শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

কালের স্মৃতিচিহ্ন তিন গম্বুজের নিরব অলঙ্কার ‘হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ’

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : ঢাকা চারশ’ বছরেরও অধিক প্রাচীন নগরী। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের রাজধানী। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ঢাকা এখন অনেক আধুনিক শহর। অনেক অধুনিক স্থাপনা ঢাকা শহরকে অনিন্দ্য সুন্দর করে তুলেছে। আধুনিক স্থাপত্যে ঝলমল করে উঠলেও এর আড়ালে এখনো মনোমুগ্ধকর প্রচুর প্রাচীন নিদর্শন টিকে আছে আপন মহিমায়। এমনই এক মসজিদ হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ। মসজিদ আল্লাহর ঘর। মানুষ তার পার্থিব জীবনে এই ঘর নির্মাণের মতো মহৎ দায়িত্ব পালন করে গেছে যুগে যুগে। তাই মসজিদ হয়ে উঠেছে সময়ের সবচেয়ে বড় ইতিহাসের মঞ্চ কিংবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের পাঠশালা। মসজিদ যেমন মহান, তেমনি মসজিদ তার নির্মাতাকেও চিরয়াত মহান করে রাখে। হাজী খাজা শাহবাজ ছিলেন একজন অভিজাত ধনী ব্যবসায়ী, যিনি কাশ্মীর হতে সুবা বাংলায় এসে টঙ্গী এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। ১৬৭৯ সালে (১০৮৬ হিজরি) তিনি জীবিত থাকাকালেই এই মসজিদ ও নিজের মাজার নির্মাণ করেন। তৎকালে সুবাহদার ছিলেন শাহজাদা মুহম্মদ আজম। মোগল শাসনামলে শাহজাদা মুহাম্মদ আজমের সময়কালে মসজিদটি নির্মিত হয়। এখনো কালের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে টিকে আছে তিন গম্বুজের নিরব অলঙ্কার সুফি-সাধক হাজী খাজা শাহাবাজের মসজিদ।
মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী: হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ রাজধানীর রমনা এলাকায় অবস্থিত। মসজিদটি হাইকোর্টের পিছনে এবং তিন নেতার মাজার এর পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত। এর চত্বরে হাজী শাহবাজের সমাধি অবস্থিত। মসজিদ ভবনটির স্থাপত্যে উত্তর ভারতীয় মোঘল-রীতিতে নির্মিত। বর্তমানে ঢাকায় যত মুঘল মসজিদ আছে তাদের মধ্যে সংরক্ষণের দিক থেকে খান শাহাবাজ মসজিদ সম্ভবত সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে। তবে সামনের তিন নেতার মাজার মসজিদের সৌন্দর্য অনেকটাই নষ্ট করে ফেলেছে, সামনের দিক থেকে বোঝাই যায় না পিছনে কোনো স্থাপত্য আছে কি না। যদিও যে-কোনো সংরক্ষিত স্থাপনার আশে পাশে নতুন স্থাপনা গড়তে হলে নিয়ম অনুযায়ী এই সব বিষয়গুলো খেয়াল করার কথা, কিন্তু এখানে তার কোনোটাই মানা হয় নি। মোঘল শাসনামলে শাহজাদা মুহাম্মাদ আজমের সময়কালে ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মিত হয়। দৈর্ঘ্যে মসজিদটি ৬৮ ফুট ও প্রস্থে ২৬ ফুট। এতে তিনটি গম্বুজ রয়েছে। একমাত্র এই তিনটি গম্বুজ ছাড়া মসজিদটি আর কোনো স্থাপত্যশৈলী এখন আর টিকে নেই। হাজী শাহবাজ ছিলেন একজন অভিজাত ধনী ব্যবসায়ী, যিনি কাশ্মীর হতে সুবা বাংলায় এসে টঙ্গী এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। ১৬৭৯ সালে তিনি জীবিত থাকাকালেই এই মসজিদ ও নিজের মাজার নির্মাণ করেন। মসজিদটির বয়স ৩৩৮ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। মসজিদের মিম্বর ও চৌকাঠ পাথরের তৈরী।
সমাধিসৌধ: খাজা শাহবাজ মসজিদের পাশেই নিজের জন্য সমাধিসৌধ নির্মাণ করেছিলেন। সৌধের কাঠামো প্রায় মসজিদের মতো। এ কারণে এটি জোড়া মসজিদ নামেও পরিচিত। মসজিদের আঙিনাতেই খাজা শাহবাজকে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধিসৌধ খাজা শাহবাজের দরগা নামে পরিচিত। মসজিদের আঙিনায়ই রয়েছে খাজা শাহবাজের মাজার শরীফ। এখানে নারীরাও আসতে পারেন। শুক্রবার জুমার নামাজের আগ পর্যন্ত ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মাজার শরীফে নারীদের প্রবেশাধিকার রয়েছে।
মসজিদের আঙিনায় এলেই পালায় জিন! : কথিত আছে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণকে ইঙ্গিত করে অনেকেই বলে থাকেন মানুষটিকে বদ জিনে ধরেছে। তাই তাকে সুস্থ করতে ফকির, ওঝা বা এলাকার ইমামকে ডেকে এনে চলে ঝাড়-ফুঁক। গ্রামে গঞ্জে এ দৃশ্যটি খুবই পরিচিত; জিন ছাড়াতে ওঝা আসে, তার এলাহী কা- দেখতে রোগীর বাড়িতে ভিড় জমায় পাড়ার মানুষ। কিন্তু ঢাকার হযরত হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদের খাদেম বলছেন, কোন ঝাড়-ফুঁকের দরকার নাই, এই মসজিদের আঙিনায় পা দিলেই মানুষের ওপর আছর করা জিন নাকি পালিয়ে যায়! তিনি জানান, প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসে জিন ছাড়াতে। এখানে পা রাখলেই তারা সম্পুর্ণ ভালো হয়ে যায়। তাই যারা জানেন তারা দেশের দূর-দূরান্ত থেকে এখানে আসেন। জনশ্রুতি আছে, ঢাকার ধনাঢ্য বণিক ও সুফি শাহজাদা খাজা শাহবাজ নাকি টঙ্গি থেকে এখানে এসে জিনদের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন।
নামকরণ: প্রায় সাড়ে ৪শ’ বছর আগে ওই জায়গাটি মসজিদ নির্মাণের জন্য বেছে নেন সুফি সাধক এবং ধনী ব্যবসায়ী হজরত হাজী খাজা শাহবাজ। তাঁর নামেই পরিচিত এই মসজিদটি এখনও টিকে রয়েছে কালের সাক্ষী হয়ে। শায়েস্তা খান আমলের স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত নির্মাণ করা নান্দনিক এ মসজিদ নিয়ে প্রচলিত আছে নানা লোকগাঁথা। কেউ একে বলে জিনের মসজিদ, কারো কাছে পরিচিত জোড়া মসজিদ নামে। খাজা শাহবাজ মসজিদের পাশেই নিজের জন্য মাজার নির্মাণ করেছিলেন। মাজারের কাঠামোও প্রায় মসজিদের মতো। এ কারণে এটি জোড়া মসজিদ নামেও পরিচিত। আবার আগে দেয়ালের রং লাল থাকায় মসজিদটি ‘লাল মসজিদ’ নামেও পরিচিতি পায়। নান্দনিক এ মসজিদ নিয়ে প্রচলিত আছে নানা লোকগাথা।
আকর্ষণীয় গঠনাকৃতি: তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি ৬৮ ফুট দীর্ঘ এবং ২৬ ফুট চওড়া। এর মিম্বর এবং চৌকাঠ কালো পাথরের তৈরি। মসজিদের চার কোণে চারটি অষ্ট কোনাকৃতির মিনার রয়েছে। পূর্ব দিকের দেয়ালে আছে তিনটি প্রবেশপথ।
দক্ষিণ ও উত্তর দেয়ালে একটি করে দরজা রয়েছে। এ অঞ্চলে জলবায়ুর আর্দ্রতার কারণে মসজিদের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য দেয়ালে পাথরের আবরণ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি দরজার চৌকাঠ কালো পাথর দিয়ে তৈরি। ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে তিনটি আকর্ষণীয় মেহরাব আছে। প্রধান মেহরাবের অলংকরণ বেশ সুন্দর। মসজিদের পাশেই রয়েছে হাজী খাজা শাহবাজের মাজার ইমারত। এটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। মসজিদের স্থাপত্য নকশা মুসা খাঁ মসজিদ বা লালবাগ কেল্লার মসজিদের মতোই।
বর্তমান অবস্থা: বর্তমান মসজিদটি অতটা জমজমাট নেই, হাইকোর্ট ও বাংলা একাডেমি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আশেপাশের এলাকার মানুষ মাঝে মাঝে এখানে নামাজ পড়তে আসেন। তবে জুম্মার দিনে মসজিদটি জমজমাট হয়ে ওঠে বলে জানান মসজিদের খাদেম। কারণ ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসেন শহরের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। মসজিদটির একটি পরিচালনা কমিটি রয়েছে। এই কমিটিতে রয়েছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সদস্যসহ অন্যরা। তারাই এটি দেখভাল করেন। তাছাড়া মসজিদের দানবাক্সে যে অর্থ থাকে তা দিয়েই চলে কার্যক্রম। কালের আবর্তে ঐতিহাসিক এ স্থাপনার এখন জীর্ণদশা। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৪০০ বছরের মসজিদটির জৌলুস। দেয়ালে শ্যাওলা জমে ধারণ করছে কালচে রং। বিভিন্ন জায়গায় খসে পড়েছে চুন-সুরকি। দেয়ালের দু-এক জায়গায় ফাটলও দেখা গেছে। তবে নান্দনিক নকশা বিশিষ্ট ভেতরটা এখনও বেশ পরিপাটি। আমরা চাই না মসজিদটি ক্রমে হারিয়ে যাক। অর্থাৎ এর যথাযথ সংস্কার জরুরি। এর সংস্কার কাজ হলে এখানে মুসল্লিদের সমাগম আবার বাড়বে। তাছাড়া মসজিদটি একটি ধর্মীয় দর্শনীয় স্থাপনাও। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য।
যেভাবে যাবেন: দেশের যে কোনো স্থান থেকেই ঢাকা আসার জন্য বাস সার্ভিস রয়েছে। এছাড়াও ট্রেনে করে কিংবা কিছু কিছু জায়গা থেকে লঞ্চে অথবা বিমানে করেও আসা সম্ভব।
ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে তিন নেতার মাজার অথবা হাইকোর্ট এরিয়া তে এসে আশে পাশের মানুষকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দিবে। ঢাকার দোয়েল চত্বরের একটু সামনে হাতের ডাইনে বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে লাল মসজিদ। বাংলা একাডেমি পার হয়ে হাতের বাম দিকে তিন নেতার মাজার আর তার পাশেই আসলে হাজী শাহবাজ মসজিদ। এর উল্টো দিকেই কার্জন হল। তিন নেতার মাজারের সামনের রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই মসজিদটির প্রবেশপথ। এই মসজিদকে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ ঘোষণা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তাতে মসজিদটির অনিষ্ট বা বিকৃত না করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। সাইনবোর্ড পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ডান দিকে গেলেই মসজিদ। বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাগোয়া এই মসজিদের কাছেই ঢাকা গেট, যার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল মসজিদ নির্মাণের ২০০ বছর পর। অনেকেই মনে করেন, শাহবাজের মসজিদটিই রমনা এলাকার প্রথম স্থাপনা। 
কোথায় থাকবেন: ঢাকার প্রতিটি এলাকায় আবাসিক হোটেলের অভাব নেই। তবে হোটেল ভাড়া অন্যান্য জেলা থেকে তুলনামূলক বেশি। ৫ তারকা হোটেলগুলোর মধ্যে রয়েছে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ, হোটেল ইন্টারকন্টিন্যান্টাল, হোটেল লা মেরিডিয়েন, র‌্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন ইত্যাদি। কম দামের মধ্যে থাকতে গেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এর হোটেল রমনা, ফকিরাপুলের হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনাল অন্যতম। এছাড়া পল্টন, ফকিরাপুল, গুলিস্তান, পুরান ঢাকা এলাকায় অনেক সস্তা মধ্যম মানের হোটেল পাবেন।
পুরান ঢাকার কিছু বিখ্যাত খাবারের নাম : লালবাগ শাহী মসজিদের সাথে মোহন মিয়ার জুস, হোটেল রয়েলের পেস্ত বাদামের সরবত, বেচারাম দেউড়ি রোডে নান্নার মোরগ পোলাও, কাজি আলাউদ্দিন রোডের হাজির বিরিয়ানি ও হানিফের তেহরি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ