শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

নারীর মর্যাদা রক্ষায় ইসলাম বনাম বাস্তবতা

রেহানা বিনতে আলী : ‘এসো হে বোন কুণ্ঠিত হৃদয় প্রসারিত করি তারপর সাহসের প্লাকার্ড বয়ে নিয়ে মিশে যাই রাত্রির আকাশ ও নক্ষত্রের মত বিশ্বাসী জনতার ভিড়ে।’ ইসলাম ও বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কুরআনের এক একটি আইন-বিধিকে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেছেন। নারীর অধিকার ও মর্যাদা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি নিজেই তার বাস্তব দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। রাসূল (সা.) ব্যক্তিগতভাবেও নারীদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। নারীদের জানমাল ও মর্যাদার নিরাপত্তার ব্যাপারে তিনি যে কত বেশি সজাগ ও সচেষ্ট ছিলেন তার বাণী ও ভ’মিকাতে এর অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। নারীজাতির অধিকার ও মর্যাদা দান সম্পর্কিত বহু হাদীস রয়েছে। বিশেষ করে বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি নারীদের জন্যেও স্থায়ী মুক্তিসনদ ঘোসণা করেন। তিনি পুরুষদের অন্যায়, কর্তৃত্ব, নির্যাতন ও শোষণের হাত থেকে নারী জাতিকে চিরদিনের জন্য মুক্তি দান করেন। তিনি নারীদের সাথে কৃত সব রকমের বিভেদ-বৈষম্যের ও স্থায়ী অবসান করেন। নারীরাও যে আল্লাহর প্রিয়পাত্রী এবং পুরুষদের মতই স্বাধীন বিবেক বুদ্ধির মালিক হতে পারে। একথা বিশ্বের মানুষ প্রথমবার প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছেই শুনতে পেয়েছে। তিনি স্বামী, পিতা, সন্তানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে নারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। যা স্বয়ং কুরআনে বর্ণিত আছে। আবার স্বয়ং তিনিই ঘোষণা করেন ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’। তিনি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষা অর্জনকে বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করেন এবং নিজ কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের আয়-উপার্জনের অধিকার দান করেন। অথচ আজ প্রায় ১৫শত বছর পরও দিবস উদযাপন করে করে নারীদের অধিকার ও মর্যাদার কথা বলতে হয়। এর জন্য বিভিন্ন সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, র‌্যালি ইত্যাদি করতে হয়। আর এর উল্লেখযোগ্য কারণ হলো মানুষ সেই বিধি-বিধান থেকে অনেক অনেক দূরে সরে গেছে। তার স্থলে তৈরি করে নিয়েছে অসংখ্য মানব রচিত আইন ও মতবাদ এবং সেই আইন ও মতবাদের ভিড়ে নারীরা হয়ে পড়েছে বিশ্ব মিডিয়ার চোখ ধাঁধানো প্রচারণা।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, আজ এমন একটি মুহূর্তে এসে নারীর মর্যাদা বা অধিকার নিয়ে লিখতে হচ্ছে যখন কিনা নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র অহরহ আমরা মিডিয়ায় দেখতে পাচ্ছি। কোমলমতি শিশু থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না নির্যাতনের হাত থেকে। নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমেই ভয়ানক রূপ ধারণ করছে। চার থেকে পাঁচ বছরের শিশু, সেও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে পাষ- লম্পট দ্বারা, অবস্থা এমন হয়েছে যে, নারী মানেই নির্যাতন, নারী মানেই সহিংসতা।
নারী নির্যাতন সমাজের মরণব্যাধির রূপ ধারণ করেছে। ‘এক জরিপে দেখা গেছে, বিবাহিত নারীদের প্রতি চারজনের একজন স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার’। এতে আমার পাঠক বন্ধুরা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, বিবাহিত জীবনের পূর্বে যেমন নারীদের নিরাপত্তা বা শান্তিতে নেই। স্বামীর প্রভুর মত আচরণ করে এবং অধীনস্ত নারীদের গোলাম বা দাসীর মত ব্যবহার করে। অথচ আমরা জানি, আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর স্ত্রীদের কাছে অনেক প্রিয় ছিলেন। আবার স্ত্রীরাও তাঁর কাছে অনেক বেশি প্রিয় ছিল। অবশ্য এক্ষেত্রে নারীদেরও অনেক কিছু করণীয় ও বর্জনীয় আছে। নারীকে তার মর্যাদা পাওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করতে হবে এবং তার উপর অটল থাকতে হবে।
আর বিশেষ করে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার আলোকে নারী-পুরুষের মধ্যকার বিভেদ-বৈষম্য দূর করে দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন, জাতীয় জীবন এবং তার আন্তর্জাতিক জীবনের সর্বত্র সমমর্যাদা, সমঅধিকার ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করা যেতে পারে এবং এ উদ্দেশ্যেই নারীদের অধিকার, মর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কিত ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রচার-প্রসার এবং ইসলামী আদর্শের পতাকাতলে মহিলাদের সংঘবদ্ধ হওয়া একান্তই আবশ্যক। কেননা, আল্লাহ যে নারীকে শুধু সৌন্দর্য ও ভোগের জন্যেই সৃষ্টি করেননি তা বলাইবাহুল্য। বরং এক নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও স্পষ্ট উদ্দেশ্যে তাকে সৃষ্টি করেছেন। এখন যদি আধুনিক সভ্যতার ধ্বজাধারীরা সেই সত্য ও বাস্তবতাকে না মানেন এবং অস্বীকার করেন তাহলে তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করার জন্য আমাদের কাছে একটি মাত্র পথই খোলা আছে।
আর তা হচ্ছে এই যে, আমরা নারীত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেই নারী সমস্যার আলোচনা পর্যালোচনা করবো, নারীকে পুরুষ ভেবে নয়, বরং নারী ভেবেই এগুতে হবে। মূলত এটাই স্বাভাবিক পন্থা। এছাড়া অন্যসব মত এবং পথই ভ্রান্ত, বাতিল, বুদ্ধি বিরুদ্ধ বাস্তবতাবিমুখ। তাই আসুন আমরা জেনে নিই ইসলাম এর কি সমাধান দেয়।
ইসলামে নারী ও পুরুষের সত্তা : মোমেন পুরুষ ও মোমেনা নারী এরা সবাই একে অপরের বন্ধু। তারা সততার আদেশ এবং মন্দের প্রতিরোধ করে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এরা সেসব লোক, যাদের ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবার উপরে বিজয় ও মহাজ্ঞানী। [সূরা তাওবা : ৭১]
পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সত্বা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। নারী-পুরুষের একত্ব সম্পর্কে কুরআনে কারীমে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে। নারী আসলে কোন স্বতন্ত্র জীবসত্বা নয়। নারী ও পুরুষের মতই মানুষ। নারী-পুরুষ একই উৎস থেকে প্রবাহিত হয়ে জনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ ধারার বিকাশ সাধিত হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ বলেন, হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন। আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। [সূরা নিসা-১]
অন্য আয়াতে আবার আল্লাহ বলেন, হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি, গোত্রে। যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের সেই ব্যক্তিই আল্লাহতায়ালার নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকী, সাবধানী, আল্লাহ সব কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন। [সূরা হুজরাত : ১৩)
অতএব উক্ত আয়াতের মাধ্যমে আমি সম্মানীত নারী সমাজকে বলতে চাচ্ছি যে, নারী-পুরুষের সমান অধিকার, সমান মর্যাদা, সমান দায়িত্ব ও কর্তব্য। নারী ও পুরুষের মধ্যে ব্যবধান দুটি। একটি হলো দৈহিক এবং অন্যটি হলো তাকওয়ার ভিত্তিতে। তাই তাকওয়ার অধিকারী হওয়া আমাদের প্রত্যেকেই আলাদা আলাদাভাবে অনেক বেশি প্রয়োজন।
ইসলামে নারীর অধিকার : নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্মান, মর্যাদা, সম্পদ, শিক্ষা অর্জনের অধিকারের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ইসলামে। কুরআনে বর্ণিত, নারীরা তোমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ এবং তোমরাও নারীদের পোশাক পরিচ্ছদ। [সূরা বাকারা : ১৮৭]
মহান আল্লাহর কাছে সত্যবাদী নারী ও পুরুষ উভয়ই সমান। তিনি কাউকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন করেন না।
রাসূল (সা.) বলেন, যাকে চারটি জিনিস দান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের শ্রেষ্ঠ বস্তু দান করা হয়েছে। তা হলো: কৃতজ্ঞ আত্মা, যিকরকারী রসনা, পিদে ধৈর্য্যধারী শরীর ও বিশ্বস্ত নারী। অন্য একটি বর্ণনায় তিনি বলেন, পৃথিবীর সবকিছুই সম্পদ, এ সম্পদগুলোর মধ্যে নারীই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ।’
মর্যাদায় নারী : মহান আল্লাহ ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে নর-নারীর মধ্যে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করেননি। যে নর বা নারী আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আত্মসমর্পণকারী পুরুষ ও আত্মসমর্পণকারী নারী, বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ ও ধৈর্য্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোযা পালনকারী ও রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ, ও যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী নারী, তাদের সকলের জন্য আল্লাহতায়ালা অধিক স্মরণকারী নারী, তাদের সকলের জন্য আল্লাহতায়ালা ক্ষমা ও মহান প্রতিদান রেখেছেন।’ [সূরা : ৩৩-৩৫]
অর্থাৎ নর-নারী উভয়ের আসল উদ্দেশ্যেই হচ্ছে সকল স্তরে, সকল অবস্থায়, সকল প্রেক্ষাপটে তাকওয়া অর্জন করা, তাহলে নারীরাও মর্যাদার অনেক উচ্চ আসনে স্থান করে নিতে পারবে। তাই আমরা জানতে হবে যে, মানুষ হিসাবে নর-নারীর দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ, তাকওয়া অর্জন, ঈমানকে সুসংহত করা, সমাজে শান্তি আনয়নের কার্যকারিতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে উভয়ের মর্যাদা ও অধিকার সমান।
শাস্তি ও মূল্যায়নে নারী : অপরাধী হিসেবে নারী-পুরুষ উভয়ই সমান। যারা মুসলমান হয়েও অপরাধ করে থাকে, তাদের জন্য সকলের জন্য একই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে নারীদের জন্য বিশেষ কঠিন কোন শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। অপরাধী হিসেবে আল্লাহর কাছে সবাই সমান। কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘ব্যাভিচারীনি ও ব্যাভিচারী তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত করবে। আল্লাহতায়ালার বিধান কার্যকর করলে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে অভিভূত না করে, যদি তোমরা আল্লাহতে ও পরকালে বিশ্বাসী হও। [সূরা নূর : ২]
আবার অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, পুরুষ কিংবা নারী চুরি করলে তাদের হস্তচ্ছেদ কর। এটা তাদের কৃতকর্মের ফল এবং আল্লাহর নির্ধারিত আদর্শ দ-। বস্তুত আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। [মায়েদা : ৩৮]
পর্দা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে, ঈমানদার পুরুষদের আপনি বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযুত করে এবং তাদের যৌনাঙ্গ হেফাযত করে বা সংযত রাখে, এটাই তাদের জন্য উত্তম। ঈমানদার নারীদেরও বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। তারা যা সাধারণত প্রকাশ করে থাকে, তা ব্যতীত তাদের আচরণ প্রদর্শন না করে। তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত রাখে।’ [সূরা নূর : ৩০-৩১]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামের বিধান পালনের ক্ষেত্রে নর-নারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যে যতটুকু আমল করবে তার ততটুকু মর্যাদা ও পুরষ্কার থাকবে এবং যে যতটুকু ছেড়ে দিবে তার শাস্তিও তাই হবে। অর্থাৎ প্রত্যেকের ঈমান-ইলম আমল নিয়ে মূল্যায়ন হবে। সর্বশেষ নিশ্চয়ই আমার পাঠকরা একমত হবেন যে, অমূলক বা অনৈতিক কাজে উচ্চবাচ্য না করে সঠিক পন্থায় আসা দরকার।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ