শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

কবি ফররুখের "স্বর্ণ-ঈগল" কবিতা ও বাস্তবতা

আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন : কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর হাতে রচিত হয়েছে অজস্র ও অনন্য কবিতা। তাঁর চার দশকের সাহিত্যকালে তিনি প্রায় অধিকাংশ কবিতায় হয়তো দিক নির্দেশনা দিয়েছেন নয়তো হুশিয়ার করছেন না হয় আহবান করেছেন সূর্য সোনালী সত্যের পথে। তিনি আলোচিত সমালোচিত হওয়ার পরও তিনি রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মেধা মননে তিনি হাজার বছরের পথ নির্দেশ করেছেন মানবতাকে। সওগাত প্রকাশিত আবু রুশদের মন্তব্য ছিলো এমন-তিনি আধুনিক কবি, তার বলিষ্ঠ সজাগ তীক্ষè অনুভূতিশীল মন আছে।  সুদূরের প্রতি আকর্ষণ ও তার কাব্যের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। 

"স্বর্ণ-ঈগল" অর্থ বিশ্লেষণ করতে প্রকাশ পায় ক্ষমতার দাপট। স্বর্ণ অতীব মূল্যবান ধাতু। যা মানব সমাজে আজীবন লোভনীয় ও লালায়িত। আর "ঈগল "পাখির রাজা। ঈগল দূর থেকে তার নিশানা ঠিক করে। নিজে পরিশ্রম করে খাবার জোগাড় করে, জীবিত প্রাণীর তাজা খাবার খায়। ক্ষমতাধর মানুষগুলোকে তিনি ঈগলের সাথে তুলনা করে যথার্থ নামকরণে সার্থকতা দেখিয়েছেন। অসম্ভব মেধার পরিচয় পেশ করেছেন।

তাঁর "স্বর্ণ-ঈগল" কবিতাটি তারই প্রমাণ। তিনি "স্বর্ণ ঈগল" কবিতায় একটি সময়ের বর্ণনা করতে গিয়ে জাতিকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। 

" আল-বোরজের চূড়া পার হ'ল যে স্বর্ণ ঈগল গতির বিদ্যুত নিয়ে, উদ্যাম ঝড়ের পাখা মেলে, ডানা ভাঙ্গা আজ সে ধুলায় যায় পায় ঠেলে কঠিন হেলার কোটি গর্বোদ্ধত পিশাচের দল। মাটিতে লুটানো আজ সেই স্বর্ণপক্ষ, অনুতল! "

কবিতাটি যেন আজই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ভোরের পেপারে ছাপা হওয়ার উপযোগী এক অনবদ্য কবিতা। ইরানের সুউচ্চ পর্বত ডিঙিয়ে যে দল পার হলো আশির দশকে তা আজ অস্তিত্ব বিলীন। দূরবীণ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবেনা তাদের। নব্বইয়ের দশকে যাদের দাপটে তিল ঠাঁই হতোনা, বিদ্যুত গতিতে উদ্দাম ঝড়ের বেগে যারা ছিলো আনাচে কানাচে, সেই দলবল আজ নিশ্চিহ্নের পথে। মাটিতে লুটানো আজ তারা। কি বাস্তবতা কি ভবিষ্যত ভাবনা, কি সুক্ষè চিন্তা শক্তি! 

আরো লিখেছেন তিনি "আলো, বাতাসের সাথী, তুফানের সওয়ার নির্ভীক অন্তিম লগ্নের ছায়া দেখে আজ সে মৃত্যু-যান্ত্রিক, অতল কূপের তীরে পাষাণ-সমাধি, জগদ্দল। সূর্য আজ ডুব দিলো অক্সাসের তটরেখা পারে, আসন্ন সন্ধ্যায় কালি নিয়ে এল পুঞ্জীভূত শোক, পাহাড় ভুলের বোঝা রূদ্ধপথে দাঁড়ালো নির্মম। 

এখানে বহে না হাওয়া এ বিস্তীর্ণ প্রান্তরের ধারে, এই অজগর রাত্রী গ্রাসিয়াছে সকল আলোক,

সোহরাবের লাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুস্তম।

 আজ পাষাণদের সমাধি হচ্ছে অতল কূপের তীরে। যান্ত্রিক মৃত্যু। শোক নিয়ে এলো ভাগ্য রেখায়। সবই পাহাড়সম ভুলের মাসুল। পথ রূদ্ধ করে দাঁড়ালো নির্মমভাবে। তিনি খুব দরদের সাথে সময়কে অবলোকন করেছেন। সত্য সমাগত মিথ্যা বিতাড়িত। ভুল আর অপরাধ এক সময় সবার মাথা চেপে ধরে। রাজা -বাদশাহ, ধনী- নির্ধনী, ফকির- মিসকিন, সবাই তার ভুলের জবাব দিতে হবে। অন্ধকার কেয়ামত সবাইকে ঘিরে ফেলবে সে সময় বাতাসও বইবেনা। সোহরাবের লাশের মাতম নিয়ে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই। 

কবি ফররুখ আহমদ তাঁর কাব্য যাত্রা শুরু করেছিলেন দূর যাত্রার এক অসম্ভব গতিময়তার মধ্য দিয়ে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত ‘রাত্রি’ কবিতায় উচ্চারিত হয়েছিল কবির জাগ্রত হওয়ার আহবানের এক শুভ উদ্বোধন :

“ওরে পাখি, জেগে ওঠ, জেগে ওঠ রাত্রি এল বুঝি,

ঘুমাবার কাল এল জাগিবার সময় যে যায়

ওরে জাগ্ জাগ্ তবু অকারণে।

বিখ্যাত "পাঞ্জেরী" কবিতায় প্রশ্ন করেছেন রাত পোহাবার কত দেরী?

সাত সাগরের মাঝি গ্রন্থের এ দুটি কবিতায় কবির সুদূর আকুতি প্রকাশ পায় স্পষ্টভাবে। ঘুরে ফিরে তিনি একই বৃত্তে এনে দাঁড় করিয়েছেন জবাবদিহিতায়। যারা রাজা হবেন তারা ক্ষণিক সময়ে নিজেকে রাজাধিরাজ মনে করে সবই করতে পারে কিন্তু অতীত শিক্ষা দেয় অচিরেই তারা বিলীন হয়ে পড়ে। সোহরাব রুস্তমের মতো শক্তিশালীও লাশের বোঝা হতে সময় লাগেনা। 

তাঁর স্বর্ণ-ঈগল কবিতাটি বহু বছর পরেও তরতাজা আর সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত মনে হবে। কালোত্তীর্ণ কবিতা এই কবিতা ফররুখ আহমদের দার্শনিক তত্ত্বের চিন্তা ধারারও প্রকাশ ঘটে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ