বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ভিক্ষার থালা

জাহাঙ্গীর আলম অরণ্য : উৎসবের আয়োজনের ধকলে অবসন্ন বারেক সাহেবের মন চাইছে সিসা গলিয়ে শোবার ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ইচ্ছামতো ঘুমিয়ে নেয় একবেলা। কিন্তু মনের চরে যেখানে অগণিত  মণি-মুক্তার ছড়াছড়ি, ঘুম আর জাগরণ সেখানে বাঘ আর মহিষের মতোই লড়াই চালিয়ে যায় অবিরত। একটু জিরিয়ে নেবার সে ফুরসতও অবশ্য তার নেই। অনুষ্ঠান নির্বিঘেœ চালিয়ে যেতেই হবে শেষ অবধি।

বারেক সাহেবের বড়ো ছেলের বিয়ের আজ বৌভাত। অভ্যাগতরা আসছে। সবাই ভেতরের গেট সংলগ্ন নজরানার টেবিলে হাজিরা দিচ্ছে। হাজিরা শেষে ভেতরের খাবার টেবিলে বসে প্রয়োজন বা অপ্রয়োজন মতো খাবার খেয়ে আর খাবার নষ্ট করে আবার চলে যাচ্ছে। বারেক সাহেব সবকিছু তদারকি করছেন। তবে বেশির ভাগ সময় তিনি নজরানার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা করছেন।

গেটের বাইরে বেশ কয়েকজন ভিক্ষুক খাবারের আশায় জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে তাদের ভিক্ষার ঝুলি, হাতে ভিক্ষার থালা। যদি পেটপুরে দুটো ভালো-মন্দ খাওয়া যায়। আর যদি সম্ভব হয় দুটো খাবার ঘরে নিয়ে যায়। কতো খাবারই তো নষ্ট হচ্ছে। কতো খাবার কুকুর-বিড়ালে খেয়ে নিচ্ছে। দুটো এঁটো খাবার তো অন্তত মিলবে! তবে তাদের আশার উত্তাল তরঙ্গে বাঁধ সেধেছে বারেক সাহেবের ছোট ভাই রফিক। ভিক্ষুকের মতো একটা নিকৃষ্ট জিনিস এই মহান অনুষ্ঠানের শোভা বর্ধনের অন্তরায় হোক, সেটা কিছুতেই হতে না দিতে সে বদ্ধপরিকর।

এতোবড়ো জমকালো অনুষ্ঠানে বারেক সাহেব উদ্বিগ্ন; আয়োজনে কোনো ত্রুটি হলো কি না। তারচেয়েও উদ্বেগের বিষয় হলো লাভ-লোকসানের কঠিন হিসাব-নিকাশ। খরচ আর নজরানা; কোন পাল্লা ভারি হতে চলেছে!

তাই তো তিনি নজরানার টেবিলের আশে-পাশেই পায়চারী করছেন। অথচ ভাবখানা এমন যে, অতিথিদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের একমাত্র কা-ারি তিনিই।

অথচ তিনি অতি সূক্ষ্মভাবে খেয়াল রাখছেন, কার নজরানার পরিমাণ কতো। টেবিলের পাশে তার দাঁড়িয়ে থাকায় সুফলও হচ্ছে। যে লোক পাঁচশ টাকা নজরানা দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছিলো, বারেক সাহেবের সামনে চক্ষুলজ্জায় হলেও তা একহাজার টাকায় পরিণত করতে বাধ্য হচ্ছে। রহিমের কাছে কলম আর খাতা। সব ধরনের উপহার সামগ্রী গ্রহণ করার সাথে সাথে দাতার নাম-ঠিকানাসহ উপহার সামগ্রীর নাম, ধরন আর টাকার অঙ্ক সে লিখে রাখছে। কুদ্দুস একটি পিতলের থালায় টাকা গ্রহণ করছে। আবুল অন্যান্য উপহার সামগ্রী পাশের টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখছে।

হঠাৎ একটি লোকের দিকে বারেক সাহেবের চোখ আটকে গেলো। ইস্ত্রি করা বেশ পুরনো প্যান্ট-পাঞ্জাবি পরা মধ্যবয়েসী এ লোকটি, যার নামটা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছেন না বারেক সাহেব। এ লোকটা তার আত্মীয় না অনাত্মীয় তাও খেয়াল হচ্ছে না এই মুহূর্তে। একে দাওয়াত করেছিলেন কিনা, তাও মনে পড়ছে না। লোকটা খুব দ্রুত প্যান্টের পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে কুদ্দুসের হাতে দিতে যাবে কিন্তু ততোক্ষণে বারেক সাহেবের চোখাচোিিখ হয়ে পড়লো। বারেক সাহেবের দিকে তাকিয়ে এক টুকরো শুকনো হাসি হাসলো। তারপর পাঁচশ টাকার নোটটা অতি সঙ্গোপনে সরিয়ে নিয়ে একটু পাশে সরে গেলো। তারপর মানিব্যাগ বের করে মানিব্যাগের সবকটি কুঠুরি খুঁজে খুঁজে সব টাকা জড়ো করলো। মাত্র বিশ টাকার একটি নোট মানিব্যাগে পুরে সব টাকা মনোযোগ সহকারে গুণতে লাগলো। টাকাগুলোর উপর প্রতিটি স্পর্শে তার মমতার ধারা ঝরছে। মনে হচ্ছে, অতি আপনজনদের চির বিদায় দিতে হচ্ছে। বিদায়ের পরে হয়তো সেও ঝরে পড়বে নিঃশব্দেÑঠিক একবিন্দু শিশির কণার মতো। লোকটা তিনবার গুণলো টাকাগুলো, ওই একই রেজাল্ট; নয়শ পঞ্চাশ টাকা। তারপর অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় টাকাগুলো কুদ্দুসের হাতে দিয়ে কোনোমতে নাম-ঠিকানা বলে শুকনো মুখে এগিয়ে গেলো খাবারের টেবিলের দিকে।

বারেক সাহেব না দেখার ভঙ্গিতে পুরো বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করলেন। টাকা কয়টা দিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো লোকটার। বারেক সাহেবের মনে একটা ধাক্কা লাগলো, ‘এ তো জোর করে টাকা আদায় হচ্ছে! এ তো ডাকাতি! বাসা পর্যন্ত পৌঁছতে লোকটার হাতে আর মাত্র বিশটি টাকা অবশিষ্ট রইলো। কালকের বাজারটাও হয়তো ঠিকঠাক মতো করতে পারবে না বেচারা!’

কিন্তু নাহ, এ সব ভাবলে চলবে না। দয়ামায়ার জায়গা এ অনুষ্ঠান নয়। মাথাপ্রতি একেকটা খাবারের মূল্য পড়েছে সাড়ে পাঁচশ টাকা। নষ্ট হবে যে পরিমাণ খাবার, তাও হবে এর আধাগুণ। সব মিলিয়ে খরচ পড়বে প্রায় সাড়ে সাতশ টাকার মতো। কেউ অন্তত এক হাজার টাকা না দিলে এ অনুষ্ঠানে লোকসান হবে যে। এ অনুষ্ঠানে বাজেট পাঁচ লাখ টাকা। এমন পরিমাণ টাকা না তুলতে পারলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে যে! নাহ, কারো প্রতি মায়া দেখানো চলবে না। আরো কঠোর হতে হবে। বরং যারা হাজার টাকার নিচে দেবে অথবা হাজার টাকা দিয়ে একাধিক লোকে খাবে, তাদের কান ধরে টেবিল থেকে উঠিয়ে দেওয়া উচিৎ।

বারেক সাহেবের মনে পড়ছে, এ জীবনে এটাই তার প্রথম এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন। অথচ সারা জীবনে তিনি এ পর্যন্ত প্রায় দুশ নিমন্ত্রণে অংশগ্রহণ করে প্রায় দুলাখ টাকার সমপরিমাণ নজরানা দিয়েছেন। এই টাকা জমালে বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে তিনি এ দিয়ে আলাদা একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে পারতেন। তিনি যাদের এই টাকা দিয়েছেন তারা তো কোনো দয়ামায়া করে নি! বরং কম টাকা দিলে আড়চোখে তাকিয়েছে। পরে সমালোচনা করেছে। এমনও দিন গেছে, ছেলে মেয়ের স্কুল কলেজের খরচ না দিয়ে অথবা হিসেব করা টাকা, যা তিনি সংসারের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যয় করার জন্য রেখেছেন। তা না করে এই সব দাওয়াত রক্ষা করতে হয়েছে। বড়ো ভাইটার উ্পার্জন তেমন ছিলো না। দাওয়াতের নজরানা দিতে দিতে ধার-দেনা করতে করতে শেষে বাপের পাঁচকাঠা ধানি জমি বিক্রি করে দিতে হয়েছিলো। শেষে গ্রাম ছেড়ে কিছুদিনের জন্য সে শহরে উঠতে বাধ্য হয়েছিলো। কিন্তু দাওয়াত তার পিছু ছাড়লো না। দাওয়াত তার পরিবারের উপর চড়াও হলো। শেষে আবার ফিরে এলো। রাগ করে কয়েকটি দাওয়াতে অংশ নেয় নি। লোকজন তাকে কিপটে উপাধী দেওয়া শুরু করলো। গ্রামে তার স্বাভাবিক সম্মানটুকু খর্ব হয়ে গিয়েছিলো। লোকে শেষ পর্যন্ত তার নাম দিলো অসামাজিক প্রাণী। সে নাকি সামাজিকতা বোঝে না। দাওয়াতের এসব বাজে খাবার খেয়ে খেয়ে ভাইটা মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তো। আর যত্তোসব জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ভাইটা এখন মৃত্যুঝুঁকিতে।

অথচ এমনিতে তো কেউ একবেলা দাওয়াত করে কোনোদিন খাওয়ায় না! অচেনা মানুষদেরও কদর বেড়ে যায় একমাত্র এই সব অনুষ্ঠানের সময়েই। অনুষ্ঠানের আয়োজনের সময়ই কেবল লতায়-পাতায় সব আত্মীয় আর অনাত্মীয়ের ডাক পড়েÑশুধু টাকা নেবার ধান্দায়, অনুষ্ঠানের ছুতোয়। অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে এতোই যদি স্বাদ, তা এই থালা পাতা কেনা! নিজের খরচে নিজের প্রিয়জনদের খাইয়ে দিলেই তো পারে! শুধু কী তাই! খাবারের মধ্যে ইচ্ছামতো গোলাপজল মিশিয়ে খাবারকে বিস্বাদ করে। যাতে অভ্যাগতরা পেট পুরে না খেতে পারে। কত্তোবড়ো ছোটলোকী!

কিস্তু বারেক সাহেব খাবারের মধ্যে এসব বাজে জিনিস মেশান নি। যদিও আপনজনদের অনেকেই এমনটা করতে বলেছিলো। শুধু তাই নয়, তিনি পাততে চান নি এই নজরানার থালাও। শুধু পূর্বের ক্ষোভের জের ধরেই আজ এতো বড়ো অনুষ্ঠান নজরানার বিনিময়ে আয়োজন করেছেন। আজীবন যাদের টাকা দিয়ে এসেছেন, একবারের জন্য হলেও অন্তত কিছু টাকা আদায়  করে গায়ের ঝাল জুড়াতে চান এবার।

বাইরে হঠাৎ করে কিসের এক গ-গোল শুরু হলো। বারেক সাহেব দ্রুত ছুটে গেলেন। খাবারের জন্য পিড়াপিড়িরত ভিক্ষুকদের একজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে বারেক সাহেবের ছোট ভাই রফিক। অন্ধ বৃদ্ধ ভিক্ষুকটি, দুর্বল কঙ্কালসার দেহে এ ধাক্কা সামলে নিতে পারে নি।  পড়ে গেলো নিচে। পাকা মেঝের উপর পড়ে মাথাটা ফেটে গেলো। বারেক সাহেবসহ কয়েকজন মিলে ভিক্ষুকটির মাথা চেপে ধরে রক্ত থামানোর চেষ্টা করলেন। মাথায় কাপড়ের পট্টি বেঁধে দ্রুত হাসপাতালে পাঠালেন। অন্যান্য ভিক্ষুকরা ক্রুদ্ধ। কিন্তু গরিব আর দুর্বল হওয়ায় তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দু-একটা অভিযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লো।

বারেক সাহেব ডান পাশে তাকালেন। মেঝেতে লেগে থাকা ভিক্ষুকটির রক্তের পাশে পড়ে রয়েছে ভিক্ষুকটির ভাঙা থালা। থালার মধ্যে দুটাকার ছেঁড়া একটি নোট। সেদিকে খানিকটা সময় তাকিয়ে থেকে তিনি ঝট করে মাথা ঘোরালেন নজরানার টেবিলে। লোকজন এখনো নজরানা দিচ্ছে। একজন অন্ধ বৃদ্ধ ভিক্ষুকের এমন দুরবস্থা এই অনুষ্ঠানের মানুষদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু বারেক সাহেব কোনোভাবে এ ব্যাপারটা মানতে পারছেন না। তিনি একবার তাকান ভিক্ষুকের থালার দিকে, একবার তাকার নজরানার থালার দিকে। কোনো পার্থক্য খুঁজে পেলেন না এই দুই থালার মধ্যে। বরং ভিক্ষুকের থালার প্রতিটি অণু-পরমাণুতে স্পষ্ট হয়ে আছে ক্ষুধা, অসহায়ত্ব আর পবিত্রতার ছায়া। আর নিজের নজরানার থালা লোভ, ক্ষুদ্রতা আর অপবিত্রতায় পরিপূর্ণ। ভিক্ষুকের থালা যেনো বারেক সাহেবকে অভিশাপ দিচ্ছে, ‘তোমরা ধ্বংস হও, যারা ভিক্ষুক না হয়েও ভিক্ষুকের থালা পেতে ধরো! আর সামাজিকতার দোহাই দিয়ে নষ্ট করো পৃথিবীর সীমিত খাদ্য, যার পরিণামে অভুক্ত থাকি এই আমাদের মতো মানুষেরা, যাদের তোমরা মানুষ ভাবো না!’

বারেক সাহেব হঠাৎ করেই চিৎকার দিয়ে উঠে টাকা সমেত নজরানার থালাটি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, ‘আমি ভিক্ষুক নই! খবরদার, কেউ এক পয়সা নজরানা দেবে না!’

বারেক সাহেব চলে যেতে চাইলেন কিন্তু কয়েকজন তাকে থামালো, ‘কী হয়েছে!’

বারেক সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আমরা যা করছি, এসব ধর্মেরও তো বিরুদ্ধাচারণ! আমি কেনো এই অপচয় করছি আর তোমরাই বা এই নজরানা কেনো দিচ্ছো! আজকের এই অপচয়ের টাকা দিয়ে ওদের মতো দশটি ভিক্ষুককে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া যায়। তোমরা যা খাচ্ছো আর নষ্ট করছো, পুরোটাই অপচয়। বরং বাড়িতে গিয়ে অনেককে ওষুধও খেতে হবে। অথচ আজকের এই খাবার নষ্ট না করলে, এ দিয়ে দশটি পরিবারের সারা বছরের খাদ্যের সংস্থান হয়ে যেতে পারতো।’ 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ