শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

একটা অসত্য বিষয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত পুনরাবৃত্তি

রেজা শাহ : বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস প্রসঙ্গে ভারতীয়রা আরো একবার তাদের সংকীর্ণ মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বিবিসির রিপোর্ট উদ্ধৃত করে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ভারতের সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীসহ সশস্ত্র বাহিনীসমূহের প্রধানরা তো বটেই, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন রাজ্যের মন্ত্রী ও রাজনীতিকরাও ১৬ ডিসেম্বরকে নিজেদের বিজয় দিবস হিসেবে উল্লেখ করে ভারতীয় সেনাদের বীরত্বের মহিমা তুলে ধরেছেন। বাদ যাননি খেলোয়াড় এবং তারকারাও। প্রায় সকলেই তাদের বাণী ও টুইটারে দিনটিকে কেবলই ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসাধারণ সাফল্যের দিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদি তার টুইটে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের যে নির্ভিক সেনারা লড়াই করেছিলেন আজকের বিজয় দিবসে তাদের অদম্য সাহসকে স্মরণ করি। তাদের বীরত্ব আর দেশপ্রেমই আমাদের দেশকে সুরক্ষিত রাখতে পেরেছে। তাদের এই মহান আত্মত্যাগ প্রত্যেক ভারতীয়কে চিরকাল অনুপ্রাণিত করবে।’ এ প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে রিপোর্টে একটি তথ্য স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। সে তথ্যটি হলো, প্রধানমন্ত্রী মোদি সাধারণত বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানানোর কোনো সুযোগ বা উপলক্ষ হাতছাড়া করেন না। কিন্তু এবারের উপলক্ষ বাংলাদেশের বিজয় দিবস হলেও প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বাংলাদেশ শব্দটি পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। বলেছেন কেবলই ভারতীয় সেনাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কথা।
প্রধানমন্ত্রীকে অনুসরণ করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন লিখেছেন, ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি, সাহস আর সংকল্পই মাত্র ১৪ দিনের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে অস্ত্র সংবরণে বাধ্য করেছিল, যা আধুনিক ইতিহাসে বৃহত্তম আত্মসমর্পণগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের বহুল প্রচারিত ছবি প্রকাশ করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন লিখেছেন, ভারতের পরাক্রমের নজির হলো এই ছবিটি। তিনি সেই সাথে ভারতের বীর যোদ্ধাদের উদ্দেশে ‘শত শত প্রণাম’ও জানিয়েছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী একথা উল্লেখ করতেও ভোলেননি যে, বিজয় দিবসের ওই দিনটিতে ভারত ৯০ হাজারেরও বেশি পাকিস্তানিকে যুদ্ধবন্দী করেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতো প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের টুইট বাণীতেও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর নাম পাওয়া যায়নি। তিনিও সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দিয়েছেন কেবলই ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে।
ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি মন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র রাজ্যবর্ধন রাঠোরের টুইটে বাংলাদেশের সামান্য উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু তিনিও লিখেছেন, ১৯৭১ সালের আজকের দিনে আমাদের সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে পরাজিত করেছিল এবং জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। কিন্তু তিনিও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও নয় মাসের সংগ্রামের কথা বেমালুম এড়িয়ে গেছেন। বাংলার মানুষের অবদানের কথাও তিনি কিছু বলেননি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ক্ষমতাসীন এবং বর্তমানে বিরোধী দল ন্যাশনাল কংগ্রেসের পক্ষে দেয়া বাণীতে অবশ্য বাংলাদেশের উল্লেখ করা হয়েছে। দলটির জাতীয় মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। উল্লেখ্য, কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী সেদিন বিকেল পর্যন্ত বিজয় দিবস নিয়ে কোনো টুইট করেননি। বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়ে কোনো বার্তাও দেননি তিনি। বলা হচ্ছে, এই নীরবতার মাধ্যমে রাহুল গান্ধীও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বিজয় দিবসকে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে গেছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের বিজয় দিবসকে নিজেদের তথা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর বীরত্ব ও পরাক্রম দেখানোর উপলক্ষ এবং বিজয় দিবস হিসেবে প্রচার করার পাশাপাশি বাংলাদেশের বীর জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর অবদানের কথা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার এই কর্মকান্ড সঠিক ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, স্বায়ত্তশাসনের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এদেশের জনগণই স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরিবর্তে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার গণহত্যার ভয়ংকর অভিযান  শুরু করার প্রতিবাদে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ যুদ্ধের মাধ্যমে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই যুদ্ধে ভারতের জনগণ সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছে এবং মূলত জনমতের চাপে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীকে সীমিত পরিমাণে সমরাস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করলেও ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরের আগে ভারতের সেনাবাহিনী কোনো যুদ্ধে অংশ নেয়নি। সব যুদ্ধই করেছিল বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা- যাদের মধ্যে ছিল সেনাবাহিনী ও ইপিআর থেকে আগত অফিসার ও জওয়ানরা, ছিল ছাত্র যুবক এবং সাধারণ মানুষ। তাদের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনী। এ মুক্তিবাহিনীই ধারাবাহিক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। সে যুদ্ধ গেরিলা যুদ্ধ যেমন ছিল তেমনি ছিল সম্মুখ যুদ্ধও। মুক্তিবাহিনীর কাছে ক্রমাগত পরাজিত হতে হতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল তখনই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল ভারতের সেনাবাহিনী।
অর্থাৎ ভারতীয়রা তখনই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় সময়ের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব যুদ্ধই আসলে করেছিলেন মুক্তিবাহিনীর দুর্দান্ত সাহসী বীর যোদ্ধারা। ভারতীয়রা প্রকৃতপক্ষে চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে যাওয়া যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সে ক্ষেত্রেও প্রধান ভ’মিকা ছিল মুক্তিবাহিনীরই। কারণ, মুক্তিযোদ্ধারাই ভারতীয়দের পথ দেখিয়ে এনেছেন। প্রাথমিক প্রতিটি যুদ্ধও তারাই করেছিলেন। ভারতের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল বিমান হামলা। কারণ, বাংলাদেশের কাছে তখন কোনো যুদ্ধ বিমান ছিল না।
এভাবে যে কোনো পর্যালোচনায় দেখা যাবে, দীর্ঘ ৪৭ বছর পর ভারতীয়রা বিজয় দিবসের যে কৃতিত্ব দাবি করেছেন তা আসলে সঠিক নয় বরং সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক। যুদ্ধের একেবারে শেষ ক’টি দিনে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার ব্যাপারে তাদের অবদান আমরা অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। কিন্তু তার অর্থ এমন নয় যে, সবই ভারতীয়রা করেছিল।
তাছাড়া এই অভিযোগও সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে যে, গোপনে গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল- পরবর্তীকালের জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে উপস্থিত থাকতে দেয়া হয়নি। তাকে বহনকারী হেলিকপ্টারকে গুলি করে সিলেট অঞ্চলে নামানো হয়েছিল- যেখানে তখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ছিল না।
শুধু ভারতীয় নয়, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর পক্ষে ভারতীয় জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এই  ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করে নিজেদের মতো কাহিনী করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিজয় দিবসেও বাংলাদেশের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। তাদের এই সংকীর্ণ মনোভাব একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। আশা করি, তারা সঠিক ইতহাস তুলে ধরবেন- যে ইতিহাসের ভারতেরও অবদান রয়েছে। তাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশকে জনগণের সমর্থন-সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশেরই মুক্তিবাহিনী দেশ স্বাধীন করেছিল। সশস্ত্র সে স্বাধীনতাযুদ্ধের একেবারে শেষ কয়েকটি দিনে ভারতের সেনাবাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ও বিজয়ের সহায়ক ছিল।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ