বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

গার্মেন্টস শিল্পে ৯০ শতাংশ শ্রমিকের কোন প্রশিক্ষণ নেই

মুহাম্মদ নূরে আলম : বাংলাদেশের সব ধরনের রফতানিযোগ্য শিল্পখাত পিছিয়ে পড়ছে দক্ষ শ্রমিক ও শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের অভাবে। অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চলছে দেশের শিল্পখাত। তাই দিন দিন বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতা থেকে। প্রশিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক হলে বর্তমানের তুলনায় দিগুণ রফতানি আয় হতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ঠরা। অন্য যেকোনো শিল্পের মতোই পোশাক শিল্পে চাকরির জন্যও প্রয়োজন ন্যূনতম দক্ষতা। যদিও এ দক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশে এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই এবং গড়ে উঠেনি প্রশিক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান।
এ প্রশিক্ষণ সম্পর্কে ধারণাও নেই অধিকাংশ পোশাক শ্রমিকের। গার্মেন্টস শিল্পে ৯০ শতাংশ শ্রমিকের কোনো প্রকার প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষণ সম্পর্কে ধারণাও নেই ৫৫ শতাংশ পোশাক শ্রমিকের। পোশাক খাতে মাত্র ৮ শতাংশ কর্মী আছে প্রশিক্ষিত। যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে ২০২০ সালের মধ্যে প্রশিক্ষণ দিতে হবে ৫৪ লাখ শ্রমিককে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে ৭২ লাখ দক্ষ প্রশিক্ষিত শ্রমিকের দরকার হবে। ২০২৫ সালে দেশের শ্রমবাজারে জনবল লাগবে ৮ কোটি ২৯ লাখ। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশ এখনও প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদের (এনএসডিসি) ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এই দুই প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় বলা হচ্ছে, পোশাক শিল্পে চাকরি নিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই ৫৫ শতাংশ শ্রমিকের। রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকসহ দেশের সম্ভাবনাময় দশ খাতের ৯০ শতাংশ শ্রমিকের প্রশিক্ষণ নেই। তাদের দক্ষতার অভাবে প্রত্যাশা অনুযায়ী উৎপাদন বাড়ছে না। ‘স্টাডি অন মাইগ্রেশন প্যাটার্ন অব ওয়ার্কফোর্স ইন আরএমজি সেক্টর ফর পজিশনিং আরএমজি রিলেটেড স্কিল ট্রেনিং সেন্টার’ শীর্ষক গবেষণার আওতায় মোট ১ হাজার ৬৫ জন শ্রমিকের ওপর জরিপ চালায় এনএসডিসি। নিট ও ওভেন কাপড়ের এই দুই খাতের শ্রমিকই অংশ নেন এতে। জরিপের জন্য বেছে নেয়া হয় ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের মোট ১১টি গার্মেন্টস কারখানা।
জরিপে অংশ নেয়া শ্রমিকদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই নারী। পোশাক শ্রমিকরা কেন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন না, তার কারণও উঠে এসেছে এনএসডিসির জরিপে। জরিপে অংশ নেয়া ৫৫ শতাংশ শ্রমিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সম্পর্কে অবগত নন বলে জানান। ২৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ শ্রমিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে সময় অপচয় বলে মনে করেন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ঘাটতির কথা জানান ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ শ্রমিক। প্রশিক্ষণ ব্যয়বহুল হওয়ায় এ ব্যাপারে অনাগ্রহের কথা জানান ১ দশমিক ৫২ শতাংশ শ্রমিক।
 এনএসডিসির একজন উচ্চপদস্থ নির্বাহী কর্মকর্তা দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, পোশাক শিল্পে যে ৪৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত, তাদের প্রায় অর্ধেক সুইং মেশিন অপারেটর। এদের মাইগ্রেশন ও দক্ষতার বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা এ স্টাডির মাধ্যমে আমরা জানতে চেয়েছি। পর্যালোচনা বলছে, প্রতি বছর এ খাতের প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিককে প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন। জরিপে যে ফলাফল বেরিয়ে এসেছে, তার আলোকে আমরা পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করার পদক্ষেপ নিচ্ছি। যারা প্রশিক্ষণ নেননি কিন্তু পোশাক শিল্পে কর্মরত, তাদের মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার  প্রক্রিয়াও চলছে।
জরিপে ও গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যেসব অঞ্চল থেকে শ্রমিকরা পোশাক শিল্পে যোগ দিচ্ছেন, সেসব অঞ্চলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশের দেয়া উত্তর অনুযায়ী তাদের এলাকায় পোশাক শ্রমিকের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। ৬৮ দশমিক ২৭ শতাংশ শ্রমিক বলেছেন, তাদের এলাকায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। তাই যেসব এলাকা থেকে শ্রমিকরা পোশাক শিল্পে কাজ নিচ্ছেন, সেসব এলাকায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৭১ দশমিক ৬৩ শতাংশ শ্রমিককে চাকরি পেতে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
এর ভিত্তিতে এনএসডিসি বলছে, পোশাক শিল্পে কাজ পেতে দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ১৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ শ্রমিক চাকরি পেয়েছেন আত্মীয়স্বজনের সুপারিশে। পরিচিতদের সহযোগিতায় চাকরি পেয়েছেন ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ শ্রমিক। এছাড়া ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ শ্রমিক চাকরি পেয়েছেন তাদের আঞ্চলিক পরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতে। বেশির ভাগ পোশাক শ্রমিক হেলপার হিসেবে নিয়োজিত থেকে কাজ শিখছেন বলে জরিপের ফলাফলে উঠে এসেছে।
এতে দেখা গেছে, ৭৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ শ্রমিক হেলপার হিসেবে কাজ শিখছেন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কাজ শিখছেন মাত্র ১ দশমিক ২৯ শতাংশ শ্রমিক। কারখানা কর্তৃপক্ষ আয়োজিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ শ্রমিক। এছাড়া ১৯ দশমিক ৪১ শতাংশ অন্যান্য পন্থায় প্রশিক্ষিত হচ্ছেন। বিজিএমইএ মিডিয়া শাখা এ প্রসঙ্গে বলেন, পোশাক শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি। হাই ভ্যালু পণ্য প্রস্তুত ও রফতানির জন্যই এর প্রয়োজন বেশি। দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক অর্থায়নে সরকার ও বেসরকারিভাবে খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনের সহায়তায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। এ কার্যক্রমগুলোর আওতায় পোশাক শিল্পও রয়েছে। এছাড়া বিজিএমইএরও কিছু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। পোশাক খাতের অর্জনকে আরো এগিয়ে নিতেই সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি, পোশাক খাতে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা পূরণে ভবিষ্যতে বড় কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না।
প্রতিবেদনে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরে দশটি খাতে কত শ্রমিক প্রয়োজন, শ্রমিকের দক্ষতার ঘাটতি পূরণে করণীয় তুলে ধরা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, চাহিদা অনুযায়ী বিপুলসংখ্যক দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি আছে। ঘাটতি পূরণে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। দক্ষতা উন্নয়নে চলতি বাজেটে পাঁচ লাখ দক্ষ কর্মকর্তা তৈরির প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আগামীতে সেই সংখ্যা আরও বাড়বে।
২০১৩-২০১৪  সালের জাতীয়  শ্রম জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এতে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় দেশের দশটি খাত বেছে নেওয়া হয়। খাতগুলো কর্মসংস্থান ও জিডিপি বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। সেগুলো হলো কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, নির্মাণ, স্বাস্থ্য, পর্যটন, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়াজাত, হালকা প্রকৌশল, তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প।  পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমই বলছে, সরকারের উচিত হবে প্রতিবেদনের পরামর্শ অনুযায়ী কর্মসূচি নেওয়া এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। এ বিষয়ে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডক্টর নাজনীন আহমেদ বলেন, শ্রমিকদের চাহিদা পূরণ ও দক্ষতা বাড়ানো সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। বেসরকারি উদ্যোগও নিতে হবে। তিনি বলেন, কর্মসংস্থানের দিক থেকে পোশাক হচ্ছে সবচেয়ে বড় খাত। তাই শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে এ খাতে বেশি নজর দিতে হবে।
বিআইডিএসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সবচেয়ে বেশি অদক্ষ শ্রমিক রয়েছে চামড়া খাতে। এ খাতের ৯৫ ভাগ শ্রমিকেরই প্রশিক্ষণ নেই। কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে ৯৩ ভাগ শ্রমিক প্রশিক্ষিত নয়। পোশাক খাতে মাত্র আট ভাগ কর্মী প্রশিক্ষিত। বর্তমানে ৪০ লাখ কর্মী পোশাক শিল্পে সরাসরি নিয়োজিত রয়েছে, এর ৯০ ভাগই নারী। এ খাতে দক্ষ শ্রমিক নেই- দীর্ঘ সময় ধরে এমন অভিযোগ করে আসছেন সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তারা। দাতারাও সদক্ষতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আসছেন। জানা যায়, বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে যে কর্মসূচি চালু আছে, তাও যথেষ্ট নয়। বাজেটে এ বিষয়ে আরও বেশি বরাদ্দের দাবি রয়েছে।
পর্যটন খাতে ৭৫ ভাগ জনবলের প্রশিক্ষণ নেই। এ খাতে ইংরেজি বলতে না পারা বড় দুর্বলতা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ৬০ ভাগের প্রশিক্ষণ নেই। এ ছাড়া নির্মাণ, হালকা প্রকৌশল ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব যথাক্রমে ৯২, ৮৭ ও ৮৬ শতাংশ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের শ্রমবাজারে মোট জনবল লাগবে ৮ কোটি ২৯ লাখ। ২০২০ সালের মধ্যে প্রশিক্ষণ দিতে হবে ৫৪ লাখ এবং ২০২৫ সালে ৭২ লাখ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ