শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণার আগেই সেই রায়কে দয়া করে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না

বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট। আজ ২০১৮ সালের অগাস্ট পার হতে যাচ্ছে। মাঝ খানে অতিক্রান্ত হয়েছে ১৪টি বছর। এই ১৪ বছরে অনেক ঘটনা ঘটেছে। হামলার পরদিন ২২ আগস্ট দন্ডবিধির ১২০/বি, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২, ২০১, ১১৮, ১১৯, ২১২, ৩৩০, ২১৮, ১০৯ ও ৩৪ ধারায় মতিঝিল থানার এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা (নং-৯৭) দায়ের করেন। অতপর ২০০৮ সালের ৯ জুন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে সিএমএম আদালতে দু’টি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন সিআইডির সিনিয়র এএসপি ফজলুল কবির। ওই বছরই মামলা দু’টির কার্যক্রম দ্রুত বিচার আদালত-১ এ স্থানান্তর করা হয়। এ আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের ২৯/১১ (হত্যা),ও ৩০/১১ (বিস্ফোরক) মামলা দু’টির বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। পুরনো ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে পিডব্লিউডির একটি পুরনো সরকারি ভবনকে অস্থায়ী আদালত ঘোষণা করে এ মামলার বিচার কার্যক্রম চালানো হয়। 

এর পর অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দকে। জনাব আব্দুল কাহার আকন্দ তৃতীয় তদন্ত শুরু করেন। এই তদন্ত শেষে তিনি রিপোর্ট দাখিল করেন ২০১১ সালে। এই তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ২ জুলাই আদালতে সম্পূরক চার্জ শিট দাখিল করা হয়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের ২ বছর ৭ মাস পর গ্রেনেড হামলা মামলায় সম্পূরক চার্জ শিট দেয়া হয়। এই চার্জ শিটে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, আবদুস সালাম পিন্টু ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক মহা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম (অব), ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী সহ ৩০ জনকে আসামী করা হয়। অন্য কথায় ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা হলেও ৭ বছর পর বিএনপি নেতা তারেক রহমান এবং জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদকে আসামী করা হয় ঠিকই, তবে সেটি সম্পূরক চার্জ শিটে, অর্থাৎ তৃতীয় চার্জ শিটে। যে ব্যক্তি এই তদন্তটি পরিচালনা করেন সেই আব্দুল কাহার আকন্দ অন্তত ৬ বছর আগে পুলিশের চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। তার পরেও বিশেষ বিবেচনায় তাকে বার বার চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং তার হাত দিয়েই বিএনপি ও জামায়াত নেতা সহ ৩০ জনকে এই মামলায় আসামী করা হয়েছে। 

॥দুই॥

এরপর মোট ৫২ জন আসামির বিরুদ্ধে এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলতে থাকে। এর মধ্যে অন্য মামলায় জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং সিলেটে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল আলম বিপুলের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এ মামলার আসামিদের তালিকা থেকে তাদের বাদ দেয়া হয়। ফলে আসামীর সংখ্যা নেমে আসে ৪৯-এ। 

এই মামলা সম্পর্কে ওপরে পরিবেশিত তথ্যের চেয়ে আর বেশি কোনো তথ্য সাংবাদিকদের জানা ছিলো না। মামলা কোন পর্যায়ে আছে, কবে তার রায় হবে এসম্পর্কে দেশবাসী সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলেন। কিন্তু গত ঈদুল আযহার একদিন আগে একাধিক অন লাইন দৈনিকে এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয় যে, আগামী মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে এই মামলার রায় প্রকাশিত হবে। গত ১৯ অগাস্ট রবিবার আইন মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন যে, এই মামলার বিচারের জন্য গঠিত দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল সেপ্টেম্বর মাসেই এই মামলার রায় ঘোষণা করবে। এসম্পর্কে ডেইলি স্টারের রিপোর্টে বলা হয় যে, এখন এই মামলা শেষ করার পথে শুধু মাত্র সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতি মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ক্লোজিং আরগুমেন্ট শোনা বাকি আছে। এটি শুনতে লাগবে সর্বোচ্চ ৬ আদালত দিবস। এর মধ্যে পরবর্তী শুনানির দিন হিসাবে ধার্য্য করা হয়েছে ২৭,২৮ এবং ২৯ অগাস্ট। এই মামলার বিচারক শাহেদ নুরুদ্দিন। মামলা দুইটির একটি হলো হত্যা এবং আর একটি হলো বিস্ফোরক দ্রব্যের অধীন মামলা। ইতো মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের ২২৫ জন এবং আসামী পক্ষের ২০ জন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য দিয়েছেন। 

॥তিন॥

প্রিয় পাঠক, গভীর মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করুন যে, এই মামলা নিয়ে বিএনপি বা জামায়াত বিগত ১৪ বছর ধরে কোনো কথা বলেনি। আইন আদালতের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে বলেই বিএনপি এবং জামায়াত এখন পর্যন্ত চুপ আছে। কিন্তু এতদিন পর নির্বাচনের মাত্র ৪ মাস আগে শেখ হাসিনা হঠাৎ কথা বলা শুরু করেছেন। এবং শুধু কথা বলা নয়, এমন সব মন্তব্য করছেন যেসব মন্তব্য তার এখতিয়ারের সম্পূর্ণ বাইরে। যেগুলো কথা বলবেন বিচারকরা, সেই সব কথা বলা শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের। ওবায়দুল কাদের কোত্থেকে জানলেন যে সেপ্টেম্বরে রায় হবে? এটি সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার। অভিযোগ রয়েছে যে, নির্বাহী বিভাগ নাকি নি¤œ আদালতকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই খটকা হয়, ওবায়দুল কাদের সাহেবরা অর্থাৎ সরকারই কি নি¤œ আদালতকে বলছেন যে, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই রায় প্রকাশ করতে হবে? আর কি রায় লেখা হবে সেটিও তো সরকার হয় জেনে গেছে অথবা কি রায় লেখা হবে সেটি সরকার ডিকটেট করছে। না হলে ওবায়দুল কাদের কিভাবে বুঝলেন যে, গ্রেনেড মামলার রায় হলে বিএনপি আবারও রাজনৈতিক সংকটে পড়বে?

ওবায়দুল কাদের সব কথা বলেননি। বলেছেন অর্ধেক কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের আরও শীর্ষ পর্যায় নেতারা বাকি অর্ধেকটাও বলে দিয়েছেন। গত ঈদের দুই দিন আগে থেকে লাগাতার ভাবে তিনি বলে চলেছেন যে, গ্রেনেড হামলায় যে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান জড়িত এতে কোনো সন্দেহ নাই। তিনি বলেন, হামলার সময় সেখানে উপস্থিত সেনা গোয়েন্দা সংস্থার এক সদস্য তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ফোন করে এখানে কি হচ্ছে জানতে চাইলে তাকে ধমক দিয়ে সেখান থেকে সরে যেতে বলা হয়।

যেসব পুলিশ কর্মকর্তারা একটু সাহায্য করতে চেয়েছে তাদের সরকার ও বিএনপি’র পক্ষ থেকে তিরস্কার করে সেখান থেকে সরে যেতে বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী এ সময় খালেদা জিয়া এবং বিএনপি নেতাদের দেয়া বক্তব্যগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এর কয়দিন আগেই খালেদা জিয়া এবং বিএনপি বলেছিল হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধী দলের নেতাও হতে পারবে না। আর আওয়ামী লীগ আগামী একশ’ বছরেও ক্ষমতায় যেতে পারবে না।’ প্রধানমন্ত্রী এই কথা বলার পর গবেষকরা ঐ সময়কার বিভিন্ন পত্র পত্রিকার পাতা উল্টিয়েছেন। কিন্তু কোথাও শেখ হাসিনার ঐ সব কথা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

যে রায়টি ঘোষিত হতে যাচ্ছে সেটি নিয়ে এই ধরণের আগাম মন্তব্য করলে যে প্রতিক্রিয়া হতে পারে আলোচ্য ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে একটি রায়ের ব্যাপারে এত ডাইরেক্ট কথা বললে বিচারকরা, বিশেষ করে নি¤œ আদালতের বিচারকরা প্রভাবান্বিত হতেই পারেন। আর তা ছাড়া বিএনপি শুধু মামুলি বিরোধী দল নয়, অত্যন্ত শক্তিশালী বিরোধী দল। সুতরাং তারাও কঠোর ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিএনপি মহা সচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রায় সামনে রেখে যখন রাষ্ট্রের চিফ এক্সিকিউটিভ এধরনের কথা বলেন তখন বিচারকদের পক্ষে ন্যায় বিচার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এতদিন সরকার অভিযোগ করে আসছিলো যে, তারেক জিয়া এই হামলার সাথে নাকি সরাসরি জড়িত। এখন বলতে শুরু করা হয়েছে যে, শুধুমাত্র তারেক জিয়া নয়, খালেদা জিয়াও এই হামলার সাথে সরাসরি জড়িত। 

এমন একটি পটভূমিতে যা হওয়ার কথা তাই হয়েছে। শনিবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, এই মামলায় একটি ফরমায়েশি রায় হতে যাচ্ছে বলে তারা সন্দেহ করছেন। তিনি বলেন, মামলার রায় নিজেরা লিখে তা আদালতকে দিয়ে বাস্তবায়ন করাবেন কিনা, মানুষের মনে সে সংশয়ও এখন দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘তাদের আন্দোলনের ফসল মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের সময়ও এ মামলার চার্জশিটে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম ছিল না।’

রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের দলীয় লোক কাহার আকন্দকে তদন্তে কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। তার আগেই কাহার আকন্দ পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে অবসরে গিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন, এমনকি ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাকে পুলিশ বিভাগে ফের নিয়োগ দিয়ে এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা করা হয় ২০০৯ সালে। দলীয় চেতনার তদন্ত কর্মকর্তা কাহার আকন্দকে নিয়োগ দেয়ার উদ্দেশ্যই ছিল এ মামলায় তারেক রহমানকে জড়ানো। পরে ২০১১ সালে তারেক রহমানের নাম সম্পূরক চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করে শেখ হাসিনার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হয়।’

বিজ্ঞানে একটি কথা আছে। কথাটি হলো, Every action has its equal and opposite reaction. অর্থাৎ প্রতিটি কাজেরই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এখন এসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে রাষ্ট্র নেতারা বিরোধী দলকে হিট করে কথা বললে বিরোধী দলও পাল্টা আঘাত করবে। এটিই দুনিয়ার নিয়ম। সুতরাং আমাদের রাজনীতিতে এই আঘাত এবং পাল্টা আঘাতের সংস্কৃতি অবিলম্বে বড় বড় স্টেক হোল্ডারদের পরিত্যাগ করা উচিত। না হলে এই অগ্রিম কথা এবং পাল্টা কথার তোড়ে আমাদের নি¤œ আদালত তো বটেই, উচ্চ আদালতও প্রশ্ন বিদ্ধ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যেই উচ্চ আদালত কতগুলো মামলার পরিচালনা এমন ভাবে করেছে যার ফলে তাদের পরিচালন পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। সুতরাং আমাদের উচিত হবে, আইনকে তার নিজস্ব পথে চলতে দেয়া। 

আমরা যদি সেটি না করি, তাহলে যার যার সামাজিক মাধ্যমে গিয়ে দেখুন আমাদের মূল্যবোধ কত ভেসে যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এখন আর রাজনৈতিক গালি দেয়া হয় না, এখন যেটি করা হয় সেটি হলো প্রবল ঝগড়া ঝাটি। শুধুমাত্র মারা মারিটাই বাকি। সেটিও রাজনীতির অন্দরে ঢুকতে বেশি সময় নেবে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ