কবিতায় পাখি
সাকী মাহবুব : সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ ও পাখি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। মানুষ ছাড়া পাখি বা পাখি ছাড়া মানুষ কল্পনা করা যায় না। এই ধরণীকে সুন্দর করে সাজাতে, সুন্দর করে বাঁচিয়ে রাখতে নিরবে নিভৃতে অবদান রেখে চলেছে আমাদের পক্ষিকুল। আমাদের খাদ্য, রোগ মুক্তির পথ্যসহ কত না বিষয়ে অকাতরে অবদান রেখে চলেছে তারা, তারা অবদান রাখছে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায়। পাখি যেমন প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৃদ্ধি করে। পাখি সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান। পাখি একদিকে মানুষের সৌন্দর্য পিপাসা মেটায় অন্যদিকে কলকাকলিতে আনন্দ মুখর করে রাখে প্রকৃতিকে। বাংলাদেশের অপরূপ প্রকৃতির এক অপূর্ব উপহার পাখি। এদের মিষ্টি সুর আমাদের মুগ্ধ করে। ভোরে ঘুম ভাঙ্গা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত এদের কলকাকলি শোনা যায়। এক কথায় পাখি হয়ে গেছে আমাদের পরিবেশের জন্য চরম এক অনুসঙ্গ। পাখির প্রতি আছে আমাদের গভীর ভালোবাসা। এই ভালোবাসা থেকেই কবিদের কবিতায় পাখি উঠে এসেছে বারবার। এদেশের অসংখ্য কবি সাহিত্যিকগণ মনের মাধুরী মিশিয়ে পাখি নিয়ে লিখেছেন অনেক মুগ্ধকর আর প্রাণস্পর্শী কবিতা। যা আমাদের কবিতার ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সমৃদ্ধতার সোনালী রাস্তায় যার কথা শ্রদ্ধার সাথে করা যায় তিনি বাংলা সাহিত্যের নোবেলবিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি পাখি নিয়ে লিখেছেন চমৎকার কবিতা। যেমন-
“খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাচাঁটিতে
বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে,
কি ছিল বিধাতার মনে।
বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই,
বনেতে যাই দোহেঁ মিলে।
খাচারঁ পাখি বলে বনের পাখি, আয়
খাচাঁয় থাকি নিরিবিলে।
বনের পাখি বলে না,
আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।”
(দুইপাখি/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বাংলা সাহিত্যের ঈর্ষণীয় প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আমরা আদর্শ পাখির বৈশিষ্ট্য খুজে পাই। কবি লিখেছেন
“আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে
উঠব আমি ডাকি।
সূর্যি মামা জাগার আগে
উঠব আমি জেগে,
হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন
মা বলবেন রেগে।”
(আমি হব সকাল বেলার পাখি/কাজী নজরুল ইসলাম)
নজরুল কখন ও কখন ও শূন্য হাহাকার বুকে প্রাণের পাখিরে ফিরে আসার আহবান জানাচ্ছে এভাবে-
“শূন্য এ বুকে পাখি মোর, আয় ফিরে আয় ফিরে আয়
তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল অকালে ঝরিয়া যায়
তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ পান্ডুর হল আকাশের চাঁদ
কেঁদে নদী -জল করুণা-বিষাদ ডাকে আয় তীরে আয়।”
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি, রূপসী বাংলার সৌন্দর্য পিপাসু কবি জীবনানন্দ দাস তার কবিতায় পাখিকে এড়িয়ে যাননি। বাংলা ভাষার শুদ্ধতম এই কবির কবিতায় পাখি উঠে এসেছে বারবার। কবি এই বাংলায় ভোরের কাক, বা শঙ্খচিল, শালিখের বেশে ফিরে আসতে চান বারবার। কবির সুদৃঢ় উচ্চারণ শুনি-
“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কাতির্কের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়;
হয়তো বা হাসঁ হব কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,”
(আবার আসিব ফিরে /জীবনানন্দ দাস)
পল্লিকবি জসীম উদদীন “পল্লীজননী” কবিতায় পাখির কথা তুলে ধরেছেন সুন্দর ভাবে। তিনি লিখেছেন
“বাঁশ বনে বসি ডাকে কানাকুয়ো, রাতের আধার ঠেলি,
বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারির বন হেলি।
.......... .......... ..........
ঘরের চালেতে হুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর
মরণের দূত এলো বুঝি হায়, হাকে মায়, দূর দূর”।
(পল্লিজননী/জসীম উদদীন)
কবি আহসান হাবীব মা এবং সন্তানের মধ্যে কথোপকথনের মাধ্যমে অত্যন্ত নিখুত ভাষায় পাখির বনর্ণা দিচ্ছেন এভাবে
জানো মা, পাখিরা বড় বোকা, ওরা কিছুই জানে না।
যতবলি, কাছে এসো, শোনো শোনো কিছুতেই মানে না।
মিছেমিছি কেন ওরা ভয় পায়, ভয়ের কি আছে?
বোঝে না বোকারা, আমি ভালোবাসি তাই ডাকি কাছে।
দেখো না; যখন কাল আমাদের আম বাগানের
পূবধারে ওরা সব বসিয়েছে আসর গানের
আমি গিয়ে চুপিচুপে কিছু দূরে বসেছি যখন,
গান ভুলে বোকাগুলো এক সাথে পালালো তখন
(পাখি/ আহসান হাবীব)
ঐতিহ্যের কবি ফররুখ আহমদের গোটা কাব্য সাহিত্যের সুনীল আকাশে কেউ যদি পরিভ্রমণ করেন তাহলে দেখবেন সেখানে আছে পাখিদের আনাগোনা। কবির ভাষায়
আয়গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া
দিনটাতে,
পাখির বাসা খুজঁতে যাবো
একসাথে।।
কোন বাসাটা ঝিঙেমাচায়
ফিঙে থাকে কোন বাসাটায়
কোন বাসাতে দোয়েল ফেরে
সাঝঁ রাতে।।
ঝিলের ধারে ঝোঁপের মাঝে
কোন বাসাটা লুকিয়ে আছে
কোন বাসাটায় বাবুই পাখির
মন মাতে।।
(পাখির বাসা/ফররুখ আহমদ)
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল মুখ কবি বন্দে আলী মিয়া। তার কবিতায় পাখি খাচাঁ আলগা পেয়ে উড়ে যাওয়ায় পাখির প্রতি খোকার যে অপরিসীম ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে কবি সে কথাই ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত মনকাড়া ভাষায়। তিনি লিখেছেন-
“খাচাঁর দুয়ার আলগা পাইয়া উড়ে গেছে পাখি বনে, ছোট। কালো পাখি উড়ে গেছে তার নীল নভ অঙ্গনে।
শূন্য খাচাঁটি অনাদরে হোথা পড়ে আছে এক ধারে;
খোকা বসি পাশে অশ্রু সজল চোখ বারে বারে। একদা খোকন দূর দেশে গিয়ে এনেছিল এক পাখি,
সারাদিন তারে করিত যতন সযতনে বুকে রাখি।
.......... .......... ..........
“এত ভালোবাসা, এত যে সোহাগ, পোষ তবু মানে নাই,
খাচাঁর প্রাচীরে পাখা ঝাপটিয়া, পথ খুঁজিয়াছে তাই।
খোকা চায় পাখি-পাখি চায় বন; স্বাধীন মুক্ত প্রাণ,
কন্ঠে তাহার জাগে ক্ষণে ক্ষণে নীল আকাশের গান।”
(পাখি /বন্দে আলী মিয়া)
বাংলা ভাষায় পাখি বিষয়ক কবিতার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রজনীকান্ত সেনের "স্বাধীনতার সুখ"কবিতাটি। পাখি বিষয়ক এত জনপ্রিয় কবিতা খুব কম চোখে পড়ে আমাদের। মানুষকে মানবিকভাবে জাগ্রত করার জন্য কবি রজনীকান্ত সেন এ কবিতাটি রচনা করেন। তাঁর এ কালজয়ী কবিতাটি এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
“বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,
কুঁড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহাসুখে অট্রালিকা পড়ে
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে।
বাবই হাসিয়া কহে, সন্দেহ কি তায়
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়।
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।”
(স্বাধীনতার সুখ/ রজনীকান্ত সেন)
আধুনিক কবি আল মাহমুদ লিখেছেন তার প্রিয় পাখি কাক নিয়ে কবিতা। কাকের কন্ঠে তিনি শুনতে পান সত্যের সুর। তার নগর জীবনের ক্লান্তিতে ক্ষয়ে আসা জীবন সতেজতার অনুপ্রেরণা পান উত্তম নাগরিক কাকের কা -কা ধ্বনির মধ্য থেকেই। তিনি লিখেছেন
“হে আমার প্রিয়, পরম চতুর পাখি,
তোর কন্ঠেই শুনি সত্যের সুর,
এই উদ্দাম নগরের হাকাঁহাকিঁ
আত্মায় তোর উত্তাল ভরপুর,
বুঝি জীবিকার প্রতীক চিহ্ন ওড়ে,
কৃষ্ণে ধবাল সবল দুখানি পাখা,
শব্দ তোমার নটীদের ঘুংগুরে
যেন নৃত্যের মুদ্রায় তাল রাখা।”
(কাক/আল মাহমুদ)
শামসুর রাহমান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি তার “বাচতে দাও” কবিতায় প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণী জগতের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের কথা বলেছেন। একটি শিশুর বেড়ে ওঠার সঙ্গে তার চারপাশের সুস্থ পরিবেশের সম্পর্ক রয়েছে। যদি পৃথিবীতে ফুল না থাকে, পাখি না থাকে, সবুজ ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। কবি লিখেছেন
“মধ্যদিনে নরম ছায়ায় ডাকছে ঘুঘু
ডাকতে দাও।
বালির উপর কত্ত কিছু আঁকছে শিশু,
আকঁতে দাও।
কাজল বিলে পানকৌড়ি নাইছে সুখে
নাইতে দাও।
গহিন গাঙে সুজন মাঝি বাইছে নাও,
বাইতে দাও।
নরম রোদে শ্যামা পাখি নাচ জুড়েছে,
নাচতে দাও।
শিশু, পাখি, ফুলের কুঁড়ি সবাইকে আজ
বাঁচতে দাও।”
(বাঁচতে দাও/শামসুর রাহমান)
কবি মহাদেব সাহার কবিতায় পাখিপ্রেম উঠে এসেছে তীব্রভাবে। কবি পাখিকে ভালোবেসে তার জন্য স্বাধীন নিরাপদ স্বদেশ চাইছেন। কবি চায় মায়াবী পাখিরা সরোবরে মনোরোম পরিবেশে জলক্রীড়া করে মুক্তমনে খেলা করুক। কবির উচ্চারণ
“তোমাদের বিশাল ডানার ছায়া পড়ে
হৃদে, আমার হৃদয়ে,উড়বার সাধ
নেই, তবু তোমাকে আমার বড়ো ভালো
লাগে পাখি,আমি চিরদিন একটি
স্বপ্নের পাখি পুষে রাখি বুকের ভেতর।
... ... ...
এই পাখির পৃথিবী কেন কিরাতের
তীরে ভরে গেলো? আমি
পাখিদের নিরাপদ অবাধ আকাশ চাই,
চাই পাখিদের স্বাধীন স্বদেশ।
(চাই পাখির স্বদেশ/মহাদেব সাহা)
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবি আবিদ আজাদ। তিনি পাখির কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন এমনি করে -
“পাখিরা, হে আমার শৈশবের প্রিয় পাখিরা
এখন কোথায় তোমরা? কোন উঁচু গাছের আকাশের ডালে
নীল হয়ে আছো?
এখন কোথায় কোন পৃথিবীর রৌদ্রে তোমাদের তুলতুলে
ডানারা পালকের ওম
ছড়িয়ে চলেছে?”
(পাখিরা /আবিদ আজাদ)
বৃক্ষেরর সাথে মানুষের প্রেম, মানুষের সাথে পরিবেশের। বৃক্ষ আর মানুষের যৌথ প্রয়াসেই সবুজাভ প্রেম,বাসযোগ্য পৃথিবী। বৃক্ষ ধ্বংস মানে পরিবেশ ধ্বংস আর পরিবেশ বিপর্যয় মানেই প্রাণী জগতের অর্থাৎ পাখিদের বিপর্যয়, ভয়াবহ দুর্যোগ। তাই তো কবি মতিউর রহমান মল্লিকের তীব্র প্রতিবাদ
“পাখিদের নীড় কারা ভেঙে দেয়
আর্থিক অজগর
উজাড় বনের সবুজাভ প্রেম
বাতাসের দাপাদাপি
যত দ্রুত কমে বৃক্ষ এবং
বৃক্ষের সমারোহ
ধসে দ্রুত তত দ্রুত হৃদয়ের রং
জীবনের হিমালয়।”
(ক্রমাগত /মতিউর রহমান মল্লিক)
মতিউর রহমান মল্লিকের পাখি বিষয়ক আর এক বিখ্যাত কবিতা হলো
“পাখি তুই, কখন এসে বলে গেলি
মুহাম্মদের নাম,
যে নাম শুনে পৃথিবীকে
ভালো বাসিলাম।”
পরিশেষে বলা যায় যে, চির সবুজের দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত আমাদের বাংলাদেশ। যে সব প্রাকৃতিক উপাদান সুজলা সুফলা এদেশকে ব্যাপক সৌন্দর্য মন্ডিত করেছে তার মধ্যে পাখি অন্যতম। নানা প্রজাতির নানা বর্ণের পাখির কলরবে সারাক্ষণ বাংলার প্রকৃতি মুখরিত থাকে। কন্ঠ মাধুর্যে যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের কবিদের মনোহরণ করে আসছে এদেশের পাখি। এদেশের কবিরাও বড্ড পাখি প্রেমিক। তারা পাখি প্রেমিক বলেই তাদের পক্ষে এমন অসাধারণ সব কবিতা রচনা করা সম্ভব হয়েছে। তারা মনের মাধুরী মিশিয়ে যেসব কবিতা রচনা করেছেন তাদের সেই সব কবিতা বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে করছেন সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর। তাদের সেই কবিতা বাংলা সাহিত্যে পাখি বিষয়ক কবিতার ভুবনে হীরক খন্ডের দ্যুতি নিয়ে বেঁচে থাকবে হাজার বছর।