে জড়িত রাঘŸবোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। কারণ এদের অনেকেই আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের সংস্কৃতির মূলে এই বিশ্বাস রয়েছে, অধিকাংশ রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়, সেগুলো সত্যি নয়। কারাদ- কারো রাজনৈতিক ভাবমূর্তির ক্ষতি করে না। তাই, এর ক্ষতি ততটা নয়, যতটা ভাবা হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই ভোটের রাজনীতির অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। তাই বিরোধী দলের নেতা কারাগারে থাকার পরেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী হওয়া যায় না। সেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না তা নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে খালেদা জিয়ার এই সাজার মধ্যে দিয়ে। তবে রাজনৈতিক বিরোধী দলের চেয়ারপার্সনের বিরুদ্ধে আদালতের যেকোনো মামলা যে রাজনৈতিক, সেটা বলা যায়।
তিনি লিখেছেন, দীর্ঘ দিন ধরে সরকারে থাকা দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, দেশের পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে। দলটির একাধিক নেতা এবং সরকার প্রধানও তেমনটি বলে আসছেন। আর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। কিন্তু কথা হলো যদি উভয়েই তারা আগ্রহী হয়, তাহলে এই দ্বন্দ্বটা হচ্ছে কেন? তাত্ত্বিকভাবে হয়তো অবাধ রাজনৈতিক পরিবেশকে স্বাগত জানাবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু বাস্তবে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলেই তারা খুশি। অবশ্যই, সেটা হঠাৎ করেই হয়ে যাবে না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হবে বিএনপির জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি কঠিন করে তোলা, যাতে বিএনপি স্বাভাবিকভাবে এই বয়কটের সিদ্ধান্তের দিকে যায়। কেউ কেউ মনে করছেন, খালেদা জিয়ার কারাদন্ড সেই পথেরই একটি অংশ। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যদি প্রধান দুই রাজনৈতিক দল সংঘাতের দিকে আগাতে থাকে তাহলে মানসম্পন্ন নির্বাচনের সম্ভাবনা খুবই কম। যদি একটা সহিংস পথ পাড়ি দিয়ে নির্বাচনে যেতে হয়, তাহলে এর ফলাফল কি হবে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশের রাজনীতি সেই দুর্বল জায়গাতেই রয়ে যাবে, যেখানে এতদিন ছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার বিএনপিকে রাজপথে সভা-সমাবেশের অনুমতি না দিলেও তারা ঠিকই রাস্তা অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করছে। এমনকি তাদের জোটের শরীকও রাজধানীর সোহরাওয়াদী উদ্যানসহ ঢাকার যেখানে সেখানে বড় বড় সমাবেশ করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে সেটি মানে না। তাদের মতে, গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হলো, সবাইকে সভা-সমাবেশের সুযোগ দেয়া। মূলত দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধও এই শ্লোগানকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল। কিন্তু এখন যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগই বিষয়টি বেমালুম ভূলে গেছে। তারা এখন একদলীয় শাসন চালাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশে মিছিল-মিটিং ছাড়া গণতন্ত্রের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। যেখানে গণতন্ত্রের গোড়াপত্তন মাত্র সমৃদ্ধির পথে সেখানে মিছিল-মিটিং ছাড়া সেটি টিকে না। তারা বলছেন, এখানে পদে পদে অধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। আইনের শাসন অনুপস্থিত। বিচারবিভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। মানুষের মৌলিক ও মানবিক অধিকার নেই। স্বাধীনবাবে মত প্রকাশের অধিকার নেই। রাজনীতিবিদদের কঠোর হাতে দমন করা হচ্ছে। একদিকে সরকার বলছে, কারো রাজনৈতিক কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না। অথচ সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমানসহ দলটির সিনিয়র বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে সংগঠনটির আমীর ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ সিনিয়র অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের অপরাধ, তারা রাজনীতি করেন। দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে কাজ করছেন। গ্রেফতারের সময় তারা সবাই নিয়ম মেনেই রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছিলেন। রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, এভাবে কন্ঠরোধ বা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ অব্যাহত থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন কি করে হবে?
বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন কেএস ভেঙ্কটাচালম। তিনি একজন কলামিস্ট ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার। দ্য ডিপ্লোম্যাটের মতামত কলামে এক প্রতিবেদনে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সন্ধিক্ষণে। ভেঙ্কটাচালম লিখেছেন, বাংলাদেশে দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আধিপত্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে অখ্যাত কোন তৃতীয় দলের চ্যালেঞ্জ করাটা কার্যত অসম্ভব। খালেদা জিয়ার দ-কে কেন্দ্র করে যদি বিএনপির সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়, তাহলে বাংলাদেশ ডি-ফ্যাক্টো এক-দলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
জানা গেছে, ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতাকর্মীসহ জনগণের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে সরকার নতুন করে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার শুরু করেছে। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের তো দেখামাত্রই আটক করা হচ্ছে। বিএনপিসহ পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিহিংসার মামলায় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিরোধী জোটের আন্দোলন মোকাবেলায় মামলাকেই এখন অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে সরকার। নেতা-কর্মীদের মামলা দিয়ে সাজার জালে আটকাতে চায় আওয়ামী লীগ। এমনকি আগামী নির্বাচনে নেতাদের অযোগ্য করার কৌশলও গ্রহণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের টার্গেট হচ্ছে জোটের শীর্ষ নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। এরই মধ্যে নিম্ন আদালতে সাজা হ্বার পর থেকেই ক্ষমতাসীনরা বলছেন, খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
সূত্র মতে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দিন দিন বাড়ছে কূটনৈতিক চাপ বাড়ছে। একইসঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নানা তৎপরতা শুরু করেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করছেন। আলোচনা করছেন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও। বিদেশিরা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চান। বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো হতাশ হয়েছিল। এবার আর তেমন নির্বাচন দেখতে চান না তারা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারাও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিদেশিদের ভূমিকা চাইছেন। আগামী নির্বাচনের প্রশ্নে ওয়াশিংটনের বার্তা স্পষ্ট করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। তিনি সম্প্রতি ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বার্নিকাট বলেন, বাংলাদেশে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র পাশাপাশি চলতে হবে। একই দিনে, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আলিসন ব্ল্যাক মন্তব্য করেন, ব্রিটেন বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন বাংলাদেশ সফরকালে গোপনে ও প্রকাশ্যে নির্বাচন নিয়ে এই অভিমতের কথা বাংলাদেশের নেতাদের কাছে বলেছেন। অপর একজন ব্রিটিশ কূটনীতিক বলেছেন, বাংলাদেশের বন্ধু হিসাবে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা এ দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চান। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপির বর্জনে একতরফা নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব ও নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা না থাকায় ওই নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইইউ এখনও তার অবস্থান অপরিবর্তিত রেখেছে। এ অবস্থায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেখতে চায় তারা। এর আগে গত বছরের ১৮ মে সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। পরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু দেখতে চাই, তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না ভারত।
সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে সেই নির্বাচনটিও কারো কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। যেমনীভাবে ২০১৪ সালের টা পায়নি। সরকার যদি মনে করে বিএনপিকে শুধু নিবন্ধন রক্ষার জন্য নির্বাচনে যেতে হবে তাহলে তারা ভুল করবেন। এই নির্বাচন দেশের ভবিষ্যৎ অনেক কিছুই নির্ধারণ করছে।
জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনদের টার্গেট একটাই, ফের ক্ষমতা। বিএনপিকে নানা কৌশলে কোণঠাসা করে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কথা ভাবছে দলটি। ফের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে সব ধরনের চেষ্টা চালাবে তারা। ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছেন নেতাকর্মীরা। তবে দমন পীড়নের পাশাপাশি এখন বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখতে চাইছে আওয়ামী লীগ। এখন তাদের বক্তব্য একটাই, তাদের অধীনেই বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ