বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সংকটের অজুহাতে লবণ আমদানির পাঁয়তারা

দেশে যথেষ্ট পরিমাণ মজুদ থাকা সত্ত্বেও এবং নতুন উৎপাদন শুরুর মাস নবেম্বর এগিয়ে এলেও সংকটের অজুহাতে লবণ আমদানির পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে ভারতীয় মিল মালিকদের এদেশীয় এজেন্ট হিসেবে পরিচিত বিশেষ এক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। 

গতকাল দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ভারতীয় এজেন্টরা কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর নানা তথ্য-পরিসংখ্যান হাজির করার মাধ্যমে নিজেদের এই দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে যে, লবণের মজুদ আদৌ যথেষ্ট নয় এবং এখনই আমদানির ব্যবস্থা না করা হলে দেশে লবণ সংকট মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। জানা গেছে, ভারতীয় এজেন্টদের প্রচেষ্টা সফল হলে একদিকে তারাই আমদানি করার সুযোগ পাবে, অন্যদিকে বাংলাদেশে রফতানির একচেটিয়া সুযোগ পেয়ে বিপুল অর্থ আয় করবে ভারতের মিল মালিক ও লবণ ব্যবসায়ীরা।

বাস্তবক্ষেত্রে অনুসন্ধানে কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু কক্সবাজারে বিসিক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেছিলেন, দেশে পর্যাপ্ত লবণ মজুদ আছে। আর সে কারণে লবণ অমদানি করা হবে না। বিসিকও তখন জানিয়েছিল, মজুদের পরিমাণ এক লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। ওদিকে লবণ চাষিরা বলেছিল, পাঁচ লাখ মেট্রিক টনের বেশি লবণ অবিক্রিত অবস্থায় মাঠে পড়ে আছে। তাছাড়া নবেম্বর মাসে পুরোদমে লবণ উৎপাদন শুরু হবে। সুতরাং লবণের সংকট তৈরি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। একই কারণে ভারত থেকে লবণ আমদানি করারও প্রয়োজন পড়বে না। 

উল্লেখ্য, একদিকে লবণ চাষিরা অবিক্রিত অবস্থায় মাঠে পড়ে থাকা তাদের লবণ কিনে নেয়ার দাবি জানিয়েছিল, অন্যদিকে শিল্পমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, জেলা প্রশাসন, বিসিক ও মিল মালিকদের পাশাপাশি লবণ চাষিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে এবং যাচাই-বাছাই করে লবণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু শিল্পমন্ত্রীর সে আশ্বাসের পর বিশেষ করে বিসিকের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কমিটি গঠন করার বিষয়ে যেমন কোনো তথ্য জানা যায়নি, তেমনি মাঠ পর্যায়ে চালানো হয়নি অনুসন্ধানও। ফলে চাষিদের প্রায় পাঁচ লাখ টন লবণ এখনো অবিক্রিত অবস্থায় মাঠেই পড়ে আছে।

বিসিকের মাধ্যমে সরকারি পর্যায়ে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই মাঝখান দিয়ে ভারতীয় এজেন্টদের গোষ্ঠীটি লবণ আমদানির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা বানোয়াট বিভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যান হাজির করে বোঝাতে চাচ্ছে যেন এখনই আমদানি শুরু না করা হলে দেশে লবণের মারাত্মক সংকট দেখা দেবে! এমন অবস্থায় সর্বশেষ খবরে অবশ্য জানা গেছে, বিসিকের উদ্যোগে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। 

এদিকে দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে জানা গেছে, কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালি ও আনোয়ারা উপজেলার আংশিকসহ ওই এলাকায় ৬৪ হাজার ১৪৭ একর জমিতে লবণ চাষ করা হয়। লবণ চাষি রয়েছে ৫৫ হাজারের বেশি। কিন্তু নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লবণ উৎপাদন করলেও দালাল ও ফড়িয়াদের পাশাপাশি আমদানির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা চক্রের দৌরাত্ম্যের কারণে চাষিরা কোনো বছরই লবণের লাভজনক মূল্য পেতে পারে না। চাষিদের ঠকিয়ে মুনাফা লুটে নেয় মিল মালিক ও দালাল-ফড়িয়াসহ মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারাই লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমদানির চেষ্টা চালায়Ñ যেমনটি এই সময়েও চালাচ্ছে। তাদের ষড়যন্ত্রের কারণেই প্রতি বস্তা লবণ বর্তমানে সর্বোচ্চ ৭২০ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ মাত্র এক মাস আগেও প্রতি বস্তা লবণের দাম ছিল ৭৮০ টাকা। 

জানা গেছে, ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ায় চাষিরাও লবণ বিক্রি কমিয়ে দিয়েছে। অনেকে বিক্রিই করছে না। এজন্যই মাঠে পড়ে আছে পাঁচ লাখ টনের বেশি লবণ। অর্থাৎ লবণের মজুদ যথেষ্ট পরিমাণই রয়েছে। লবণের সরবরাহেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতীয় এজেন্টদের সিন্ডিকেট লবণ আমদানি করার জন্য জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের ভেতরে পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও ভারত থেকে লবণ আমদানির তৎপরতা অবশ্যই জাতীয় স্বার্থবিরোধী। সরকারের উচিত, আমদানির প্রস্তাব গ্রহণ করার পরিবর্তে অবিক্রিত অবস্থায় মাঠে পড়ে থাকা সমুদয় লবণ লাভজনক মূল্য দিয়ে চাষিদের কাছ থেকে কিনে নেয়ার ব্যবস্থা করা। এভাবে পাঁচ লাখ টনের বেশি লবণ কিনে বাজারে সরবরাহ করা হলে লবণের দাম যেমন কমে আসবে ও স্থিতিশীল হবে, লোকসানের শিকার চাষিরাও তেমনি নতুন উদ্যমে লবণ চাষের ব্যাপারে উৎসাহিত হবে। সরকারকে একই সঙ্গে দালাল-ফড়িয়া তথা মধ্যস্বত্বভোগী এবং অসৎ মিল মালিকসহ ভারতীয় এজেন্টদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে লবণ চাষিরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে লক্ষ্যেও পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সব মিলিয়ে আমরা চাই, চাষিরা যাতে লোকসানের শিকার না হয় এবং দেশে যাতে লবণের সংকট তৈরি না হতে পারে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ