শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বাংলাদেশে ২০১৮ সালে তামাকজনিত মৃত্যু ১ লাখ ২৬ হাজার!

নুরুল আমিন মিন্টু, চট্টগ্রাম ব্যুরো :  তামাক। এক ধরনের মাদক। এটি  স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মৃত্যুদূত। প্রতি বছর তামাকজনিত রোগে বিশ্বে মারা যায় ৬০ লাখ মানুষ। গত বছরে (২০১৮ সাল) তামাকজনিত রোগে বাংলাদেশে মারা গেছে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, কলম্বাস এবং তার পরবর্তী অভিযাত্রীয়গণ আমেরিকায় তামাকের সন্ধান পান। তারা স্থানীয় অধিবাসীদেরকে তামাক সেবন করতে দেখেন। পৃতিবীর বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে আমেরিকার প্রাচীন মায়া সভ্যতায় তামাক সেবন সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে তখন তা প্রধানত ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো। সেখান থেকে ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমে স্পেন ও পর্তুগাল হয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও পরে এশিয়া ও আফ্রিকায় তামাক প্রবেশ করে। ১৫৬০ সালে পর্তুগালে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত জ্যাঁ নিকো ফরাসি রাজ দরবারে এক প্যাকেট তামাক পাঠান উপহার হিসেবে। ১৮২৮ সালে তামাকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের সন্ধান পাওয়া যায়। নিকোর নামনুসারে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যটির নামকরণ করা হয় নিকোটিন। 

বাংলাদেশে কখন তামাক সেবন শুরু হয় তার কোনো সঠিক ইতিহাস জানা সম্ভব না হলেও তবে ষোড়শ শতকে পর্তুগীজ নাবিকদের মাধ্যমে যে এদেশে তামাকের আমদানি, চাষ ও প্রচলন হয় তা একপ্রকার নিশ্চিত। তামাক একটি নেশাদ্রব্য। তামাক সেবনকারী তামাকের মধ্যকার আসক্তি উদ্রেককারী উপাদানের দ্বারা এর প্রতি নেশাগ্রস্ত হয়ে ওঠে। বিশ্বে যত নেশাদ্রব্য রয়েছে তার মাঝে এ নেশাদ্রব্য বৈধভাবে বেচাকেনা হয়। বিশ্বে সর্বত্র তামাক একটি বিশাল শিল্পে পরিণত হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয়, তামাকের কারণে প্রতি সেকেন্ডে একজন লোক মারা যায়। প্রতি বছর বিশ্বে তামাকের কারণে প্রায় ৬০ লাখ লোক মারা যায়। এর মধ্যে প্রায় ৫০ লাখই বর্তমান বা পূর্ব তামাক ব্যবহারকারী, ৬ লাখের বেশি অধূমপায়ী যারা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে মারা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, কোনো আশু পদক্ষেপ না নিলে, ২০৩০ সাল নাগাদ এই মৃত্যুহার ৮০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। ফলে, বিশ্বব্যাপী ধূমপান ও তামাকজনিত মৃত্যুর হার এইচআইভি ও এইডস, যক্ষ্মা, প্রসবকালীন মৃত্যু, যানবাহন দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা এবং হত্যাকান্ডসহ সকল মৃত্যুহারকে ছাড়িয়ে যাবে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৬ কোটি ২০ লাখ লোকের মৃত্যু হবে ধূমপানজনিত কারণে এবং যার মধ্যে ৫ কোটি ২০ লাখ পূরুষ ১ কোটি মহিলা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে ২৪ কোটি ধূমপায়ী এবং সমান সংখ্যক ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীর বসবাস। অর্থাৎ বিশ্বে একচতুর্থাংশ ধূমপায়ী দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বাস করে। এটাও ধারণা করা হয় যে, তামাকের কারণে এ অঞ্চলে প্রতি বছর প্রায় ১৪ লাখ লোক মারা যায়। 

সূত্র জানায়, ফ্রেমওয়ার্ক কনভেশন অন টোব্যাক্কো (এফসিটিসি) বা তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার এবং প্রকাশ্য ধূমপানের বিস্তার রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট দেশসমুহকে সহযোগিতা করা। এফসিটিসি হচ্ছে তামাক নিয়ন্ত্রণের একটি আন্তর্জাতিক আইনি দলিল বা চুক্তি, যা বিশ্বব্যাপী তামাক এবং তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রণীত হয়। ১৯৯৬ সালের মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৪৯তম সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবের আলোকে সংস্থার মহাপরিচালক এফসিটিসি বিষয়টির ধারণাগত ও আইনগত দিকের উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মে ২০০৩-এ জেনেভায় বাংলাদেশের সে সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ৫৬তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মেলনে এ চুক্তি অনুমোদিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ১৬ জুন ২০০৩ এই চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ পর্যন্ত ১৬৮টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং ১৮০টি দেশ এফসিটিসি এর পক্ষ হিসেবে কাজ করছে। 

তামাক ব্যবহারে ব্যাপকতা নির্ণয়ের জন্য বাংলাদেশে ২০০৯ সালে গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাক্কো সার্ভে (জিএটিএস) একটি জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠির মধ্যে ৪ কোটি ১৩ লাখ লোক (৪৩.৩ শতাংশ) কোনো না কোনোভাবে  ধোঁয়াযুক্ত বা ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে পুরুষ ২ কোটি ১২ লাখ (৪৪.৭ শতাংশ)। মহিলা ৭ লাখ। (১.৫ শতাংশ) সরাসরি ধূমপান করেছেন। চর্বণযোগ্য তামাক ব্যবহার করছেন পুরুষ  ১ কোটি ২৫ লাখ (২৬.৪ শতাংশ) মহিলা ১ কোটি ৩৪ লাখ (২৭.৯ শতাংশ)। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন ১ কোটি ১৫ লাখ মানুষ (৬৩  শতাংশ) । 

তামাক ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতে ২০১৯-২০ কর প্রস্তাব বৃদ্ধির প্রস্তাবে, সিগারেটের মূল্যস্তর ৪টি থেকে কমিয়ে ২টি নির্ধারণ করা, করারোপের ক্ষেত্রে নিম্ন ও মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে একটি মূল্যস্তর (নিম্নস্তর) এবং উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরকে একত্রিত করে আরেকটি মূল্যস্তরে (উচ্চস্তর) নিয়ে আসা, নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারটের খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা এবং উচ্চস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ন্যূনতম ১০৫ টাকা নির্ধারণ করে ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা, এবং সকল ক্ষেত্রে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটে ৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।  এছাড়া বিড়ির মূল্য বিভাজন তুলে দিয়ে ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ৬ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৮ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ৪.৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য (জর্দা ও গুল)-র ক্ষেত্রে ট্যারিফ ভ্যালু প্রথা বিলুপ্ত করে সিগারেট ও বিড়ির ন্যায় ‘খুচরা মূল্যের’ ভিত্তিতে করারোপ করা; প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৩৫ টাকা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার উপর ৫ টাকা ও প্রতি ১০ গ্রাম গুলের উপর ৩ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার সুপারিশ করা হয়।

এ সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে প্রায় ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে। সিগারেটের ব্যবহার ১৪ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে প্রায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বিড়ির ব্যবহার ৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ১ মিলিয়ন বর্তমান ধূমপায়ীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ প্রস্তবনা বাস্তবায়ন হলে ৬ হাজার ৬৮০ কোটি থেকে ১১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার মধ্যে (জিডিপি’র ০ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত) অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে। এই অতিরিক্ত রাজস্ব তামাক ব্যবহারের ক্ষতি হ্রাস, অকালমৃত্যু রোধ এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে ব্যয় করা সম্ভব হবে।  

প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে ১৫ বছরের নিচের জনসংখ্যা (শিশু) প্রায় ৫ কোটি। এই ৫ কোটি শিশুকে তামাকমুক্ত রাখাটা সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। মায়ের গর্ভে যখন শিশুর ভ্রুণ জন্ম নেয় তখন থেকে তামাকের কারণে সে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। বাবা কিংবা পরিবারের সদস্যদের পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন মা। তার মাধ্যমে গর্ভের শিশু আক্রান্ত হয়। আমাদের দেশে মহিলাদের ধূমপানের প্রবণতা পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায়  কম, তবুও শ্রমিক শ্রেনি ও শিক্ষত ধনিক শ্রেনির মহিলাদের মধ্যে সাম্প্রতিককালে ধূমপানের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহিলাদের মধ্যে পান খাওয়ার প্রবণতা অত্যাধিক। পানের সাথে জর্দ্দা খাওয়ার কারণে তাদের গর্ভের শিশু ক্ষতির শিকার হয়। 

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, তামাক ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশের ১২ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত প্রধান ৮টি রোগে আক্রান্ত হয়। এর ফলে রোগীর চিকিৎসা, অকাল মৃত্যু, পঙ্গুত্বের কারণে বছরে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। অন্যদিকে তামাকখাতে সরকারের বছরে প্রায় ২ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা আয় করে। সুতরাং, তামাকের ব্যবহারের ফলে দেশের অর্থনীতিতে বছরের নীট ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। বর্তমানে এ ক্ষতির পরিমাণ স্বাভাবিকভাবে অনেক বেশি। দেশে বছরে ৮ হাজার কোটি শলাকা সিগারেট এবং ৫ হাজার কোটি শলাকা বিড়ি উৎপাদিত হয়। বছরে যে পরিমাণ বিডি-সিগারেট বাংলাদেশের মানুষ সেবন করে তার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। যা দিয়ে প্রতি বছর অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করা সম্ভব। 

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন তামাকের ক্ষতি এবং ব্যবহারের ব্যপকতা কমাতে বাংলাদেশে ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন পাশ করা হয়। ২৬ মার্চ, ২০০৫ হতে এই আইন কার্যকর হয়। এ প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালে পূর্বের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বেশ ক’টি ধারাতে সংশোধনী আনা হয় এবং মহান জাতীয় সংসদে ২৯ এপ্রিল ২০১৩, উক্ত সংশোধনী বিলটি পাশ হয়। এতে কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধুমপান করলে তিনি অনধিক ৫০ টাকা অর্থদ-ে দ-নীয় হওয়ার বিধান রয়েছে। তামাক উৎপাদনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এর বিরুদ্ধে অনূর্ধ্ব ৬ মাস বিনাশ্রম কারাদ- বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-নীয় হওয়া বিধান রয়েছে। তবুও থামছে না আগ্রাসন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ