শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

সরকারের অনুমতি ছাড়া সরকারি চাকরিজীবী গ্রেফতার নয়

স্টাফ রিপোর্টার : ফৌজদারি মামলায় কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করতে হলে অনুমোদন নেওয়ার বিধান রেখে বহুল আলোচিত “সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮” আইনের খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে সরকার। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এই আইনের শিরোনাম আগে ‘সরকারি কর্মচারী আইন’ থাকলেও এখন তা নাম বদলে হয়েছে ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮।
মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, অনেক দিন আলোচনার পর আইনটি আসছে। এই আইনে সরকারি কর্মচারী সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো সংযোজন করা হয়েছে। অনেক বিষয় বিধির জন্য রাখা হয়েছে, সেগুলো বিধি দিয়ে কাভার করা হবে।
তিনি বলেন, সব ধরনের ফৌজদারি অপরাধের জন্য ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে গ্রেপ্তার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। চার্জশিট হওয়ার পরে অ্যারেস্ট করার জন্য অনুমতি লাগবে না। ফৌজদারি মামলার কোনো সরকারি কর্মচারীর এক বছরের বেশি মেয়াদে সাজা বা মৃত্যুদ- হলে রায়ের দিনই তাৎক্ষণিকভাবে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে।
আর ফৌজদারি মামলায় এক বছরের কম কারাদ-, অর্থদ- বা উভয় দ- হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাকে তিরস্কার, বেতন স্থগিত করা বা বেতন কমিয়ে দেওয়ার মত ছোট শাস্তি দিতে পারবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন বর্তমানে ‘ফাঁদ পেতে’ দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারীদের ধরছে। নতুন আইন কার্যকর হলে সেটি বাধাগ্রস্ত হবে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বাধাগ্রস্ত হবে না, কিছুটা বিলম্বিত হবে। অর্থাৎ চার্জশিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমরা ধরে নেই যে চার্জশিট হলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হয় তিনি দোষী, এর আগে তো কাউকে দোষী না নির্দোষ বলা যাবে না। যদি কোনো সরকারি কর্মচারীর ঘুষ নেওয়ার ঘটনা আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ দেখে ফেলে, তখনও কি তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না ? এর জবাবে শফিউল বলেন, আমার মনে হয় যাবে, কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গ্রেফতার করতে হবে।
 সেই গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ সাপেক্ষ হবে কি না - এ প্রশ্নে শফিউল বলেন, না, এ অংশটা আমাদের এখানে খুব বেশি ইয়ে নেই তো, ওটা বড় প্রেক্ষাপটের ছোট অংশ, কাজেই ওটা আর আমরা আলাপ করছি না।
এর আগে ২০১৪ সালের ২১ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ওই আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে। ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই প্রস্তাবিত খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়া ফের মন্ত্রিসভায় তোলা হলেও তাতে চূড়ান্ত অনুমোদন না দিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুশাসন দেয় মন্ত্রিসভা।
নতুন আইনে ‘মেধা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে’ সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা থাকছে জানিয়ে শফিউল বলেন, মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ ও সন্তোষজনক চাকরি বিবেচনায় নিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, শিক্ষানবিসকাল ও চাকরি স্থায়ীকরণ, প্রেষণ ও লিয়েন, বদলি, পদায়ন ও কর্মস্থল নির্ধারণ বিধি দিয়ে নির্ধারণ করা হবে। আচরণ ও শৃঙ্খলা আপিল বিধিমালা দিয়ে করা হবে। বিভাগীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান আইন অনুযায়ী চলবে। আপতত আইনে বলবৎ বিধান অনুসারেই সরকারি কর্মচারীদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হবে। আর বেতন-ভাতা ও সুবিধা সরকারি গেজেট দিয়ে নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে।
কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে সরকারি দায়িত্ব পালন সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ, আবমানা, মানহানি বা অন্য কোনো মামলা হলে তিনি সরকারি আইন কর্মকর্তার সহায়তায় বা নিজ দায়িত্বে তা পরিচালনা করতে পারবেন। এই মামলার খরচ সরকার বহন করবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে দুর্নীতির অভিযোগে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হলে ওই মামলা চালাতে সরকার কোনো অর্থ দেবে না। খসড়ায় বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেবাপ্রার্থীকে সেবা দিতে না পারলে তা কারণসহ সেবগ্রহীতাকে অবহিত করতে হবে। কোনো কর্মচারী ‘ইচ্ছাকৃত বা অভ্যাসগতভাবে’ এই বিধান লঙ্ঘণ করলে তা ‘অসদাচরণ’ এবং ক্ষেত্রমতে ‘অদক্ষতা’ বলে গণ্য হবে।
কোনো ব্যক্তির আবেদন না-মঞ্জুর, প্রত্যাখ্যান বা যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা না হলে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিকার চেয়ে তিনি আবেদন করতে পারবেন। কর্তৃপক্ষ আবেদন বিবেচনায় নিয়ে আদেশ দিতে পারবে। সরকারি সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে কর্মচারীদের সাফল্য, উদ্যোগ, উদ্ভাবনী প্রয়াস বা অবদানের জন্য প্রণোদনা, পুরস্কার, স্বীকৃতি বা সম্মানী দেওয়ার কথাও প্রস্তাবিত আইনে বলা থাকছে। কোনো কর্মচারী অফিসে নিয়মিত উপস্থিতি না হলে তার বেতন কাটা যাবে। আগে এ বিষয়েটি অর্ডিনেন্সে দিয়ে করা হত। কোনো কর্মচারীর কারণে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হলে দায়ী কর্মচারীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে। প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ে দায়ী কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে।
শফিউল বলেন, সংক্ষুব্ধ কর্মচারীদের শাস্তির বিধান রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ হওয়ায় তা আপিলযোগ্য হবে না। রাষ্ট্রপতির কাছে রিভিউ আবেদন করা যাবে। সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে রিভিশন করতে পারবেন।
“কোনো সরকারি কর্মচারী বিদেশে কোনো রাষ্ট্রের নাগরিত্ব গ্রহণ করতে পারবেন না। কোনো কর্মচারী বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে তাকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে চাকরি অবসানের আদেশ দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলা করার প্রয়োজন হবে না, ওই আদেশই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। দ্বৈত নাগরিকত্ব যাদের আছে, তাদের বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার সময়ই সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। সাধারণ কর্মচারীদের অবসরের বয়স ৫৯ বছর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ৬০ বছরের কথা খসড়া আইনে বলা থাকলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়স নিয়ে কিছু বলা হয়নি বলে জানান শফিউল।
তিনি বলেন, চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর হলে যে কেউ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে ৩০ দিনের নোটিস দিয়ে অবসরে যেতে পারবেন। সরকার জনস্বার্থে ২৫ বছর চাকরির পর যে কাউকে কারণ না দেখিয়ে অবসরে পাঠাতে পারবে। চাকরি থেকে পদত্যাগ করলে চাইলে যে কোনো সময় করা যাবে। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর কেউ বিদেশে চাকরি নিতে বা ব্যবসা করতে চাইলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে না। এতদিন অবসরের পরে এসব করতে হলে অনুমোদন নিতে হত। কেন এই আইন করা হচ্ছে- সেই প্রশ্ন শফিউল বলেন, “সরকারি কর্মচারী আইন পৃথিবীর সব দেশেই আছে, আমাদের কোনো আইন ছিল না, তাই নতুনভাবে এই আইনটি করা হচ্ছে। এই আইন প্রণয়নে সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্কতাও আছে। নতুন এ আইন কার্যকর হলে ‘গুণগত পরিবর্তন’ আসবে- এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়ে শফিউল বলেন, এ আইন কার্যকর হলে এ সংক্রান্ত আগের ছয়টি আইন বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ