মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

চার বছর পর লেবানন থেকে শূণ্য হাতে ফিরল গৃহ-শ্রমিক সাফিয়া

স্টাফ রিপোর্টার : চার বছর পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবানন থেকে খালি হাতে গতকাল সকালে দেশে ফিরেছে গৃহকর্মী সাফিয়া। ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার শেকড়কাটির বাসিন্দা মৃত নূর হোসেন রাড়ির স্ত্রী সাফিয়া বেগম। স্বামী ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। ৮ বছর আগে বিধবা হবার পর ঠাঁই মিলেছে ছোট বোনের বাসায়। সঙ্গে ছিল একমাত্র শিশুপুত্র শাহীন রাড়ি(বর্তমানে কলেজপড়ুয়া)। বোন শাহিনুরেরও স্বামী নেই। ছোট বোনের ছেলে নূরে আলম ঢাকার এক ফায়ার সার্ভিস ইউনিটে ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি একাই চালাতেন সব খরচ। তবে এভাবে আর কয় দিন।
জীবীকার টানে যখন কোনো কাজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন স্থানীয় দালালের সন্ধান দিয়ে যেন ঈদের চাঁদ হাতে এনে দেন সাফিয়া বেগম-এর চাচাতো ভাই-এর জনৈক স্ত্রী। ৪ বছর আগে সেই দালাল নাসিমা ও মানিক জুটি তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননে ভালো চাকরি দেবার কথা। দামি ফোন, ভালো খাবার, ভালো পোশাক-আশাক ইত্যাদি পাওয়া যাবে সেখানে গেলে। শেষে গ্রামের বিভিন্ন জনের থেকে ধার করে আনা ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে মাসিক ১৫০ ডলারের(বাংলাদেশী ১২ হাজার টাকা) চাকরির খোঁজে লেবানন পাড়ি জমায় সাফিয়া। নগদ ৮০ হাজার টাকা তুলে দেন সেই দুই দালালের হাতে। নামেমাত্র ট্রেনিং ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে লেবাননে এসে গৃহশ্রমিকের চাকরি পায় সে সেখানকার এক মাইক্রো ড্রাইভার আলী নাজেম এর বাসায়। তবে এসেই যেনো দালালদের দেখানো সব স্বপ্ন একে একে চোখের সামনে ভাঙতে শুরু করে সাফিয়ার। ভালো খাবার, পোশাক এগুলোতো দুরে থাক উল্টো বছর না ঘুরতেই বেতন চাইলেই মারধরসহ কথায় কথায় অমানুসিক নির্যাতন শুরু করে বাড়ির মালিক ও তার স্ত্রী-সন্তানেরা। প্রতিদিনই নানা বাহানায় গৃহকর্তা ও তার পরিবারের লোকজন একের পর এক নির্যাতন চালাতে থাকে।
দেশে কারো সাথে কথা বলতে যেনো না পারে, এই জন্য হাতে মোবাইল পর্যন্ত কেরে নেয়। এমনকি একবার প্লাস  দিয়ে টেনে তার বা পায়ের বুড়ো নখ উপরে ফেলার চেষ্টা করে তারা। শুধু এই নয়, সাফিয়াকে খেতে দেয়া হতো পচা ছানা, বাসি ও পোড়া খাবার। পানি খেতে দেয়া হতো না। না পেরে বাথরুম এ গিয়ে পানি খেতো সে। একটু সস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারতো না সে, খাবার আর পানির অভাবে যখন সে আর কাজ করতে পারছিলো না তখন তাদের কাছে মিনতি করে যাতে তার বেতনের টাকা দিয়ে তাকে একটু ডাক্তার দেখানো হয়। কিন্তু এতেও উল্টো মারধর করে কাজ ফাঁকি দেয়ার কথা বলে। ১২ তলার বিশাল এপার্টমেন্টের দৈনন্দিন কাজ আর নির্যাতনের শিকার সাফিয়াকে আটকে রাখে এরপরের প্রায় ৩ বছর ২ মাস। এই সময়ের কোনো বেতন দেয়া হয়নি তাকে। বারবার পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ সাফিয়া একসময় ১১ তলার ফ্লোরের এক নারী গৃহশ্রমিকের সাহায্য নিয়ে বাড়িতে এসব কথা জানালে ছোট ভাই রহিম খান প্রায় ১ বছর আগে সেখানকার স্থানীয় থানায় একটি মামলা করলে পুলিশ আটক করে দালাল মানিককে। তবে এর ২/৩ মাস পরই ছাড়া পেয়ে যায় সে। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে সেই ১১ তলায় কর্মরত গৃহশ্রমিকের সাহায্যে প্রায় দেড়-দুই মাস আগে ফোন করে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী সোনিয়া দেওয়ান প্রীতিকে। যিনি এসব অসহায় নির্যাতিত প্রবাসী নারী শ্রমিকদের কল্যাণে এবং তাদের অধকার আদায়ে কাজ করেন। তবে ভাগ্য সহায় না হওয়ায় সেই সময় তিনি গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তার সাহায্য পৌছেনি অসহায় সাফিয়া পর্যন্ত। সম্প্রতি ৩/৪দিন পূর্বে সোনিয়া দেওয়ান প্রীতির সাথে পূনরায় যোগাযোগ করে সমস্ত ঘটনা খুলে বললে তিনি কোনোমতে গৃহকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী শুধু দেশে এসে পৌছাবার পরামর্শ দেন।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি বলেন, আসলে আমার একটি বড় ধরনের সার্জারি হওয়াতে আমি তখন সাফিয়া সহ অন্য অনেকের পাশেই দাঁড়াতে পারিনি। তবে সাফিয়ার সাথে যোগাযোগ হলে কথা বলে তাকে খুব ভীত ও দুর্বল মনে হয় এবং সে কোনোভাবেই স্থানীয় দালালদের বাইরে রিক্রুটিং এজেন্সির নাম-ঠিকানা জানাতে পারেনি। আর ওইদিকে গৃহকর্তা তাকে এবার দেশে পাঠিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। তাই তাকে আপাতত যে কোনো উপায়ে দেশে এসে পৌছাবার পরামর্শ দেই। তারই অনুরোধে গতকাল  ভোরে তাকে বিমানবন্দরে গিয়ে রিসিভ করে তার গত ৪ বছরের সমস্ত কষ্টের কথা শুনি। রিক্রুটিং এজেন্সির নাম-ঠিকানা বলতে পারলে আমরা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষন ব্যুরো বরাবর অভিযোগের ভিত্তিতে তার দীর্ঘ কয়েক বছরের বাকি থাকা বকেয়া বেতনের জন্য জোড়ালো চেষ্টা করতে পারব। এছাড়া সাফিয়া ও তার পরিবারকে সাথে নিয়ে আমরা দালালদের উপযুক্ত শাস্তিরও ব্যবস্থা করব।
এদিকে, কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাফিয়ার দাবি সে যেন সরকার ও সংশ্লিষ্টদের থেকে সুষ্ঠু বিচার পায়। পাশাপাশি তিনি তার এত বছরের আটকে থাকা পারিশ্রমিক ফিরে পাবার জন্য অনুরোধ করেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ