বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

এত উন্নয়ন তবু সুশাসনের অভাব

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : উন্নয়নের নামে সুশাসনের বারোটা বাজিয়ে টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সুশাসন না থাকলে উন্নয়ন মানুষের কাজে লাগে না। এত উন্নয়ন  হয়েছে তারপরও কিছু মানুষ কেন হায়েনার মতো আরেকটি মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। বিকৃত হচ্ছে জনপদের চেহারা। এই বিষয়টি আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। গত বুধবার প্রকাশ্যে দিন দুপুরে বরগুনা শহরের কলেজ রোডে কোপানো হয় রিফাত শরীফকে। এতে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর স্ত্রী আয়েশা আক্তার তা ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নরপশুরা তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফের হামলা চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। ভাবা কি যায়? স্ত্রীর কাঁধে স্বামীর লাশ। প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার ঘটনা বরগুনাতেই প্রথম ঘটেছে তা কিন্তু নয়! এর আগে ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর পল্টন ময়দানের ঘটনা ও বিশ্বজিৎ হত্যার দৃশ্য মনে হলে আজোও গা শিউরে উঠে। প্রতিহিংসার রাজনীতি সমাজ ও দেশ থেকে যতদিন বিতাড়িত না হবে ততদিন অশান্তির আগুনের লেলিহান আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে যাবে। আমরা আশা করব রাষ্ট্র সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদেরকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করবে।
মানুষ ছাড়া বন বাঁচে। কিন্তু বন ছাড়া মানুষ বাঁচে না। মানুষ ছাড়া নদী বাঁচলেও পানি ছাড়া মানুষ বাঁচে না। বাতাস মানুষের প্রয়োজন। কিন্তু দুষিত বাতাস মানুষের কি প্রয়োজন? একটি আধুনিক রাষ্ট্রের বস্তুগত উন্নয়ন কতটা মানুষের জন্য তা বুঝার জন্য অর্থনীতির মহাপন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। দেশটির বন,নদী, পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা ও মানুষের জীবনযাত্রার মান কেমন তা বিশ্লেষণ করলেই উন্নয়নের চিত্রটা চোখের সামনে ভেসে উঠবে। একটি উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতার মাপকাঠি তিনটি-মাথাপিছু আয়,মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি হ্রাস। অথচ বাংলাদেশে এই সূচকগুলো বিতর্কিত। উন্নয়নের শ্লোগান দিয়ে বাজিমাত করা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু ভারসাম্য উন্নয়ন হচ্ছে কি না সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। উন্নয়নের আফিমে জাতিকে বুঁদ রেখে সোনালী ব্যাংক,জনতা ব্যাংক,ফার্মার্স ব্যাংক,বিসমিল্লাহ গ্রুপ বা হল-মার্ক, শেয়ারবাজার লুটেরাদেরকে শাস্তি না দিয়ে উল্টো তাদের কুক্ষিগত সম্পদকে সমাজের দশজনের গড় সম্পদ হিসেবে চালিয়ে দিলে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়বেই। এটাই তো স্বাভাবিক! মানুষের মুখ দেখে যেমন তার রাগ, ক্ষোভ,দুঃখ আনন্দ-বেদনা বোঝা যায় তেমনি একটি দেশের রাজধানীর চেহারা দেখেও দৃশ্যমান উন্নয়ন সর্ম্পকে ধারণা পাওয়া যায়। অথচ এখনও রাজধানীর ফুটপাতে অসংখ্য দরিদ্র মানুষের রাত্রিযাপনের করুন দৃশ্য দেখা যায়। ফুটপাতের ছিন্নমূল মানুষের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। প্রাণপ্রিয় এই শহর বায়ুদূষণের ক্ষেত্রেও রেকর্ড ভাঙছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয়। ভারতের রাজধানী দিল্লি আমাদের থেকে একটু এগিয়ে থাকলেও দিন কয়েক এর ব্যবধানে হয়তো আমরা দিল্লিকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করবো। এই বিষয়গুলোর সুরাহা করতে না পারলে উন্নয়নের গতিধারা বর্ষার বাদলে ডুবে যাবে।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও আইনের শাসন তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যে কারণে সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। উন্নয়নের নামে আইনের শাসনকে ভুলন্ঠিত করা কারও কাম্য হতে পারে না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে তিনটি লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই সাম্য,সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা উন্নয়নের নামে ভুলন্ঠিত করার অধিকার কারও নেই। উন্নয়ন হয়নি এটা বলছি না। কিন্তু উন্নয়নের জোয়ারে ধনিক শ্রেণির আয়তন ও জিডিপি বাড়ার সাথে সাথে কত নদী বিনাস হলো,কত বন উজাড় হলো,বাতাস কত দূষিত হলো,মানুষের জীবন কত বিপন্ন হলো, নাগরিকদের বঞ্চনা ও বৈষম্য কত প্রকট হলো,বিরোধী মতালম্বীদের ওপর নিপীড়নের নিষ্ঠুরতা,এসব উন্নয়নের নামে জায়েজ করা মোটেও সুখকর নয়। এই সরকার  বলছে তাদের সময়ে নাকি সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে। সুতরাং দেশের স্বার্থে তাদেরকে ক্ষমতায় থাকতে হবে। তাদের অন্য রেকর্ড যা-ই থাকুক না কেন। উন্নয়নের স্লোগানে গুম, খুন, অপহরণ, গায়েবী মামলা, ভোট-জালিয়াতি সবই এখন জায়েজ করা হয়েছে। অথচ গুম হওয়া পিতার জন্য সন্তানের বুকফাটা আর্তনাদ,সন্তান হারা পিতা-মাতা ও স্বামী হারানো স্ত্রীদের কান্নার আওয়াজ ইথারে ইথারে ভাসছে। উন্নয়ন কেবল এক সরকারই করে না। সব সরকারই কম-বেশি করে থাকে। প্রত্যেক সরকার তার আগের সরকারের ভিত্তিকে পুঁজি করেই উন্নয়ন করে। একটি সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তখন আগের সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ করে দেয় না। বরং তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।
বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। এটা কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু সে উন্নয়নের সুফল কি সবশ্রেণি পেশার মানুষ পাচ্ছে? এই প্রশ্ন যে কেউ করতেই পারেন। কারণ একদিকে অতি ধনী হওয়া মানুষের সংখ্যা যেমন বাংলাদেশে বাড়ছে তেমনি বিশ্বের অধিক দরিদ্র মানুষগুলো যে পাঁচটি দেশে বসবাস করছে সেই তালিকায়ও বাংলাদেশ আছে। সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে গত ছয় বছরে জিডিপি বাড়ার দিনগুলোয় সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে ৩২ হাজার  কোটি টাকা। আর সবেচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে ১০৫৮ টাকা। অর্থাৎ মাথাপিছু আয়ের এই সূচকটি উন্নয়ন আইনের শাসন কিংবা মানুষের ভালো থাকার কিছ্ইু বোঝায় না। জনগণের জন্যই তো উন্নয়ন। অথচ একশ্রেণির মানুষ ব্যতীত উন্নয়নের ছোয়া সব মানুষের দূর গোরায় যায়নি। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান, গরিব মানুষের চিকিৎসা ব্যয় ফ্রি ও বেকার ভাতার ব্যবস্থা করা হতো তাহলে উন্নয়নশীল দেশের স্লোগান সত্যিই প্রেরণা জুগাইতো। এই সরকারের আমলে প্রচুর  ভৌতিক অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। সরকার সারা দেশে বেশ কয়েকটি বৃহৎ আকারের ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেমন উড়াল সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পদ্মাসেতুর মতো বহু মেগাপ্রকল্প সরকার বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রায় সব কয়টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে নির্দিষ্ট সময়ের পরও অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। এমনকি ব্যয় ৩ থেকে ৪ গুণ বেড়ে যাচ্ছে। এসব প্রকল্পের ব্যয় ভারত, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিলার তুলনায় অনেক বেশি। প্রতিটি প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পর প্রকল্পগুলোর চূড়ান্ত ব্যয় যদি এভাবে বাড়তে থাকে তাহলে বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রকল্প ব্যয়ের তকমা পেতে আমাদের অসুবিধা হবে না। দেশের প্রতিটি বাজেটে বরাদ্দ করা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। অথচ উন্নয়ন কাজের ন্যূনতম মানও রক্ষা করা হচ্ছে না এমন অভিযোগ এখন ওপেন সিক্রেট। উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে অসৎ ঠিকাদার ও দুর্নীতিবাজ একশ্রেণি লোভী সরকারি কর্মকর্তা। সাধারণ মানুষের অর্জন প্রায় শূন্যের কোঠায়। রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে সরকারি কাজের ষোলো আনার মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বারো আনাই থাকে ফাঁকি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চার আনা কাজও হয় না। আবার কাজ না করেও অর্থ ছাড় হয়েছে এমন নজিরও আছে।
গণতন্ত্র নিয়ে শাসক দলের মনোভাব বড়ই চমৎকার। তাদের যুক্তি আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র। তাদের এ ধারণা স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানায়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কখনও গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে  টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না।  দেশের উন্নয়নকে দৃশ্যমান করতে যত কৌশলের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে তার সিকি ভাগ যদি আইনের শাসন ও জনগণের সামগ্রিক কল্যাণের কথা চিন্তা করা হতো তাহলে “বিতর্কিত ২০১৮ ডিসেম্বর” একটি জাতীয় নির্বাচন প্রহসনের নির্বাচনের খেতাব পেত না। উন্নয়নের ফিরিস্তির চিত্র তুলে ধরাই শাসকদলের অন্যতম রাজনৈতিক শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। অথচ চিত্রের বিপরীত দিকে তাকালে দেখা যাবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নাগরিক সমাজে নিরাপত্তাহীনতা, অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থাহীনতায় ক্রমাগত উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। অথচ এই বিষয়গুলির ব্যাপারে শাসকদল ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারছে না। উন্নয়নের কথা বলে   কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার এখতিয়ার কারও নেই।  টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। গণতন্ত্রহীনতা ও জবাবদিহীতা ও আইনের শাসন ভুলন্ঠিত হওয়া উন্নয়নের পরিচায়ক নয়। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে আইনের শাসন সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। সরকার উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে,এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ