বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খুবই ব্যাহত হবে

স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীতে এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, যেভাবে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার হচ্ছে, সেখানে নিরাপত্তার জন্য একটি আইনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি যেভাবে বর্তমানে আছে, পাস হলে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খুবই ব্যাহত হবে। তাই খসড়াটির আমূল পরিবর্তন করে আইন করতে হবে।
গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে পেন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, নতুন প্রস্তাবিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাস হলে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মত প্রকাশের একটি ধারা প্রবর্তিত হবে। এই খসড়ায় একটি ধারা আছে যেখানে বলা হয়েছে, পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতার। কোনও রকম পরোয়ানা থাকবে না, আপনাকে তল্লাশি করবে। আপনার কম্পিউটার সিস্টেম জব্দ করবে এবং প্রয়োজন হলে আপনাকে গ্রেফতার করবে। গ্রেফতারটা কে করবে? পুলিশ! আমি তো মনে করি এই একটি ধারা আপনার সমস্ত স্বাধীন মতপ্রকাশের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে। মতপ্রকাশ কিন্তু একটা ‘ফ্রেজাইল’একটা ফুলের মতো জিনিস। আপনি জোরে একটা ধাক্কা দিলে এটা কিন্তু মতপ্রকাশ হবে না। এতে করে মতপ্রকাশের জগতটা ছোট হয়ে আসবে।
তিনি বলেন, আইয়ুব খান ও এরশাদের সময় কিন্তু বিবিসি’র কদর বেশি ছিল। সবাই কিন্তু খবর শুনতে চাইলে বিবিসি শুনতো। কেননা আমাদের ধারণা ছিল, দেশীয় যারা সমস্ত তথ্য দেয়, তারা সত্য কথা বলতে পারে না। কিন্তু এখন যেমন আমরা অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করি, এখন কিন্তু বিবিসি’র প্রতি নির্ভরশীলতা অনেক কমে গেছে। চায়নার সম্পর্কে জানতে হলে কিন্তু আপনি চায়নিজ মিডিয়ার চেয়ে বাইরের মিডিয়াকে বেশি বিশ্বাস করবেন। তাই একটা রাষ্ট্রের আত্মসম্মানবোধ থেকে, নিজের সম্মানবোধ যে, আমার তথ্য আমরাই বলবো, সেই বোধ থেকে সেই চেতনা থেকে আজকে যত বেশি মিডিয়া ফ্রি হবে, ততবেশি কিন্তু গুজব কম রটে। অর্থাৎ পরের কথায় বিশ্বাস কমে যায়।
সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে একমত হয়ে সিনিয়র এই সাংবাদিক বলেন, একটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দরকার। কিন্তু বর্তমান খসড়াটি যদি আমূল পরিবর্তন হয়ে না আসে, তাহলে অবশ্যই সেটা মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা এবং অবশ্যই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যাহত করবে। তিনি বলেন, যখনই ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের জগৎ ছোট হয়ে আসে, তখনই কিন্তু গুজব বেশি ছড়ায়।
মাহ্ফুজ আনাম বলেন, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যখন একটি সমাজ, একটি জনগোষ্ঠী নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে মত প্রকাশ করতে পারে, তখনই একটি সমাজ সামগ্রিকভাবে উন্নতি লাভ করে।
অসংখ্য আইনের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা। তিনি বলেন, আইন তখনই করা হয় এবং বাড়ানো হয়, যখন কোনো আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সৃষ্টিশীল লেখকদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে তিনি মনে করেন।
তবে কবি নুরুল হুদা বলেন, আমার মনলাইনে যা কিছু আছে, আমি সবকিছু যদি মন খুলে বলে দিই, কখনো কখনো সেটা আরেকজনের মনকে কলুষিত করতে পারে। কাজেই যখন মনলাইন ব্যবহার করব, এমনভাবে করব, যা আর কাউকে আঘাত করতে না পারে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, সবাই একমত যে একটি আইন দরকার। কিন্তু সেই আইন দিয়ে আবার বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়, সেটা হতে পারে না।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বিএফইউজে একাংশের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে একটি ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে, যখন রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি মিডিয়াকে ফেক নিউজ বলে ‘গ্র্যান্টেড’ করতে চায়, যার ফলে তারা ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। আগে ১০০ পত্রিকা ছিল, এখন ৩০০ পত্রিকার সম্পাদক এক জায়গায় হয়েছেন। তারা কমন সম্পাদকীয় পর্যন্ত লিখেছে যে, জার্নালিস্ট আর নট দ্য ক্রিমিনাল। কাজেই আমরাও মনে করি গণমাধ্যমের সঙ্গে যারা জড়িত আছেন, যারা লেখক আছেন তারা কোনও ক্রিমিনাল না। কিন্তু এই ইন্সট্রুমেন্টগুলো ক্রিমিনালরাও ব্যবহার করে। ইন্সট্রুমেন্টগুলি পলিটিক্যাল ইন্টেনশনের জন্যও ব্যবহার করা হয়। কাজেই আমরা মনে করি, পেন ইন্টারন্যাশনাল একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। তারাই নিজ জায়গায় সেই মতামতটা তৈরি করবে। আমার ধারণা, আইনের চূড়ান্ত  প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আপনারা যদি স্পিকারের সঙ্গে দেখা করে বলেন কথাগুলো, তাহলে তারা হয়তো পরবর্তী সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকবে। এছাড়া আমরা যারা এর ভেতরে কাজ করছি আমাদের জন্য একটি উপকারও হবে।
ব্রতির নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুরিশদ অবিলম্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি জানান। পেন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সভাপতি মাসুদ আহমেদের সভাপতিত্বে আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন কবি ও সংসদ সদস্য কাজী রোজী, ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন প্রমুখ। সৈয়দা আইরিন জামানের সঞ্চালনায় আলোচনায় প্রারম্ভিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এম এস সিদ্দিকী।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ