বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

৩৬ টাকা দরে ৬ লাখ টন আমন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : সরকারের ধানের বদলে চাল কেনার সিদ্ধান্তের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কৃষকরা। তাদের অভিযোগ সরকার চাল কেনার সিদ্ধান্তের ফলে কৃষকদের ধান উৎপাদনের খরচ উঠবে না। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চাষিরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে কৃষকদের। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।
জানা গেছে, চলতি আমন মওসুমে ৬ লাখ টন আমন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রতিকেজি চাল ৩৬ টাকা দরে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে এই চাল কেনার কার্যক্রম। চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সরকার গত বছর ৩৯ টাকা দরে ৬ লাখ টন আমনের চাল সংগ্রহ করেছিল। সে হিসাবে এ বছর ৩ টাকা কমে চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গতকাল রোববার সচিবালয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভা শেষে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। খাদ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ কমিটির সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য আধিদফতর এবং খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, তাতে কৃষক লাভবান হবে। এ চাল সংগ্রহে সরকারের কোনো অসুবিধা হবে না। তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ছয় লাখ টন আমন চাল সংগ্রহ করা হবে। পরবর্তী সময়ে যদি সন্তোষজনক হয়, তবে আমরা আরও ২-৩ লাখ টন সংগ্রহ করবো। তবে সেটা পরবর্তী সময়ে দেখা যাবে।
কামরুল ইসলাম বলেন, বাজারে ৩৩ থেকে ৩৫ টাকায় চাল পাওয়া যাচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উৎপাদন খরচ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উৎপাদন খরচের মধ্যে সামান্য কিছু হেরফের আছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী উৎপাদন খরচ কোনো অবস্থাতেই ৩৫ টাকার বেশি হয় না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উৎপাদন খরচটা একটু বেশি ধরা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ-খবর নিয়ে আমরা আমনের ক্রয়মূল্য ৩৬ টাকা নির্ধারণ করেছি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী উৎপাদন খরচ ৩৫ টাকার কাছাকাছি পড়ে।
সভায় জানানো হয়, সরকারি খাদ্য গুদামে চাল ও গমসহ এই মুহূর্তে ১২ লাখ ১৮ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। এরমধ্যে চাল ৯ লাখ ৬৮ হাজার টন।
উল্লেখ্য, গত ১৩ নবেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমন উৎপাদন ব্যয় প্রাক্কলন সংক্রান্ত এক সভায় প্রতি কেজি আমন ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৫ টাকা ৩০ পয়সা ও চালের উৎপাদন ব্যয় ৩৭ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিলো সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যমন্ত্রণালয় চাল কেনার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কোনোভাবেই কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ হয়নি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যে যেখানে প্রতিকেজি চালের উৎপাদন খরচ ২৭ টাকা ৯০ পয়সা ধরা হয়েছে সেখানে খাদ্য মন্ত্রণালয় কিভাবে ৩৬ টাকা নির্ধারণ করে সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। তারা বলেন, প্রকৃতপক্ষে চাল উৎপাদন খরচ আরও বেশি।
সাধারণত সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে সরকার। আর চাল সংগ্রহ করা হয় মিলারদের কাছ থেকে। বর্তমানে চালের বাজারে চলছে বিশৃঙ্খলা। নেই কোনো তদারকি। এতে উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। ফলে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে চলতি মওসুমসহ ৪টি উৎপাদন মওসুমে কার্যত ধান সংগ্রহ করেনি সরকার। মিলার ও সিন্ডিকেটের স্বার্থে রক্ষার্থে সংগ্রহ করা হয়েছে চাল। সরকারীভাবে ধান সংগ্রহ হলে বাজারে ফড়িয়া, আড়তদার, পাইকারী ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেট এককভাবে মূল্য নির্ধারণ করে কৃষক ঠকানোর সুযোগ পায় কম। আপদকালীন মজুদ ও কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণে সাধারণত উৎপাদন মৌসুমে ধান সংগ্রহ হয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। গত বছরের বোরো ও রোপা আমন এবং চলতি বছরের বোরো ও আমন উৎপাদন হয় আশানুরূপ। এই ৪টি মওসুমে বাজারে গড়ে ধানের মূল্য কম অথচ চালের মূল্য বেশি হয়েছে। এর কারণ কি, গলদ কোথায়, তা নির্দ্দিষ্ট করে বলতে পারেনি কৃষি ও খাদ্যসহ সংশ্লিষ্ট কোনো বিভাগই।
কৃষকদের অভিযোগ, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখে না। ধানের ন্যায্যমূল্য পায়নি কৃষকরা। তাছাড়া ধানের বাজারে বিশৃঙ্খলা সিন্ডিকেটের দাপট কমছে না। এতে ধান আবাদ ও উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কৃষকরা। উৎপাদন খরচ উঠছে না। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে চাষিরা। চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের মাঠপর্যায়ের কয়েকজন কৃষি কর্মকর্তা জানান, কৃষকের অভিযোগ শতভাগ সত্য। গ্রামে গ্রামে সাধারণ কৃষকরা ধান উৎপাদন করে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ইতোপূর্বে অধিদপ্তর ধান ক্রয়ের ঘোষণা দেওয়ার পর পিছিয়ে আসে। সিদ্ধান্ত হয় শুধু চাল ক্রয়ের। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ কম। কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের কথা, জমিচাষ, বীজ, চারা লাগানো, পরিচর্যা, সার, কীটনাশক, সেচ, ধান কাটা ও মাড়াইসহ বাজারে তোলা পর্যন্ত প্রতি বিঘায় মোটা ধান উৎপাদনে গড়ে খরচ পড়ে ন্যুনতম ৭শ’ টাকা। সেই ধান বাজারে বিক্রি হয়েছে ভরা মওসুমে সাড়ে ৬শ’ টাকা। মওসুম জুড়ে খরচ ও পরিশ্রম করে লাভের বদলে হচ্ছে লোকসান। অভিযোগ উঠেছে সিন্ডিকেটের স্বার্থ সংরক্ষণে এটি করা হয়েছে।
সূত্রমতে, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় তার জের টানতে হচ্ছে কৃষকদের। আবার ভোক্তাদেরও বাড়তি মূল্যে ক্রয় করতে হচ্ছে চাল। খাদ্য অধিদপ্তর এবার ৩৬টাকা কেজি দরে ৬লাখ মেট্রিক টন চাল ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে মিলারদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে। কৃষকদের নয়। উপরন্তু মিলাররা কৃষকদের কাছ থেকে কম মূল্যে ধান ক্রয় করে বেশি মূল্যে বাজারে চাল বিক্রি করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উৎপাদক চাষির স্বার্থ সংরক্ষণ সবচেয়ে বেশি জরুরি। তারা অব্যাহত মার খেলে ধান উৎপাদনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। তাদের দাবি কৃষকের স্বার্থে ধান ক্রয় করা হোক। চাল ক্রয়ে চাতালের মালিক ও আড়তদার তথা পুঁজিপতিদের সেবা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকরা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ