শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ফণীর প্রভাবে খুলনায় ব্যাপক ঝড়বৃষ্টি বেড়িবাঁধে ভাঙন

খুলনা অফিস : ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে খুলনার কয়রা উপজেলায় ব্যাপক ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার (৩ মে) রাত সাড়ে ১১টার দিক থেকে বৃষ্টির সঙ্গে ঝড় শুরু হয়। কপোতাক্ষ নদের পানি ঝড়ের প্রভাবে প্রবল বেগে আছড়ে পড়ছে। এতে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় ফণীতে যে কয়টি জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে  এর মধ্যে কয়রা একটি।
খুলনার দাকোপ ও পাইকগাছায়ও ব্যাপক বৃষ্টির সঙ্গে বজপাত হয়েছে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে খুলনা শহরজুড়েও দমকা হাওয়া ও বজ বৃষ্টি শুরু হয়। এ বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাস শুরু হওয়ায় আশ্রয়কেন্দের বাইরে থাকা লোকজন আতঙ্কিত হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রমুখী হন। আশ্রয়কেন্দ্র কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। অনেকেই জায়গা পাননি আশ্রয়কেন্দে। অনেকে বৃষ্টির মধ্যে দু’তিনটি আশ্রয়কেন্দে জায়গা না পেয়ে অন্য আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে। অনেককে প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সবশেষ খবর অনুযায়ী, ফণী শনিবার সকালের দিকে খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলে আঘাত হানতে পারে। বাঁধের ওপর দিয়ে প্রবেশ করছে জোয়ারের পানি ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র প্রভাবে খুলনার নদ-নদীতে পানির চাপ বাড়ছে। জোয়ারের পানির চাপে কয়রা ও দাকোপের ৮-১০ স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। কয়রায় প্রশাসনের সহায়তা ও স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষায় কাজ চলছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কয়রা উপজেলার দশআনি, হরিণখোলা, ঘাটাখালিসহ ৪-৫ জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ পানির চাপে ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানির চাপ বাড়ায় দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের গোলখালী, মাটিয়াভাঙা ও মোল্যাপাড়া প্লাবিত হচ্ছে। দাকোপ উপজেলার বরনপাড়া, বটিয়াঘাটা উপজেলার মল্লিকের মোড়ের কচি বানিয়া, বারোআড়িয়ার সুন্দরমহলের রাস্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহা শনিবার (৪মে) সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে জানান, ঝড় এখনও শেষ হয়নি। নদীতে পানির চাপ বাড়ছে। তবে এখনও কয়রার কোথাও কোনও বাঁধ ভাঙেনি। তবে ৪-৫ স্থানে বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা রয়েছে। সকালে ঘাটাখালির ভাঙন প্রবল এলাকার বাঁধ রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ শুরু করা হয়েছে। কয়রার বাসিন্দা লিঙ্কন জানান, হরিণখোলার বাঁধ রক্ষায়ও স্থানীয়ভাবে কাজ করা হচ্ছে।
বেড়িবাঁধের উপর বসে আছেন মানুষ, পানির চাপে যেকোনো সময় তা ধসে যেতে পারে : ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র প্রভাবে প্রকৃতির প্রলয়নৃত্যের ঢেউয়ে পানি বাড়ছে সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার কয়রার নদ-নদীতে। শুক্রবার গভীর রাত থেকে কয়রায় ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র প্রভাবে কখনও হালকা কখনও তীব্র গতিবেগে বাতাস বইছে। বাতাসের সঙ্গে থেকে থেকে হচ্ছে ব্যাপক বৃষ্টিও। শনিবার সকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। রাতের ঝড়ে বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার খবর পাওয়া গেছে। তবে কয়রাবাসীর কাছে বেশি আতঙ্কের বিষয় ভাঙা বেড়িবাঁধ। রাতের জোয়ারে বেড়িবাঁধের বেশ কিছু অংশ ভেঙে গেছে।
এলাকাবাসী বলছেন, ত্রাণ চাই না, বাঁধ চাই। শুক্রবার গভীর রাতে ফণীর প্রভাবে কয়রার ঘাটাখালীর বাঁধের অনেক স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুপুরের জোয়ারে কি হবে জানি না।
তারা অভিযোগ করছেন, উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী মানুষের একটা অংশ চায় বাঁধ হোক (বৃহৎ অংশ), আরেকটা অংশ যারা চায় মাঝে মাঝে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যাক। বিপদ এলে সরকার এই এলাকার মানুষকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে আশ্রয় কেন্দ নির্মাণ করে, বানভাসী মানুষের জন্য ত্রাণ পাঠায়। অথচ বাঁধগুলো যদি ঠিক করে এসব কিছুরই প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তা করে না। বাঁধগুলোর যে অবস্থা একটু ধাক্কা এলেইতো সব শেষ। এতো এতো টাকা খরচ না করে টেকসই বাঁধ রক্ষার ব্যবস্থা করলেই মানুষ নিরাপদে থাকতে পারে।
কয়রার বাসিন্দা এইচএম শওকত হোসেন বলেন, দক্ষিণ বেদকাশীর গোলখালী এলাকায় শুক্রবার গভীর রাতের জোয়ারে পানি ছাপিয়েছে। বাঁধের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ আংটিহারা এলাকা।
তিনি জানান, কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের আংটিহারা এলাকায় শনিবার সকালে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামতে স্বাধীন সমাজকল্যাণ সংস্থার সদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেছেন।
কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য বেলাল হোসেন বলেন, কয়রার বেড়িবাঁধের বেশকিছু এলাকা রাতের জোয়ারে ভেঙে গেছে। দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ১৪/১ পোল্ডারে গোলখালী গ্রামে কপোতাক্ষ নদের মোহনায় ওয়াপদা বেড়িবাঁধ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। রাতে কয়েক জায়গায় ভেঙে গেছে। এছাড়া কয়রার ঘাটাখালি বেড়িবাঁধও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। পানির যে চাপ তাতে যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে গ্রাম তলিয়ে সিডর-আইলার মতো ক্ষতি হতে পারে। তিনি জানান, শনিবার সকালে মাটিয়াভাঙা ও গোলখালী বেড়িবাঁধের যেসব স্থান ভেঙে গেছে সেখানে এলাকাবাসীকে নিয়ে সংস্কার করা হয়েছে।
ঘাটাখালী অবস্থানরত কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, কয়রার কপোতাক্ষ নদের ঘাটাখালী বেড়িবাঁধে রাতে ঝড়ের আঘাতে রাস্তা আর নেই, আছে রাস্তার কঙ্কাল। সামনের জোয়ারে শেষ রক্ষা হবে কিনা এ নিয়ে চিন্তা।
কয়রার বাসিন্দা জিএম মহাইমিনুল ইসলাম রকিব বলেন, ৪ নং মহারাজপুর ইউনিয়নে দশহালিয়া গ্রামে ওয়াপদার বেড়িবাঁধের অবস্থা খুব খারাপ। দুপুরের জোয়ারের আগে যদি বাঁধ না সংস্কার করা হয় তাহলে মহারাজপুর ও বাগালিতে পানি ঢুকে পড়বে।
অপরদিকে শুক্রবার রাতে খুলনার দাকোপের বানীশান্তা বাজার এলাকার পশুর নদীর বাঁধ ভেঙে কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। শনিবার বেলা ১১টার দিকে গুনারী বৈদ্যবাড়ি এলাকায় বাঁধ ভেঙেও কিছু এলাকা প্লাবিত হয়। একইভাবে পাইকগাছায়ও ফণীর প্রভাবে থেমে থেমে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। উপজেলাগুলোর অনেক মানুষ আশ্রয়কেন্দে অবস্থান করছেন। আশ্রয়কেন্দ কাণায় কাণায় পূর্ণ হয়ে গেছে। অনেকেই এক আশ্রয়কেন্দে জায়গা না পেয়ে বৃষ্টির মধ্যে অন্য আশ্রয়কেন্দে ছুটছেন। এদিকে শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার থেকে মহানগরীতে থেমে থেমে দমকা হাওয়া বৃষ্টি হচ্ছে। যা দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
 ‘ফণী’র ছোবলে ভেঙে গেছে পশুর নদীর বেড়িবাঁধ : মংলায় ‘ফণী’র তাণ্ডবে ভেঙে গেছে পশুর নদীর কানাইনগরের ছয় হাজার ফুট দীর্ঘ বেড়িবাঁধ। শনিবার সকালে বাঁধটি ভেঙে পড়ে। এ ঘটনায় ঝুঁকিতে পড়েছেন ওই অঞ্চলের কয়েক’শ পরিবার। ইতোমধ্যে প্রশাসনের উদ্যোগে ঝুঁকিতে থাকা বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শনিবার ভোরে মংলা উপজেলায় শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানে। এসময় ফণীর তা-বে উপজেলার চিলা, কানাইনগর, বৌদ্ধমারী ও জয়মনি এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ঝড়ের আঘাতে ভেঙে যায় কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালা। সকালের দিকে ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙে যায় কানাইনগরের বেড়িবাঁধ।
চাঁদপাই ইউনিয়নের কানাইনগর এলাকার ইউপি সদস্য মো. সেলিম শেখ জানান, ভেঙে পড়া ঘরবাড়ির বাসিন্দারা রাতে আশ্রয়কেন্দে থাকায় হতাহতের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ফণীর তাণ্ডবে অনেক ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ার পাশাপাশি এ এলাকার নদীপাড়ের কানাইনগরের ছয় হাজার ফুটের বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এ অবস্থায় নদীর পানি ঢুকে পড়লে কয়েকশ’ পরিবার তলিয়ে যাবে।
শনিবার সকালে উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের কানাইনগরে সরেজমিনে দেখা যায়, ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙে পড়া বাঁধে পশুর নদীর শক্তিশালী ঢেউ আছড়ে পড়ছে। আতঙ্কে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
স্থানীয় বাসিন্দা হেলেনা ধূনী, পিযুশ সরদার ও শেফালী সরদার জানান, এই বাঁধের কারণে এখানকার বাসিন্দারা নিরাপদে ছিল। এখন বাঁধটি ভেঙে গেছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে শত শত বাড়িঘর তলিয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. নাহিদুজ্জামান বলেন,‘বাঁধটি ভেঙে পড়ার খবর শুনেছি। ঝুঁকির মধ্যে থাকা বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন,‘এর আগে টিআর কাবিখা দিয়ে মাটির কাজ করে বাঁধটি সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু নদীর পানির চাপ, উচ্চতা এবং ঝড়ের প্রভাবে বাঁধটি আর ধরে রাখা যাচ্ছিল না, এটি এখন স্থায়ীত্ব করতে পাকা অবকাঠামোর প্রয়োজন। তা না হলে নদীর পানিতে দু একদিনের মধ্যে এ এলাকা প্লাবিত হয়ে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে।’
এদিকে শনিবার সকালেও উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রের লোকজনকে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। তাদের মাঝে উপজেলা প্রশাসন থেকে শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ