শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বিনিয়োগ নেই, নেই কর্মসংস্থান তাহলে এতো প্রবৃদ্ধি আসলো কোত্থেকে?

স্টাফ রিপোর্টার : চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন সরকার করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক। দেশে বিনিয়োগ নেই, নেই কর্মসংস্থান তাহলে এতো প্রবৃদ্ধি আসলো কোত্থেকে?

গতকাল সোমবার আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থনীতির হালনাগাদ পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে এ কথা বলেন সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রকাশ করা হয়। 

ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়েছে, চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ থেকে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে।

সরকারেরর চেয়ে কমিয়ে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলনের পেছনে কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জন্য ৭ দশমিক ৬৫ ভাগ প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে তা অর্জন করার জন্য দেশে যে পরিমাণে বেসরকারি বিনিয়োগ হওয়া দরকার ছিল তা হয়নি।

জাহিদ হোসেন বলেন, বিবিএসের হিসাবে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে শিল্প খাতে, মূলত উৎপাদন এবং নির্মাণ খাতে। এখানে কিছু ভাববার বিষয় আছে।

শ্রম জরিপে ২০১৬ সালের তুলনায় ২ লাখ কর্মসংস্থান বেশি হওয়ার তথ্য তুলে ধরে এর সঙ্গে শিল্পখাতে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন না।

যেখানে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি এতো কম! ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ হার জিডিপির অনুপাতে মোটামুটি স্থবির। সে ক্ষেত্রে প্রশ্নটা আসে যে ম্যানুফেকচারিং খাতে এতো প্রবৃদ্ধি আসলো কোত্থেকে?

জাহিদ হোসেন বলেন, প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ দেখানোর মূল কারণ হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের বড় প্রবৃদ্ধি। ভোক্তার ব্যয় এতে চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। ব্যক্তি খাতের ভোক্তার ব্যয়টাই এখানে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে। প্রশ্ন যেটা থেকে যায়, এই ভোক্তা চাহিদা বাড়ার সূত্রটা কি?

 প্রশ্ন হলো এত প্রবৃদ্ধি কি অর্থনীতির সক্ষমতার অতিব্যবহার নাকি কৃত্রিমভাবে  তৈরি করা? এত প্রবৃদ্ধির জন্য কাঠামোগত পরিবর্তনের কোনো প্রমাণ নেই নাকি উৎপাদনশীলতা বেড়েছে? আবার আইনি পরিবর্তন হয়নি, তেলের দামও কমেনি, স্বস্তিবোধের কোনো কারণও নেই। 

জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, জাতীয় আয়ের প্রকৃত হিসাব করার জন্য বড় মাপের প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনীয়তা আছে। বিবিএস জেলাপর্যায় থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। অনেক অর্থনীতিবিদ বলেন, বিবিএস হলো সুপ্রিম কোর্টের মতো। যেহেতু এখানে আইনি কোনো বিষয় নেই। তাই প্রশ্ন তুলতেই পারি। এসব বিষয়ে আরও বিশ্লেষণ করা দরকার।

 দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে ব্যাংকিং খাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংকের এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির তদারকি বাড়াতে হবে। আবার ঋণ আদায়ে আইনগত ও আর্থিক কাঠামোর উন্নতি করতে হবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট না থাকলেও খেলাপি ঋণ বেশি আছে। তবে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে।

 কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতির উল্টোদিকে চলছে বলে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য কিছুটা সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করলেও শেষ পর্যন্ত ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) এক শতাংশ কমিয়ে উল্টো সম্প্রসারণমূলক করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি চিমিয়াও ফান বলেন, এদেশ একবছরে দুই বার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পরেও যেভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে, সেটা এদেশের অর্থনীতির শক্তি।

ঝুঁকির ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে ব্যাংকিং খাতই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের খাত। এই খাতের দুর্নীতি দমনে, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য ব্যাংক খাতে তদারকি বাড়াতে হবে। ঋণ আদায়ে আইনগত ও আর্থিক কাঠামোর উন্নতি করতে হবে।

বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। এটি মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ। কয়েক বছর ধরে এই ঘাটতি নিরসনে বাজেটের মাধ্যমে অর্থ দেওয়া হচ্ছে। তার মতে, মুদ্রানীতি এখন সম্প্রসারণমূলক হয়ে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী, সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি হওয়া উচিত।

বিবিএস’র পরিসংখ্যান নিয়ে এর আগে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। বিশ্ব ব্যাংক এবং এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলো বিতর্ক করলেও অর্থবছর শেষে বিবিএস অগ্রহণযোগ্য জরিপ দিয়ে থাকে। যা কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় না।

বিবিএস’র পরিসংখ্যান দাতা সংস্থাগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য করতে ইতোমধ্যেই বিশ্ব ব্যাংক এই সংস্থাকে সংস্কারের জন্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো যে পদ্ধতিতে হিসাব করে থাকে এ পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। এভাবে পরিসংখাণের ভুলের কারণে এর আগে বিশ্বের অনেক দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছিল। এমনকি খোদ আমেরিকাও এর বাইরে নয়। ২০০৮ সাথে যে অর্থনৈতিক মন্দাভাব তৈরি হয়েছিল তার মূলে ছিল পরিসংখ্যানের এবং কু-বনিয়োগ। এত কিছুর পরেও বাংলাদেশ সেই ভুল পথে চলছে বলেই মনে হচ্ছে। আর এ কারণে দাতা সংস্থাগুলো জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে বির্তক করছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ