বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ঘুরে এলাম সুলতান সুলেমানের দেশ

আশফা খানম (হেলেন) : আজ ঐতিহাসিক নগরী ইস্তাম্বুল সফরের দ্বিতীয় দিন। ইস্তাম্বুল বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটন নগরী সমূহের অন্যতম হিসেবে খ্যাত। ১৪৫৩ সালে এ নগরীর যাত্রা শুরু হয়েছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে। ৪৫৯ বছর পর ১৯২২ সালে এই সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন আধুনিক তুরস্কের জাতির পিতা-মোস্তফা কামাল পাশা। বর্তমানে আংকারা তাদের রাজধানী। আমরা  সকালে ঝরঝরে হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা সবাই যথাসময়ে হোটেল লবিতে উপস্থিত হলাম। গতকাল রাতে বসফরাস ক্রুজ ডিনারে আমরা রাতের আলো ঝলমল ইস্তাম্বুলকে উপভোগ করেছি। আজ রৌদ্রোজ্জ্বল সকালের বসফরাস ট্যুর। যথাসময়ে গাইড ইনজি গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। আমরা প্রাসাদ আর মসজিদ এবং নানা রঙ্গের মনোরম ফুলে ঢাকা ইস্তাম্বুল শহরের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে বসফরাস ট্যুরের জন্য জেটিতে পৌছি। গতকালের চেয়ে আরেকটু ছোটখাট প্রমোদ ভ্রমণের সুসজ্জিত জাহাজ। অন্যান্য ট্যুরিস্টরাও যথাসময়ে হাজির। আমরা বসফরাসের কোল ঘেষে দু পাশের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করি। সেখানে চা, কফি, তুর্কী টি এবং কোল্ড ড্রিংসের ব্যবস্থা আছে। যে যার ইচ্ছামতো কিনে পান করতে পারে। পাহাড়ের তীরের খাঁজে খাঁজে ঘরগুলো অপূর্ব সুন্দর লাগছিল। এ ভ্রমণে ইস্তাম্বুল নগরীকে দেখার এক অনন্য সুযোগ । গোল্ডেন হর্ণ থেকে বসফরাস প্রণালীর বেশ কিছুদূর পর্যন্ত যাওয়া আসার পথে ঐতিহাসিক সবগুলো ট্যুরিষ্ট স্পট সবার নজর কাড়বেই। যেন প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে সখ্যতা। মাইকে একজন কমেন্টেটর দু’পাশের মনুমেন্ট, প্রাসাদ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর এবং দৃশ্যের তুর্কী ভাষায় বর্ণণা করছিলেন। ফলে আমরা তার বর্ণণা উপভোগ করতে পারছিলাম না। আমাদের গাইড ইনজি মাঝে মধ্যে আমাদেরকে ইংরেজীতে তরজমা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রায় দুই ঘন্টা আমরা ভ্রমণ করি। ভ্রমণের এক পর্যায়ে জানতে পারি আমরা তিনটি সাগরের মিলনস্থলে (কৃষ্ণসাগর, মারমরা সাগর এবং বসফরাস) অবস্থান করছি। ভাবতেই খুব ভালো লাগছিল। স্কুলে ভূগোলে এই সব সাগরের কথা পড়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তার অসীম দয়ায় আজ তা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে ভেবে খুব ভালো লাগছিল। দুপুর পর্যন্ত দীর্ঘ করেকদিন ঘণ্টার নৌ বিহার আমাদের অফুরান্ত আনন্দানুভূতি প্রদান করে। বসফরাস ট্যুর শেষে আমাদেরকে চামলিকা পর্বতে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে উঁচু পর্বত। এর উপর থেকে পুরো ইস্তাম্বুল শহরকে উপভোগ করা যায়। অতঃপর গাড়ী নিদিষ্ট সংরক্ষিত স্থানে রাখার পর আমরা হেঁটে পাহাড়ের উপর ছুটে চললাম। সেখানে কয়েন ভরে দুরবীনে ইস্তাম্বুল শহর উপভোগ করা যায়। অনেক বিদেশী ট্যুরিস্টের সমাগম দেখলাম। ছবি নেওয়ার মতো চমৎকার স্থান এই পাহাড় । অতঃপর সেখান থেকে আমরা নীচে নেমে তাদের ঐতিহ্যবাহী ঘরে বানানো আইসক্রীম উপভোগ করলাম। একটি লম্বা হাতওয়ালা আইসক্রীম স্পুন আইসক্রীম কেসের উপরে রাখা ঘন্টা ও ঘটি তে আঘাত করে টুংটাং শব্দ করে আইসক্রিম কেস থেকে পছন্দের ভষধাড়ৎ বা আইসক্রিম হাতে রাখা কোনে ভরে দেয়। দেয়ার সময় তাদের ভাষায় মজার প্রবাদ বলতে থাকে। অদ্ভুত ও মজার নিয়ম। মজাদার সুস্বাদু আইসক্রীম উপভোগ করে এবার গাড়ী আমাদেরকে লাঞ্চের জন্য বসফরাস ব্রীজের নীচে অবস্থিত রেস্টুরেন্ট গুলোর একটিতে নিয়ে চলল। গতকাল আমাদের দলের মোটামুটি সবাই সামুদ্রিক মাছ খাবার আগ্রহ দেখায়। তাই আজ লাঞ্চে সামুদ্রিক মাছ টেস্ট করার পালা। আস্ত মাছ চামড়া সহ (মসলা ছাড়া) ভুনে দিয়েছে। কাটা ছাড়িয়ে মাছ বেছে খেতে হয়। মাছের সাথে ভাত দেয় না, সালাদ পাতা দেয়। আমরা ভাত খুঁজে নিলাম। আমার সন্তান আর আমি মাছের পরিবর্তে গরুর গোশতের শিক কাবাব (তুর্কী ভাষায় শিষ কেবাব) আরেকটা মুরগীর গোশতের শিক কাবাব (তুর্কী ভাষায় তাবুক শিষ), রুটি, সালাদ মরিচের চাটনী, মাঠার শরবত ইত্যাদি খেলাম।  লাঞ্চ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে সবাই গাড়ীতে উঠি। এখন সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। এটি শহরের মূল আকর্ষণ আর তা’ হচ্ছে তোপকাপি যাদুঘর। কারণ তুরস্ক আসার পূর্বে এই যাদুঘর সম্পর্কে বেশ জেনেছিলাম। আসলে এটি অটোম্যান সম্রাটদের প্রাসাদ ছিল। বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এটি ৬৩৭৯০০০ থেকে ৭৫৩৫০০ স্কয়ার ফিট। স্থলভাগের দিকে প্রাসাদটি বেষ্টন করে আছে প্রায় ১৪০০ মিটার দীর্ঘ সুউচ্চ রাজকীয় প্রাচীর। এর আর্কিটেকচারাল স্টাইল অটোম্যান, বারুক। এর আর্কিটেক্ট মেহমেদ, আলাদ্দিন, দাভুদ আগা, মিমর সিনান ও সারকিস বামইয়ান। আমাদের গাইড দ্রুত টিকিট কেটে প্রবেশের ব্যবস্থা করেন। প্রবেশের মুখে পুরো তোপকাপি প্যালেসের একটি ডামি গ্লাসের বক্সে চিহ্নিত করে রাখা আছে। যা থেকে পুরো প্যালেসের কোন অংশে কি আছে তা’ সম্পর্কে ধারনা লাভ করা যায়। বিরাট ইটের পাঁচিলা দিয়ে এর সীমানা ঘেরা দেয়া আছে। তোপকাপি তূর্কী শব্দ যার অর্থ কামানের গোলার গেইট (Cannon ball gate)। উল্লেখ্য এই প্যালেসের চারটি পর্যায় আছে। এদেরকে ইংরেজিতে  কোর্টইয়ার্ড বলা হয়। প্রথম কোর্টইয়ার্ড প্রাঙ্গনে হাজিয়া আইরিন চার্চ অবস্থিত। এটি অটোম্যান সম্রাট বিজয় করার পর মসজিদে পরিণত করার কথা চিন্তা করেন। কিন্তু মসজিদ সর্বসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করলে প্রাসাদের নিরাপত্তা বিধ্নিত হবে বিধায় তা আর মসজিদে রূপান্তর করা হয়নি। অটোম্যান সুলতান মুহাম্মদ (২য়) ইস্তাম্বুল বিজয়ের অনেক বছর পর (যা বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল) ১৪৬০ থেকে ১৪৭৮ এর মধ্যে এই প্রাসাদ নির্মাণ করান । অটোম্যানদের প্রায় ৬০০ বছরের শাসনের ৪০০ বছর শাসিত হয় এই প্রাসাদ থেকে। প্রায় ৩০ জন সুলতান এই প্রাসাদে থেকে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। সুলতান মুহাম্মদ (২য়) এর মৃত্যুর পর অন্যান্য সুলতানরা এর পরিবর্ধন, পরিবর্তন এবং সংস্করণ করে আজকের তুর্কী ও ইউরোপীয়ান ষ্টাইলের তোপকাপি প্রাসাদ। এটি তুর্কী রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯২৪ সালের ৩ এপ্রিলে কামাল আতাতুর্ক আদেশে  মিউজিয়ামে রূপান্তর করে উন্মুক্ত করা হয়। এই প্রাসাদের দ্বিতীয় কোর্টইয়ার্ড এ রন্ধনশালা এবং কনফেকশনারীজ অবস্থিত। এতে তৎকালীন ব্যবহৃত সকল রন্ধন সামগ্রী সংরক্ষণ করা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল চার’শ বছর ধরে ব্যবহৃত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানের সিরামিক বাসন কোসন এবং কাটলারী দ্রব্যের অদ্বিতীয় কালেকশনটি। জানা যায় দোলমাবাগচী প্রাসাদ নির্মানের পূর্ব পর্যন্ত এই প্রাসাদই সুলতানদের প্রধান কার্যালয় ছিল। এর তৃতীয় কোর্টইয়ার্ডে প্রঙ্গনে সুলতানদের বাসভবন ছিল। এখানে বর্তমানে বিভিন্ন নবী রাসুলদের ব্যবহৃত সামগ্রী সংরক্ষণ করা আছে। এর মধ্যে বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর তলোয়ার, তাঁর চুল, তাঁর ধনুক, হযরত মুসা (আঃ) এর লাঠি, হযরত ইউসুফ (আঃ) এর পাগড়ী, হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর ব্যবহৃত থালা, হযরত আইয়ুব ও হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) এর ব্যবহৃত সামগ্রী, হযরত আলী (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত আবুবক্কর সিদ্দিক (রাঃ) এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর তালোয়ার সংরক্ষিত আছে। প্রাসাদের বাইরে গানম্যান দিয়ে মিউজিয়ামটি দিনরাত পাহারা দেয়া হয়। প্রিয় নবী-রাসুল ও সাহাবীদের স্মৃতি বিজড়িত সামগ্রী দেখে মন আবেগ আপ্লুত হয়ে উঠে। সেখানে ছবি তোলা নিষেধ এবং সার্বক্ষণিক ভেতরে তদারকির মানুষ আছে। নন- মুসলিমরা প্রবেশের পূর্বে তাদেরকে মাথা ও শরীর আবৃত করবার জন্য কাপড় দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সংরক্ষিত শতশত বছর পূর্বের কুরআনের অনেক কপি সংরক্ষিত আছে। অটোম্যান সম্রাটদের বিশাল লাইব্রেরী আছে যেখানে তাদের বই, দলিলপত্র সংরক্ষিত আছে রয়েছে। চতুর্থ কোর্টইয়ার্ডে কার্নিশ সংলগ্ন বাগান আছে। একে Terraced Garden বলা যায়। এতে টিউলিপ ফুলে পরিপূর্ণ ছিল এবং তখন যে রকম ফুল ছিল এখনও তাকে পরিচর্যা করে সেভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রাসাদের বাহিরে খোলা মাঠে ঘাসে পর্যন্ত তারা বসতে দেয়না। ভীষণ কড়াকড়ি এবং যত্নের সাথে তারা তাদের ঐতিহাসিক নির্দশনগুলো সংরক্ষণ করছে যা আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করে। অতঃপর জাঁকজমক পূর্ণ (সুলতান সুলেমান দীপ্ত টিভিতে প্রচারিত সিরিজের মতো) কারুকার্য খচিত প্রাসাদের এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে দেখতে লাগলাম। সুলতানদের কামরা দেখলাম। বিশাল হেরেম, এতে ৩০০ জন থাকতে পারতো। প্রাসাদের মাঝখানে বিশাল ফোয়ারা থেকে এখনও পানি পড়ছে। প্রাসাদ ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল এতো জাঁকজমকের ভিতরে তারা ঘুমাতো কিভাবে? মনে হচ্ছিল উপরে তারা যতই জাকঁজমকে চলুক না কেন আসলে মনের ভিতরে তাদের শান্তি ছিল না। অটোম্যান সাম্রাজ্যের ইতিহাস পড়লেই তা জানা যায়। উল্লেখ্য এ তোপকাপি প্রাসাদে ১০০০-৪০০০ জন লোক বসবাস করতে পারতো। তাহলে অনুমান করে দেখুন কত বিশাল প্রাসাদ। যা পুরোদিনেই দেখে শেষ করা সম্ভব নয়। প্রাসাদে সুলতানের কামরার বারান্দা কিংবা উপরে দুর্গের পথ থেকে দাঁড়িয়ে বসফরাসের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায়। আমাদের গাইড ইনজি আমাদেরকে ইস্তাম্বুলের বিশ্ববিখ্যাত স্পাইচ বাজার, যেটাকে ইজিপশিয়ান বাজারও বলা হয় তা দেখলেন। এ মার্কেটে বিশ্বের তাবৎ দুস্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্য মশলাপাতির এত বড় সমাহার নাকি আর কোথাও নেই। পরের সংখ্যায় ইস্তাম্বুলের জনপ্রিয় ‘গ্র্যান্ড বাজার’ তাকসীম স্কয়ার (বিল্পব উদ্যান) সহ মহানবী (সাঃ)-এর বিখ্যাত সাহাবী হযরত আইয়ুব আনসারী (রাঃ) মাজার জিয়ারতের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখার আশা রাখি। (চলবে)
লেখক : প্রিন্সিপ্যাল, চট্টগ্রাম ভিক্টোরী ন্যাশনাল স্কুল সিভিএনএস এবং কলামিস্ট ও নারী উন্নয়নকর্মী।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ