বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট দানের দায়িত্ব

এম. কে. দোলন বিশ্বাস : ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট প্রদান স্বাক্ষ্য দানের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র আল কুরআনের সূরা আল-মায়েদা’র ৬ থেকে ৯ আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয় থেকে জানা যায় যে, আরবী ‘শাহাদাৎ’ শব্দ থেকে বাংলায় স্বাক্ষ্য শব্দটির উৎপত্তি। যা বাংলায় স্বাক্ষী বা স্বাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শাহাদাৎ কিংবা স্বাক্ষী সম্পর্কে জানা অতিব জরুরি ও অত্যাবশ্যকও বটে। আজকাল শাহাদাৎ তথা স্বাক্ষ্য দানের যে অর্থ সর্বসাধারণের মধ্যে সু-প্রসিদ্ধ লাভ করেছে, তা শুধু মামলা-মোকাদ্দমায় কোনো বিচারকের সামনে স্বাক্ষ্য দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু কোরআন ও সুন্নাহর সর্বপরি ইসলামের দৃষ্টিতে ‘শাহাদাৎ’ শব্দটি আরও ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হয়। এতে বিন্দু মাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই।
উদাহরণরত বলা যেতে পারে, জাতীয় সংসদ, সিটি, উপজেলা ও ইউনিয়র পরিষদ ও কাউন্সিল ইত্যাদিসহ প্রচলিত সব ধরনের নির্বাচনে ভোট দেয়াও এক প্রকার স্বাক্ষ্য দান। এতে ভোট দাতার পক্ষ্য থেকে স্বাক্ষ্য দেয়া হয় যে, আমার মতে এ বা উমুক ব্যক্তি ব্যক্তিগত যোগ্যতা, সততা ও বিশ্বস্ততার দিক দিয়ে জাতির প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য। এ ব্যাপারে পবিত্র আল-কুরআনে উল্লেখ্য রয়েছে ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইনসাফের সঙ্গে আল্লাহর জন্য স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়াও।’ (সূরা আন-নিসা : ১৩৫) এখন একটু ধির মস্তিস্কে গভীরভাবে চিন্তা করুন- আমাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে ক’জন এমন আছেন, যাদের বেলায় এ স্বাক্ষ্য সত্য ও বিশুদ্ধ হতে পারে?
ভোট প্রদানের অর্থ হল- দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি, অগ্রগতি ও কল্যাণের লক্ষ্যে নিজের সমর্থন তথা স্বাক্ষ্য দেয়ার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা দলকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মনোনীত করা। তবে এক্ষেত্রে ইসলামে কিছু বিধি-নিষেধ রয়েছে। কারণ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর জন্য সত্যের স্বাক্ষ্য প্রতিষ্ঠা করো।’ (সূরা আত তালাক : ২)
ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট প্রদানকে আমরা চারটি বিষয়ের সমষ্টি বলতে পারি। এক. দায়ত্ববদ্ধতা। দই. স্বাাক্ষ্য প্রদান। তিন. সুপারিশ। চার. প্রতিনিধিত্বের অথরিটি প্রদান তথা সম্মিলিত অধিকার সম্পর্কে ওকালতি করা। শরীয়তে উপরোক্ত চারটি বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, প্রতিটি মানুষ সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে কোনো না কোনো বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রত্যেকেরই একে অপরের প্রতি কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা রয়েছে। এ দায়বদ্ধতার বিষয়ে কিয়ামতের দিন প্রত্যেককেই জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই কিয়ামতের দিন তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।’ (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
অপরদিকে কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা তৈরির এবং রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য প্রতিনিধিত্বের সনদ দেয়ার মানে হচ্ছে- প্রতিনিধিত্ব দানকারী ভোটার প্রার্থীর ভবিষ্যত সকল কার্যকলাপের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিচ্ছে। এমনিভাবে সুপারিশের বিষয়টিও প্রনিধানযোগ্য।
ভোট দেশের প্রতিটি নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। ভোট ব্যক্তির নিজস্ব মতামত কিংবা জনমত প্রতিফলনের একটি গণতান্ত্রিক মাধ্যম ও পদ্ধতিবিশেষ। কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে ভোটের প্রয়োজন হয়। রাজনীতিতে ভোট এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে একজন প্রার্থী গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার ব্যবস্থার কোনো না কোনো পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
যারা ভোট প্রয়োগ করেন তাদেরকে ভোটার বলা হয়। সে হিসেবে বলা চলে, জনপ্রতিনিধিদের নিয়োগকর্তা ভোটাররা।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে দায়িত্বশীল মুসলিম জনপ্রতিনিধি, সে যদি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা এবং খিয়ানতকারী অবস্থায় মারা যায়, তাহলে আল্লাহতায়ালা তার জান্নাতে প্রবেশ করা হরাম করে দেবেন।’ (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
ভোট দেওয়া একটি মতামত, একটি রায় ও স্বাক্ষ্য বিশেষ। এটা মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার নিকট গচ্ছিত আমানত। কুরআনে কারীমে এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, “হে ঈমানদার বান্দারা, তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের সঙ্গে কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং জেনে-শুনে নিজেদের আমানতেরও খিয়ানত করো না।” (সূরা আল আনফাল : ২৭)
যেহেতু ভোট একটি রায় বা স্বাক্ষ্য তাই এ ভোট প্রদানের ব্যাপারে প্রত্যেক নাগরিককে সচেতন হতে হবে। কেননা, অন্যায় করা আর অন্যায়কে সমর্থন করা একই অপরাধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, “কল্যাণকর কাজ এবং তাকওয়ার ব্যাপারে একে অপরের সহযোগিতা করো। আর গোনাহ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করো না।” (সূরা আল মায়েদা : ২)
দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আমাদের জনগণ আজকাল নির্বাচনকে একটি হার-জিদের খেলা মনে করে আসছে। এ কারণে কখনও পয়সার বিনিময়ে ভোটাধিকার বিক্রয় করা হয়। কখনও চাপের মুখে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হয়। আবার কখনও সাময়িক বন্ধুত্ব এবং কারও কারও কিছু সস্তা অঙ্গীকারের মিছা ভরসায় ভোটাধিকার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাস্তবিক পক্ষে এরূপ করা মোটেও ঈমানদার ও বুদ্ধিমত্ত্বার কাজ নয়। মনে করুন, আপনি আপনার ভোটাধিকার স্বীয় পছন্দের প্রার্থীর নিকট মোটা অংকের মাশুরা বা সেলামী নিয়ে কিংবা বন্ধুত্বের খাতিরে অথবা কোনো পেশীশক্তির হুমকিতে আপনার ভোটাধিকার প্রদান করলেন। যার ফলে উক্ত প্রার্থী বিজয় হল। কিন্তু পরক্ষণেই দেখা গেলো যে, সে প্রতিনিধির যোগ্য নয়্। তাকে দ্বারা সমাজ পরিচালনা করা যাবে না। সে একজন মিথ্যবাদী, স্বার্থনেষী, স্বীয় উদ্দেশ্য উপনীত ব্যক্তি। তাকে দ্বারা সমাজের উন্নয়ন তো দুরের কথা, কোনো প্রকার নিয়ম-নীতি আশা করাও কাম্য নয়। মনে করুন, যদি এমনই হয়, তাহলে আপনার বিবেককে প্রশ্ন করুন; আপনার ভোটাধিকার প্রদানের কাজটি ভালো করেছেন নাকি বাস্তবিক পক্ষেই ভুল করেছেন?
আপনি হয়তো আপনার পছন্দের প্রার্থীকে ভোটাধিকার প্রদান করে সামান্যতম উপকৃত হতে পারেন। বাস্তবিক পক্ষে এটা উপকৃতের চেয়ে অ-উপকৃতের দিকটাই বেশি প্রভাব ফেলবে। কেননা, আপনি সামান্যতম উপকৃত হওয়ার লোভে একজন অসৎ প্রতিনিধি বিজয় করেছেন। যার ফলে সেই অসৎ প্রতিনিধি ক্ষমতা পেয়ে সমাজে অ-সামাজিক কার্যকলাপ করে গোটা সুস্থ সুশান্ত নীরব সমাজটাকে ধ্বংসের দিকে ঢেলে দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন উঠে, ভোটাধিকার প্রদানের সময় আপনি কেবল মাত্র একা উপকৃত হতে পারেন।
আর এখন গোটা সমাজ নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হচ্ছে। উক্ত প্রতিনিধির হীনকাজের পাপ অথবা ভালো কাজের সওয়াব ইসলামের দৃষ্টিতে আপনাকেও বহন করে কাল হাশরের ময়দানে জবাব দিহিতা করতে হবে। এর ফলশ্রুতি এই যে, ভোট দাতার ভোটাধিকার প্রদানের রায়ে কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে তার কর্মজীবনে যে সবভ্রান্ত ও অবৈধ কাজ করবে; তার পাপ ভোট দাতাও বহন করবে। পক্ষান্তরে সে যদি ভালো কাজ করে, তার সওয়াবও ভোট দাতাও পাবে।
এ ব্যাপারে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যে দায়িত্বশীল মুসলিম জনপ্রতিনিধি, সে যদি তাদের সঙ্গে প্রতারণা এবং খিয়ানতকারী অবস্থায় মারা যায়, তাহলে আল্লাহতায়ালা তার জান্নাতে প্রবশ করা হরাম করে দেবেন।’ (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
আল-কোরআনের ভাষায় ‘যে ভালো সুপারিশ করবে সে তার সওয়াবের ভাগী হবে। আর যে মন্দ সুপারিশ করবে সেও মন্দের হিস্যা পাবে।’ (সূরা নিসা : ৮৫)
পবিত্র মহাগন্থ আল-কোরআনে ভোট প্রদানে এতো কঠিন সতর্কবাণী থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে লক্ষ্য করা যায় যে, মূর্খ অথবা জ্ঞানহীনেরা তো সু-দুরের কথা, লেখা-পড়া জানা ধার্মিক মুসলমানও অযোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিতে গিয়ে একটুকুও চিন্তা করেন না যে; সে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দিয়ে খোদায়ী অভিশাপ ও শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
কুরআনের দৃষ্টিতে প্রতিনিধি বা প্রার্থী নির্বাচনের জন্য ভোট দেয়া দ্বিতীয় একটি দিক রয়েছে। যাকে শাফায়াত বা সুপারিশ বলা হয়। ভোট দাতা ব্যক্তি সুপারিশ করে যে, অমুক প্রার্থীকে প্রদিনিধিত্ব দান করা হোক। কোরআনের পরিভাষায় এ সম্পর্কীত নির্দেশ পূর্বেই বর্ণিত রয়েছে। যেমন- কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে; যে ব্যক্তি উত্তম ও সৎ সুপারিশ করবে, যার জন্যে সুপারিশ করে তাকে তার পূণ্য থেকে অংশ দেয়া হবে। এছাড়া যে ব্যক্তি মন্দ ও মিথ্যা সুপারিশ করবে, সে তার মন্দ কর্মের অংশ পাবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভোটের তৃতীয় দিক হচ্ছে ওকালতির দিক। অর্থাৎ ভোট দাতা প্রার্থীকে প্রতিনিধিত্বের জন্যে উকিল নিযুক্ত করে। কিন্তু এ ওকালতি যদি ভোট দাতার ব্যক্তিগত অধিকার সম্পর্কে হতো এবং এর লাভ-লোকসান কেবল মাত্র সে-ই পেতো। তবে এর জন্যে সে নিজেই দায়ী হতো। কিন্তু এখানে ব্যাপারটি তেমন নয়। কেননা ওকালতি এমন সব অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত; যাতে তার সাথে সমগ্র জাতিও শরীক। কাজেই কোনো অযোগ্য ব্যক্তিকে স্বীয় প্রতিনিধিত্বের জন্যে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করলে গোটা জাতির অধিকার খর্ব করার পাপও ভোট দাতার কাঁধে চেপে বসবে।
মনে রাখতে হবে, ভোট প্রদান বিষয়টি শুধু পার্থিব নয়, পরকালেও এ জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এ বিষয়টি চিন্তা-ফিকির করেই বহুল আখাঙ্কিত আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্মানিত ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এমনটাই সব পক্ষের প্রত্যাশা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মোট কথা, আমাদের ভোটের ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাক্ষ্য প্রদান, সুপারিশ করা ও সম্মিলিত অধিকার সম্পর্কে ওকালতি করার বিষয়ে এ তিনটি দিক রয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সৎ, ধর্মভীরু ও যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট প্রদান করা যেমন বিরাট সওয়াবের কাজ এবং এর সুফল ভোট দাতাও প্রাপ্ত হয়। তেমনই অযোগ্য ও অধর্ম পরায়ন ব্যক্তিকে ভোট দেয়া মিথ্যা স্বাক্ষ্য দান, মন্দ সুপারিশ এবং অবৈধ ওকালতির অন্তর্ভুক্ত। এসবের মারাত্মক ফলাফলও ভোট দাতার আমলনামায় লিপিবদ্ধ হবে। তাই ভোট প্রদানের আগে প্রার্থী সংশ্লিষ্ট কাজের যোগ্যতা রাখে কি-না; এবং সে সৎ ও ধর্মভীরু কি-না; তা যাচাই করে দেখা প্রত্যেক মুসলমান ভোটারের অবশ্য ঈমানি কর্তৃব্য। শৈথিল্য ঔদাসান্যবসতঃ অকারণে বিরাট পাপের ভাগিদার হওয়া উচিত নয়। কাজেই ভোট প্রদানে সময় থাকতে ‘ঈমানদার’ সাবধান।
লেখক : দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ