ওয়াসার এমডি এবং শরবত সমাচার
একথা মোটেও নতুন নয় যে, রাজধানীর পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা ঢাকা ওয়াসার বিরুদ্ধে গ্রাহক তথা সাধারণ মানুষের গুরুতর অনেক অভিযোগ রয়েছে। এরকম একটি বড় অভিযোগ হলো, সেবা দেয়ার ধারে কাছে না গিয়েও স্যুয়ারেজ বা পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের নামে সার্ভিস চার্জ হিসেবে ওয়াসা গ্রাহকদের কাছ থেকে বছরে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা আদায় করছে। অন্যদিকে স্যুয়ারেজ পাইপলাইনের মেরামতের জন্য কোনো কোনো অর্থবছরে ওয়াসা ব্যয় করেছে মাত্র ১৬ কোটি টাকা। বাকি বিপুল পরিমাণ অর্থ ওয়াসা ঠিক কোন্ খাতে ব্যয় করেছে অথবা আদৌ ব্যয় করা হয়েছে কি না সে সম্পর্কে কোনো তথ্য বা হিসাব পাওয়া যায়নি। বিশুদ্ধ বা সুপেয় পানি সরবরাহের মাধ্যমে সেবা না দেয়ার পাশাপাশি অন্য কিছু বিশেষ কারণেও ওয়াসার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন তথ্যাভিজ্ঞরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংস্থার প্রায় ৯০ শতাংশ স্যুয়ারেজ পাইপলাইনই দীর্ঘদিন ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেগুলোকে মেরামত করার ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না। সার্বিক এই অব্যবস্থাপনার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সুপেয় তথা রোগের জীবাণুমুক্ত বিশুদ্ধ পানি পাওয়া বাস্তবে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে একদিকে ডায়ারিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন গ্রাহকরা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে গিয়ে আইসিডিডিআরবি তথা কলেরা হাসপাতালে ভিড় জমাতে হচ্ছে। বিশেষ করে বিপন্ন হচ্ছে শিশুরা। শিশুদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে। এমন অবস্থায় দায়িত্ব যেখানে ছিল স্যুয়ারেজ পাইপলাইনের সংস্কার এবং বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেখানে উল্টো অসত্য কথা বলেছেন। দিন কয়েক আগে রীতিমতো ঘোষণার আকারে তিনি বলেছেন, ওয়াসার পানি নাকি ‘শতভাগ’ বিশুদ্ধ এবং ‘সুপেয়’! সব পানিই নাকি নিরাপদ উৎস থেকে সংগ্রহ ও সরবরাহ করা হয়! ওয়াসার এমডির এই ঘোষণা গ্রাহক তথা রাজধানীবাসীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে শুরু হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী আন্দোলন। সে আন্দোলনের চাপে দৃশ্যত বিব্রত এমডি তার বক্তব্য কিছুটা সংশোধন করে বলেছেন, বিশুদ্ধ পানি তারা নিরাপদ উৎস থেকেই সরবরাহ করেন। তবে সময়ে সময়ে পাইপলাইনের সংস্কার না হওয়ার এবং বিরাট এলাকা দিয়ে দীর্ঘ লাইনের স্থানে স্থানে ছোট-বড় ছিদ্র থাকার মতো বিভিন্ন কারণে গ্রাহকদের বাসাবাড়ি পর্যন্ত যেতে যেতে বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানিতে জীবাণু ঢুকে যেতে পারে। তা ছাড়া গ্রাহকরাও নাকি নিজেদের বাসাবাড়ির পাইপলাইন এবং পানির ট্যাংক সব সময় পরিষ্কার করেন না। ফলে ওয়াসা বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানি সরবরাহ করলেও সে পানি আর বিশুদ্ধ এবং জীবাণুমুক্ত থাকতে পারে না। এ জন্যই নাকি পানি বাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে!
ওয়াসার এমডির বক্তব্য গ্রাহকসহ জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত করতে পারেনি। তারা বরং এমডির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন এবং ওয়াসা ভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। ওই কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার কয়েক হাজার গ্রাহক কওরানবাজারে গিয়েছিলেন ওয়াসা ভবন ঘেরাও করতে। পুলিশের বাধায় ঘেরাও করতে না পারলেও তারা রাস্তার উল্টো পাশে সমবেত হয়েছিলেন। গ্রাহকদের মধ্যে জুরাইন এলাকার জনৈক গ্রাহক ও তার স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন শরবত। ওয়াসার কথিত বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানি দিয়ে তৈরি ওই শরবত তারা ওয়াসার এমডিকে খাওয়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এমডি তাদের সঙ্গে সাক্ষাতই করেননি। পরিবর্তে ওয়াসার একজন পরিচালককে পাঠিয়েছিলেন।
সে পরিচালকও ওয়াসার পানি দিয়ে তৈরি ওই শরবত পান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলেছেন, শরবত সত্যি ওয়াসার পানি দিয়ে নাকি পুকুরের পানি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সে ব্যাপারে তার সন্দেহ রয়েছে বলেই না জেনে তিনি খাবেন না। বিভিন্ন টিভিসহ মিডিয়ার ক্যামেরা ও সাংবাদিকদের সামনেই ওয়াসার ওই পরিচালক অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। অন্যদিকে জুরাইনের গ্রাহক এবং তার স্ত্রী এলাকার বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে দেখিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তারা ওয়াসার পানি দিয়েই শরবত বানিয়ে এনেছেন। কোনো পুকুরের পানি মেশাননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওয়াসার পরিচালককে শরবত খাওয়ানো সম্ভব হয়নি। এতটাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি! বলার অপেক্ষা রাখে না, ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি সত্যিই বিশুদ্ধ ও সুপেয় হলে এবং সে ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে আস্থা থাকলে ওয়াসার এমডি যেমন গ্রাহকদের সামনে আসার সৎসাহস দেখাতেন ওয়াসার পরিচালকও তেমনি এক ঢোক হলেও শরবত পান করতেন। অন্যদিকে ঘটেছে সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা। এমডি এমনকি গ্রাহকদের সামনে আসারই সাহস পাননি। পরিচালকও পুকুরের পানি তত্ত্ব হাজির করে শরবত পান করা থেকে বিরত থেকেছেন!
আমরা মনে করি, কথিত ‘সুপেয়’ পানির ঘোষণা দেয়া থেকে শরবত পান করতে অস্বীকৃতি জানানো পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের সম্পূর্ণটুকুই ওয়াসার বিরুদ্ধে গেছে। আরো একবার এই সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, মূলত ওয়াসার কারণেই রাজধানীবাসীকে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে। পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ব্যয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকার গ্যাস। ওদিকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাজধানীর মানুষকে যেসব রোগে আক্রান্ত হয়ে কষ্ট করতে এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হয়, সেসব রোগের প্রধান উৎস দূষিত ও নোংরা পানি। ওয়াসার গাফিলতির কারণে এই পানিতে রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে ও পড়ছে।
ওয়াসার অবহেলা, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আরো অসংখ্য তথ্য ও অভিযোগ থাকলেও সেবের উল্লেখে না গিয়ে আমরা মনে করি, ওয়াসার কর্তা ব্যক্তিদের উচিত বিভিন্ন অভিযোগের আলোকে জরুরি ভিত্তিতে সততার সঙ্গে তৎপর হয়ে ওঠা এবং রাজধানীর পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের প্রধান দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আর কোনো অবহেলা না করা। বলা বাহুল্য, সেবা দেয়ার ধারেকাছে না গিয়েও বছরে বছরে ট্যাক্স বাড়ানোর মতো কোনো একটি তথ্যই ওয়াসার পক্ষে যায় না! এসবের মধ্য দিয়ে বরং কর্তাব্যক্তিদের অযোগ্যতা ও দুর্নীতির দিকগুলোই প্রাধান্যে চলে আসে। এমন অবস্থার অবশ্যই অনতিবিলম্বে অবসান ঘটানো দরকার।