শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

তৈরি পোশাক কারখানায় ২২ শতাংশ নারী শ্রমিক যৌন হয়রানির শিকার

স্টাফ রিপোর্টার : দেশে তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা ২২ দশমিক ৪ ভাগ নারী শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার। এছাড়াও শতকরা ৩৫ দশমিক ৩ ভাগ নারী কর্মী বলেছেন তারা কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের প্রতি যৌন হয়রানির ঘটনা দেখেছেন বা শুনেছেন। উল্লেখ্য দেশের বৈদেশিক আয়ের ৮০ শতাংশ আসে এই পোশাক শিল্প থেকে এবং এখানে কর্মরতদের মধ্যে শতকরা ৭০ জন নারী ।
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে  মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত তৈরি পোশাক শিল্প কারখানায় নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানি : সংগ্রাম ও উত্তরণের উপায়  শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে । এমজেএফ ও কর্মজীবি নারী আয়োজিত এই মত বিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন শিরিন আক্তার এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একেএম মিজানুর রহমান, মহাপরিচালক, শ্রম বিষয়ক অধিদপ্তর এবং মো: মতিউর রহমান, উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইএফই) এবং ইলভা শালসট্রেন্ড সেকেন্ড সেক্রেটারি, সুইডিশ এ্যাম্বেসী। অনুষ্ঠানটিতে সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, এমজেএফ।
গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাক কারখানায় যৌন নির্যাতন বলতে শতকরা ৭৯ জন নারী ও ৮২ দশমিক ৫৬ জন পুরুষ মনে করেন নারী দেহে অপ্রত্যাশিত স্পর্শই হলো যৌন নির্যাতন। তাদের মতে অশ্লীল গালাগালিকে যৌন নির্যাতন বলে মনে করাটা ঠিক হবে না। কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা যে ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয় এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৪২ দশমিক ৩৩ শতাংশ হচ্ছে ‘কামনার দৃষ্টিতে তাকানো’। এরপর আছে ’সংবেদনশীল অঙ্গে কোনকিছু নিক্ষেপ করা, যা শতকরা ৩৪ দশমিক ৯২ এবং সংবেদনশীল অঙ্গের প্রতি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানো’ যা শতকরা ৩৩ দশমিক ৮৫ ভাগ। কাজ বোঝানোর বা কথা বলার সময় হাত বা শরীর স্পর্শ করা শতকরা ২৮ দশমিক ৫ ভাগ। এছাড়াও আছে বাজে গালি দেয়া, চাকুরিচ্যুতির হুমকি, অশোভন অঙ্গভঙ্গি, পদোন্নতির কথা বলে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব ইত্যাদি।
এমজেএফ এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক খাতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে এ খাতে নিয়োজিত নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা। নারী শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে যে যৌন হয়রানির শিকার হয় তার উপর আলোকপাত করাই ছিল এই গবেষণার উদ্দেশ্য।
গবেষণাটি ঢাকার মিরপুর ও চট্টগামের পাঁচলাইশ ও বাইজিদ বোস্তামি রোডে অবস্থিত ২৭টি পোশাক কারখানায় পরিচালিত হয়েছে। এই গবেষণার মূল তথ্য সংগৃহীত হয়েছে একটি কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে। যৌন প্রতিরোধে বিদ্যমান যেসব আইন ও প্রবিধান আছে সেগুলোও পর্যালোচনা করা হয়েছে।
গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে কেন নারী শ্রমিকরা বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়? শতকরা ১১ দশমিক ৯৫ জন নারী শ্রমিক ও ২৭ দশমিক ৯১ জন পুরুষ শ্রমিক মনে করেন যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ নেয় না বলে। শতকরা ২৬ দশমিক ৭৪ জন পুরুষ কর্মী ও শতকরা ১২ দশমিক ২৪ জন নারী কর্মী মনে করেন এই হয়রানির উপর নজর রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ থেকে কোন কমিটি গঠিত না হওয়া। এছাড়া তারা আরো মনে করেন অপরাধীদের কোনরকম শাস্তি না হওয়া, কারখানা কর্তৃক যৌন হয়রানিকে কোন অপরাধ বলে মনে না করা, মধ্যরাত পর্যন্ত ওভারটাইম করানো। সামাজিক কারণ হিসেবে মনে করেন নারীরা দুর্বল, নারীরা প্রতিবাদ করে না, নারীদের চরিত্র খারাপ, আর তাই তারা হয়রানির শিকার হয় বেশি।
দেখা গেছে শতকরা ২২ দশমিক ৪ ভাগ নারী শ্রমিক বলেছেন তারা শারীরিক ও ইন্দ্রিয়গত ভাবে পরিবার পর্যায়ে যৌন হয়রানির শিকার হন। ৪০ শতাংশ বলেছেন তারা কর্মক্ষেত্রে বা রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানির শিকার হন।
যৌন হয়রানির ফলে নানাধরণের ক্ষতি হয়ে থাকে নারী শ্রমিকের ও কারখানা কর্তৃপক্ষের। নারী শ্রমিক রাগ হন, ভয় পান, অপমানিত বোধ করেন, তাদের কাজে ভুল হয়, উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়, ক্রেতাদের অভিযোগের পরিমাণ বাড়ে, অনেকে পদত্যাগ করে, আত্মহত্যাও  করেন কেউ কেউ।
কেন নারী শ্রমিকরা যৌন হয়রানি সম্পর্কে অভিযোগ করেননা? এর কারণ হিসেবে গবেষণায় উঠে এসেছে যে যৌন হয়রানির সমাধান সময় সাপেক্ষ, নারীদের সংসারে ও কর্মক্ষেত্রে থাকে ব্যাপক কাজের চাপ। এছাড়া যৌন হয়রানির ঘটনা প্রকাশের ভয় থাকে এবং হয়রানির শিকার মেয়েটির পোশাক ও আচরণ নিয়েও অপমানজনক কথা বলা হয়। এসবকে এড়িয়ে চলার জন্যই তারা অভিযোগের দ্বারস্থ হননা।
এমনকি যৌন হয়রানি বিষয়ে হাইকোর্টের যে নির্দেশনা আছে সে সম্পর্কেও শ্রমিকরা খুবই কম জানে। দেখা গেছে শতকরা ৭৯% জন নারী শ্রমিক এবং শতকরা ৭৯ জন পুরুষ শ্রমিক এ সম্পর্কে জানেই না। যারা জানেন, তাদেরও ধারণা খুব একটা স্বচ্ছ নয়।
পোশাক শিল্প কারখানায় যৌন হয়রানি ঠেকাতে কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে যেমন কঠোর আইনের প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, নারী শ্রমিকদের সচেতনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ওপর সরকার ও ক্রেতাদের নজরদারি বাড়াতে হবে, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে মণিটরিং সেল বসাতে হবে, যৌন হয়রানি যে একটি অপরাধ সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে নারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ