শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

জেমস বন্ড থেকে যেভাবে নয়ন ‘বন্ড’

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : বরগুনা শহরে প্রকাশ্য রাস্তায় শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার তদন্তের মধ্যেই আলোচনায় এসেছে ফেইসবুক মেসেঞ্জারে বন্ড ০০৭ নামে একটি গ্রুপের কিছু কথোপকথন। বলা হচ্ছে, ওই ফেইসবুক গ্রুপেই রিফাতকে হত্যার পরিকল্পনা সাজানো হয়। এই গ্রুপের নামকরণ হয়েছে জেমস বন্ডের কোড নম্বর ‘জিরো জিরো সেভেন’ এর সঙ্গে মিল রেখে। আর এই গ্রুপের নেতা হলেন রিফাত হত্যার হোতা নয়ন বন্ড, যাকে পুলিশ গত তিন দিনেও গ্রেফতার করতে পারেনি।
প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্র জেমস বন্ড। তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র ও কমিকস। বাংলাদেশে জেমস বন্ড না থাকলেও একজন নয়ন বন্ড আছেন। তিনি নিজেই এই উপাধি নিয়েছেন। তাঁর শক্তির উৎস মাদক ও ক্ষমতার রাজনীতি।
পরিবারের দেওয়া নাম সাব্বির আহম্মেদ, ডাক নাম নয়ন। নিজেকে জেমস বন্ড ভাবতে ভালোবাসেন বলে ২৫ বছর বয়সী ওই যুবক নিজের নাম নিয়েছেন নয়ন বন্ড। ওই নামেই তিনি বরগুনা শহরে পরিচিত। তার মোটর সাইকেলে, বাড়ির দেয়ালে- নানা জায়গায় লেখা রয়েছে বন্ডের সেই ০০৭ কোড নামটি।
বরগুনা সদর থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন জানান, পৌর শহরের বিকেবি রোডের ধানসিঁড়ি এলাকার আবু বক্কর সিদ্দিকীর ছেলে নয়নের বিরুদ্ধে মাদক কেনাবেচা, চুরি, ছিনতাই, হামলা, সন্ত্রাস সৃষ্টিসহ নানা অভিযোগে অন্তত আটটি মামলা রয়েছে।
নয়নের গড়ে তোলা গ্যাং ০০৭ শহরের কলেজ রোড, ডিকেপি, দীঘির পাড়, কেজিস্কুল ও ধানসিঁড়ি এলাকায় নানা ধরনের অপরাধ চালিয়ে আসছিল বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
তারা বলছেন, ওই গ্রুপে নয়নের প্রধান সহযোগী হলেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে রিফাত ফরাজী।
রিফাত ফরাজীর পাশাপাশি তার ভাই রিশান ফরাজীকেও পুলিশ খুঁজছে বলে ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন জানান।
নয়ন বন্ড যেভাবে তৈরি...
প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্র জেমস বন্ড। তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র ও কমিকস। বাংলাদেশে জেমস বন্ড না থাকলেও একজন নয়ন বন্ড আছেন। তিনি নিজেই এই উপাধি নিয়েছেন। তাঁর শক্তির উৎস মাদক ও ক্ষমতার রাজনীতি।
গত বৃহস্পতিবার যখন প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে রিফাত শরীফকে হত্যা করা হয় , তার পর থেকেই সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ডের পরিচয় প্রকাশ পেতে শুরু করে। তিনি এলাকায় মাস্তান হিসেবে পরিচিত ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। নিজেও মাদক সেবন করেন। বরগুনার বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এবং পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়টি বের হয়ে আসে। নয়ন বন্ড কোনো পদে না থাকলেও আত্মীয়তা ও ‘বড় ভাই’ সূত্রে ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১১ সালে এসএসসি পাস করে নয়ন আর পড়াশোনা করেননি। তাঁর বন্ধু রিফাত ফরাজী ও তাঁর ছোট ভাই রিশান ফরাজী সাবেক সাংসদ ও বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে।
বরগুনার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন সাংসদ ও সাবেক উপমন্ত্রী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। গত সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের এই দুই নেতা একে অপরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দখলবাজি, মাস্তানি, মাদক ব্যবসা, বিএনপি-জামায়াত তোষণের অভিযোগ আনেন। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ী নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলেননি। বরং উভয় পক্ষ তাঁদের হাতে রাখার চেষ্টা করেছেন। এটি তাঁদের ও সহযোগীদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে স্পষ্ট।
রিফাতের হত্যাকারীদের প্রশ্রয়দাতা আলোচনায়
দিবালোকে শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা মামলার মূল আসামিরা জেলা আওয়ামী লীগের চিরচেনা দুই প্রতিপক্ষের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ও বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড. ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর পক্ষের লোকজনের অভিযোগ, রিফাতের হত্যাকারী রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। দেলোয়ার হোসেনের প্রশ্রয়েই এ দুই ভাই রিফাত হত্যার মতো অপরাধে দুঃসাহসী হয়ে উঠে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে দেলোয়ার হোসেন দাবি করেছেন, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে ও জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক অ্যাড. সুনাম দেবনাথের ছত্রছায়ায় রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ডসহ অন্যরা বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছে বলে তিনি শুনেছেন।
রিফাত হত্যার পর গত ২৭ জুন হত্যাকারীদের ফাঁসি চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন সুনাম দেবনাথ। এতে তিনি রিফাত হত্যা মামলার প্রধান দুই আসামী রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীকে বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে উল্লেখ করে এ দুই ভাইয়ের বিভিন্ন সময়ে ঘটানো কিছু অপকর্মের চিত্র তুলে ধরেন। একইসঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে দেলোয়ার হোসেনের কাছে গেলে তিনি অভিযোগকারীদের নানাভাবে অপদস্ত করতেন। আর তার এমন প্রশ্রয়ে ওই দুই ভাই এতো বেপরোয়া হয়ে উঠে। তবে সুনাম দেবনাথের এ ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে কথা উঠলে তিনি স্ট্যাটাসটি ‘হাইড’ করে ফেলেন।
সুনাম দেবনাথের ফেসবুক স্ট্যাটাস নজর এড়ায়নি দেলোয়ার হোসেনের। এ নিয়ে শুক্রবার (২৮ জুন) রাতে বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। এসময় তিনি হত্যাকারীদের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই দাবি করেন এবং হত্যাকারীদের ফাঁসি চান।
২৭ জুন হ্যাশট্যাগ দিয়ে ফেসবুকে সুনাম দেবনাথ লিখেন, ‘আমার ভাইয়ের জীবন গেলো রক্ত-স্রোত-বন্যায়/ক্ষমতাধরের ভায়রার ছেলে, মুখ খোলা তাই অন্যায়!’ এরপর তিনি লিখেন, ‘প্রথমেই আমরা স্পষ্ট হবো নাম নিয়ে। কারণ যে মারা গেছে আর যারা মেরেছে তাদের নাম এক হওয়াতে আমরা গুলিয়ে ফেলছি। কাকতালীয়ভাবে দুই জনের বাবার নামও এক। যে ছেলেটিকে হত্যা করা হলো তার নাম রিফাত শরীফ, পিতার নাম দুলাল শরীফ, সাং: ৬ নং ইউনিয়ন। আর হত্যাকারীদের মধ্যে প্রধান হচ্ছে নয়ন এবং তার সহযোগী হচ্ছে রিফাত ফরাজী, পিতা দুলাল ফরাজী, সাং বরগুনা ধানসিঁড়ি রোড এবং আরেক সহযোগী হচ্ছে রিফাতের ছোট ভাই রিশান ফরাজী, পিতা ও সাং: ওই। এই রিফাত ও রিশানের অন্য এক পরিচয় রয়েছে, তারা দু’জনই সাবেক সাংসদ ও বর্তমান জেলা চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। যারা আদর করে তাকে (দেলোয়ার হোসেন) বাবা বলেই সম্মোধন করে।’
সুনাম দেবনাথের স্টাটাসে উল্লেখ, ‘রিফাত ও নয়নদের আরও একটি পরিচয় আছে। তারা অত্র এলাকায় এমন কোনও ছাত্রাবাস নাই; যেখান থেকে ছাত্রদের ল্যাপটপ, মোবাইল, টাকা ইত্যাদি চুরি বা ছিনতাই করে নিয়ে আসে নাই। এ নিয়ে বহুবার মামলা হয়েছে, বহুবার তারা জেল খেটেছে, কিছুদিন পর আবার ছাড়াও পেয়েছে। তাদের নামে কতগুলো মামলা রয়েছে তা থানা কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে।’
এই স্ট্যাটাসে বলা হয়েছে, ‘নয়ন (নয়ন বন্ড) সব থেকে বেশি নজরে এসেছে তখন, যখন সে একটি বড় ধরনের মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়েছিল। প্রায় ১২ লাখ টাকার মাদক নয়নের কাছ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। রিফাত ফরাজীর বিভিন্ন অপকর্মের নালিশ থানায় দেওয়ার পাশাপাশি তার খালু জেলা চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের কাছেও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বারবার নালিশকারীদের সেখান থেকে অপমান, অপদস্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।’
স্ট্যাটাসে প্রকাশ, ‘ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজনের নাম তরিকুল ইসলাম। ২০১৭ সালে একবার এই রিফাত আর রিশান ফরাজী সামান্য কথাকাটিতে তাকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছিল। এ নিয়ে তরিকুলের বাবা বাদী হয়ে থানায় মামলাও করেছিলেন। বিচার নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের খালু দেলোয়ার হোসেনের কাছে। কিন্তু অপমানিত হয়ে ফিরতে হয় তাদের। এরপর ভয়ে তিনি তার ছেলে তরিকুলকে বরিশালে পড়ালেখা করতে পাঠিয়ে দেন। বর্তমানে তরিকুল বরিশালে পড়ালেখা করছে। আরও একজন ভুক্তভোগী হচ্ছেন বরগুনা পৌরসভার একজন কাউন্সিলর, নান্না কমিশনার। তার বাসায় কিছু ছাত্র ভাড়া থাকে। সেখান থেকে এই রিফাত ফরাজী ৫টা মোবাইল ছিনতাই করে এবং এর প্রতিবাদ করায় এই রিফাত ফরাজী তার (নান্না কমিশনার) সামনে রামদা নিয়ে আসে। নান্না কমিশনার দেলোয়ার হোসেনের একজন প্রধান কর্মী হওয়াতে তার কাছে নালিশ দিলে তাকেও সেখান থেকে অপমানিত হয়ে আসতে হয়। এরকম ঘটনা রিফাত করতেই পারে না বলে তাকে (নান্না কমিশনার) সেখান থেকে অপমান করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ডিকেপি রোডের ডা. আলাউদ্দিনের বাসায় কিছু ছাত্র ভাড়া থাকতো; সেখান থেকে এই রিফাত প্রায় ২০টি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ ছিনতাই করে নিয়ে আসে। পরে তখনকার ওসি রিয়াজের হস্তক্ষেপে রিফাত ফরাজীর বাবাকে থানায় এনে সেই সব মোবাইল উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া, বিভিন্ন সময় তারা অন্য ছাত্রাবাস থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ ছিনতাই করে নিয়ে আসতো। এরকম আরও অনেক ঘটনা আছে, যা বলে শেষ করা যাবে না।’
স্ট্যাটাসটিতে সুনাম দেবনাথ উল্লেখ করেন, “যে ছেলেটির (তারিকুলের) ঘটনা প্রথমেই বলেছি, সে বর্তমান ঘটনার (রিফাত হত্যা) প্রেক্ষিতে ফেসবুকে লিখেছে, ‘২০১৭-তে আমার ঘটনার বিচার হলে আজ রিফাতের প্রাণ হারাতে হতো না”। লেখাটি কতটা গুরুত্ববহ, এখন আমরা বুঝতে পারছি।’
সুনাম দেবনাথের দাবি, ‘রিফাত শরিফ আমাদের খুব কাছের ছোট ভাই ও কর্মী ছিল। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাদের সঙ্গে থেকেই নির্বাচনি প্রচারণা করেছে। নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছে, রিফাতের মৃত্যু সংবাদে। তবে এ খুনের পেছনে আরও অনেক রহস্য আছে। বিভিন্ন মিডিয়াতে যাকে এখন হিরো বানানো হচ্ছে; মূল ভিলেন সে নিজেও হতে পারে। রিফাত শরিফের বন্ধুদের থেকে এখনপর্যন্ত যা জানা গেছে, তাতে এটাই বোঝা যায়, আর একটু সময় পার হলে হয়তো আরও ক্লিয়ার হওয়া যাবে।’
এ স্ট্যাটাসের ব্যাপারে সুনাম দেবনাথ বলেন, ‘আমি স্ট্যাটাসে যা লিখেছিলাম, সেটা দিনের আলোর মতো সত্য। আমি বলেছিলাম, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। আমি কোথাও বলিনি, তিনি খুনি বা তার নির্দেশে এই খুন হয়েছে।’
সুনাম দেবনাথের দাবি, ‘আমাদের কাছে নয়ন, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আসতো, তখন তার (দেলোয়ার হোসেন) কাছে পাঠালে তিনি বিচার না করে বরং উল্টো আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলতেন। কিন্তু সেই সময় যদি উনি তার ভায়রার ছেলেদের সঠিক বিচার করতেন, তাহলে আজকে তারা আর এত বড় অপরাধ করার সাহস পেতো না।’
আপনার ফেসবুক স্ট্যাটাস কেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, জানতে চাইলে সুনাম বলেন,  ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার বিষয়টি জেলা আওয়ামী লীগের নজরে এসেছে। তাই আমি স্ট্যাটাসটি হাইড করে রেখেছি।’
আপনার ছত্রছায়ায় নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী বিভিন্ন অপকর্ম করতো, বিভিন্ন সময় আপনি তাদের শেল্টার দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে, একথার জবাবে সুনাম দেবনাথ বলেন,  দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক বিরোধিতা দীর্ঘদিনের, সেটা বরগুনাবাসী জানে। এই ক্ষেত্রে তার লোকজনকে প্রশ্রয় দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। বরং বিভিন্ন সময় আমি তাদের আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। কিন্তু তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আবার বের হয়ে যেতো।’
এদিকে, সুনাম দেবনাথের স্ট্যাটাসের জের ধরে শুক্রবার রাতে বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন দেলোয়ার হোসেন। এসময় তিনি দাবি করেন, ‘রিফাত হত্যার ঘটনায় জড়িতদের আমি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। এই খুনের মূলহোতা নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী। ফেসবুকে দেখি, আমাকে নিয়ে একটা নোংরা খেলা শুরু হয়েছে। কারণ রিফাত ফরাজী আমার আত্মীয়। ওদের সঙ্গে আমার কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই। ওরা আমার ছেলেও না, ভাইও না, ভাইয়ের ছেলেও না, বোনের ছেলেও না, কিচ্ছু না। বিয়ের সূত্রে রিফাত আমার আত্মীয়। এমন অনেক আত্মীয় থাকে সবারই। তারা কেউ ভালো হয়, কেউ খারাপ হয়, কেউ চোর হয়, কেউ সন্ত্রাসী হয়, ডাকাত হয়। সুতরাং এখানে আমার ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার কারণটা কী, আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আমি এদের কোনোদিন প্রশ্রয় দিইনি।’
সুনাম দেবনাথের ফেসবুক স্ট্যাটাস প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ওদের (রিফাত ফরাজী ও রোশান ফরাজী) সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই গত ৪-৫ বছর ধরে; কোনও সম্পর্কই নেই।’
বিভিন্ন সময় আপনার কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলে আপনি নাকি অভিযোগকারীদের অপমান-অপদস্ত করতেন, এ প্রশ্নের জবাবে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট কথা।’ এসময় তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমি নয়ন বন্ডকে চিনি না। কিন্তু শুনেছি, এই নয়ন নাকি সুনামের শিষ্য। সুনামের নেতৃত্বেই নয়নরা বিভিন্ন অপকর্ম করতো।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু সূত্র জানায়, বিভিন্ন মামলায় নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী কারাগারে গেলে মোতালেব মিয়া ও হুমায়ন কবির পল্টু নামের দুই আইনজীবীর মাধ্যমে তারা শিগগিরই মুক্ত হয়ে যেতো। এই দুই আইনজীবী দেলোয়ার হোসেনের খুব কাছের লোক।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘রিফাত ও রিশান যখন মাদকে জড়ায়, তারপর থেকে আমি ওদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করি। আমার স্ত্রীকেও তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলি।’
আসামিদের পালানোর পথ বন্ধ, দু’দিনের মধ্যে গ্রেফতার
আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার সব আসামিকে দু’দিনের মধ্যে গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন। গতকাল শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে বরগুনা পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন তার কার্যালয়ে বসে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমরা বসে নেই। জালের ফাঁস ছোট হয়ে আসছে, আইনে ফাঁক গলে কেউ বাঁচতে পারবেনা। আসামিদের পালানোর সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এসপি আরও বলেন, হয়তো আর দু'দিন সময় লাগতে পারে মামলার সব আসামিদের আইনের আওতায় আনতে। আমি আবারও বলছি, আপনাদের সবার সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। রিফাত হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরই মধ্যে তাদের শুক্রবার (২৮ জুন) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
পটুয়াখালীতে এক যুবক আটক
রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় পটুয়াখালী জেলা থেকে সন্দেহভাজন এক যুবককে আটক করেছে বরগুনার আমতলী থানার পুলিশ। গতকাল শনিবার ভোরে তাকে আটক করা হলেও তা গোপন রাখা হয়। আমতলী থানার অফিসার ইনচার্জ আবুল বাশার বলেন, পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক সাইমুন নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন। সাইমুন বরগুনার স্টেডিয়াম সড়ক এলাকার হাজার বিঘা এলাকার ব্যবসায়ী কাওছার মিয়ার ছেলে এবং বরগুনা সরকারি কলেজের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
রিফাত হত্যার ঘটনায় জড়িত ও পলাতক আসামি রাব্বির মোবাইল সিমকার্ড ট্রাকিং ও অনুসন্ধান চালায় সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ। তারই ধারাবাহিকতায় ভোরে আমতলী থানার ওসি আবুল বাশারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল পটুয়াখালী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে সাইমুনকে আটক করে। পরে আরেক আসামির খোঁজে ওই দিন দশমিনা থানায় অভিযান চালায়। কিন্তু কাউকে আটক করতে পারেনি।
ওসি আবুল বাশার জানান, মোবাইল সিমকার্ড ট্রাকিং করে সাইমুনকে আটক করা হয়েছে। সাইমুন হত্যার বিষয়ে কিছু জানে না বলে জানিয়েছে। সাইমুনের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাইমুন পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ভিপি আব্দুল মান্নান মিয়া মেয়ের স্বামী।
আসামিদের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু
রিফাত হত্যা মামলায় আসামিদের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে প্রশাসন। গতকাল শনিবার  সকাল ৯টা পর্যন্ত অভিযুক্তদের পরিবারের অন্তত ১৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
২৬ জুন (বুধবার) সকালে বরগুনা সরকারি কলেজ রোডে প্রকাশ্য দিবালোকে স্ত্রীর সামনে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে সন্ত্রাসীরা। পরে বিকেলে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল (শেবাচিম) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মানা যান তিনি। রিফাত শরীফকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল ও গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপর  থেকে শুরু হয় প্রশাসনের তৎপরতা।
রিফাত শরীফের বাবা মো. আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার বরগুনা সদর থানায় অভিযুক্ত নয়ন বন্ডকে প্রধান আসামি করে ১২ জনের নাম উল্লেখসহ আরো ৫ থেকে ৬ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হলেন- সাব্বির আহমেদ নয়ন বন্ড (২৫), মো. রিফাত ফরাজি (২৩), মো. রিশান ফরাজি (২০), চন্দন (২১), মো. মুসা, মো. রাব্বি আকন (১৯), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রায়হান (১৯), মো. হাসান (১৯), রিফাত (২০), অলি (২২) ও টিকটক হৃদয় (২১) এছাড়াও আরো ৫ থেকে ৬ জন অজ্ঞাত আসামি রয়েছে।
বরগুনা সরকারি কলেজের ‘আতঙ্ক’ নয়ন
রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার পর একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। এ কান্ডে মূল অভিযুক্ত নয়ন বন্ড এখনও পুলিশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয় বাসিন্দা ও শির্ক্ষাথীরা বলছেন, এই নয়নই ছিল বরগুনা সরকারি কলেজের এক আতঙ্কের নাম। গতকাল শনিবার স্থানীয় গনমাধ্যমের কর্মীরা সরেজমিনে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে ঘটনাস্থলের আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পায়।
শিক্ষার্থীরা বলছে, বরগুনার কলেজ রোড, ডিকেপি, দীঘিরপাড়, কেজিস্কুল ও ধানসিঁড়ি সড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় দাপিয়ে বেড়াত নয়ন ও তার সহযোগীরা।
বরগুনা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ফাতেমা ও তার সহপাঠীরা বলেন, নয়নকে তারা চিনেন। নয়ন ও তার সহযোগীরা কলেজের সামনে আড্ডা দিত। সেখান দিয়ে যাতায়াত করলে বিভিন্ন ধরনের কথা বলত। কেউ কোনোদিন প্রতিবাদ করেনি।
আরেক শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম বলেন, কলেজের অলিখিত ভিপি ছিলেন নয়ন। আমরা তাকে নয়ন বন্ড হিসেবে চিনি। যখন তখন সে কলেজে ঢুকে চিল্লাফাল্লা করত। আমাদের ডেকে র‌্যাগ দিত।
কলেজের সামনে দোকানদাররা জানান, কলেজের সামনে এই রোডটাতে প্রতিনিয়তই নয়ন ও তার গ্রুপের সদস্যরা মারামারি করত। তারপর থেকে তাদের মারামারি নজরদারিতে আনতে এই রোড জুড়ে একাধিক সিসি ক্যামেরা বসানো হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মাদক কারবারি থেকে শুরু করে, মারামরি, ছিনতাইসহ নানা অভিযোগ নয়নের বিরুদ্ধে। আর সবগুলো কাজ এই কলেজ রোড এলাকায় করতেন নয়ন।
মূল নাম সাব্বির আহমেদ নয়ন হলেও কর্মকান্ডের জন্য রহস্য উপন্যাসের চরিত্র জেমস বন্ডের নাম নিজের নামে জুড়ে দেয় নয়ন। ফলে সহযোগীরা তাকে ডাকা শুরু করে ‘নয়ন বন্ড’ নামে।
জানতে চাইলে বরগুনা সদর থানার ওসি আবীর হোসেন বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে প্রত্যেকবারই গ্রেফতার ছিল নয়ন। তবে কারাগার থেকে বের হয়ে এসে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ত।
অবশ্য অনেকেই বলছেন, এলাকার চিহ্নিত অপরাধী হওয়া সত্বেও বিভিন্ন সময় প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় আইনে ফাঁক-ফোকর দিয়ে মুক্ত হতেন।  তারপর আরও ভয়ানক হয়ে উঠতে থাকেন।
অচেনাদের আনাগোনায় আতঙ্কে মিন্নির পরিবার
মাত্র তিন দিন আগেও স্বামী শাহ নেয়াজ রিফাত শরীফের সঙ্গে আনন্দঘন সময় কাটছিল আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির। কাটবেই বা না কেন! মাত্র দুই মাস আগেই বিয়ে হয়েছিল তাদের। নতুন জীবন শুরু করার উচ্ছ্বাস ছিল তাদের চোখেমুখে। তবে হঠাৎ মো. সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড নামক ভয়াল ঘাতকের আঘাতে মুহূর্তেই সব স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে যায় মিন্নির। চোখের সামনে স্বামীকে কোপানোর নৃশংস দৃশ্য দেখে এখনো আতঙ্কিত মিন্নি।
রিফাত হত্যার তিন দিন পর নতুন আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে মিন্নি ও তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। এবারের আতঙ্ক সন্ত্রাসী নয়ন বন্ড না হলেও তার সঙ্গী ও সহযোগীরা।
মিন্নির পরিবার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যাকান্ডের দিন থেকে অচেনা একদল লোকের আনাগোনা চলছে মিন্নিদের বাড়ির আশপাশে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৮ জুন) সন্ধ্যায় অজ্ঞাত একদল লোক মোটরসাইকেলে মিন্নিদের বাড়ির সামনের রাস্তায় আসে। তারা স্থানীয়দের কাছ থেকে মিন্নি ও তার পরিবারের বিষয়ে নানা কথা জিজ্ঞাসা করে। পরে বাড়ির সামনে পুলিশ দেখে দ্রুত চলে যায়।
মিন্নির পরিবারের অভিযোগ, অচেনা এসব লোকের মধ্যে স্বয়ং নয়ন বন্ড না থাকলেও তারা তার সঙ্গী ও সহযোগী হতে পারে। তারা নয়নের নির্দেশে এখনো মিন্নি ও তার পরিবারের লোকজনের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।
গতকাল শনিবার মিন্নির বাবা মোজ্জামেল হোসেন কিশোর ও মা জিনাত জাহান মুন্নীর সঙ্গে কথা বলে এসব কথা জানা যায়।
মিন্নির বাবা মোজ্জামেল হোসেন বলেন, আমাদের আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে। প্রতিনিয়ত নয়নের লোকজন রাতের বেলায় আমাদের বাড়ির সামনে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘোরা-ফেরা করছে। তারা সুযোগ পেলেই মিন্নি অথবা আমাদের ক্ষতি করবে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ির সামনের রাস্তায় কিছু লোকজন এসেছিল। আমাদের বাড়ির এক মুরব্বিকে তারা জিজ্ঞাসা করে- ‘রিফাতের বউ মিন্নির বাড়ি কোথায়।’ তিনি বয়স্ক হওয়ায় এতো কিছু না বুঝে তাদের বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দেয়।‘পরে তারা যখন বাড়ির দিকে আসতে শুরু করে তখন দেখে সামনে লোকজন। তখন তারা আবার মুরব্বিকে জিজ্ঞাস করে- ‘বাড়ির সামনে এরা কারা।’ তখন মুরব্বি বলেন, পুলিশ। এই কথা শুনে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়।’
তিনি বলেন, নয়ন ও তার লোকজনের ভয়ে আমরা এখন জিম্মি হয়ে আছি। বাড়ি থেকে বের হতে পারছি না। কখন যে কী হয়ে যায়, সেই ভয়েই থাকি। ছেলে মেয়েদের আর স্কুল কলেজে পাঠাতে পারব কি-না, তাও জানি না। কারণ নয়ন অনেক বড়-ভয়ানক সন্ত্রাসী। তার লোকজন এখনো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
তবে মিন্নি ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সতর্ক রয়েছে জেলা পুলিশ। মিন্নিদের বাড়ির সামনে পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শকের নেতৃত্বে পাঁচজন পুলিশ সদস্য পাহারা দিচ্ছে।
পাহারারত পুলিশের উপ-পরিদর্শদ মো. ইদ্রিস বলেন, মিন্নি ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আমরা পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত মিন্নিদের বাড়ির সামনে পাহারায় থাকব।
স্ত্রীর জন্য পালানোর চেষ্টা করেননি রিফাত
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া রিফাত হত্যাকান্ডের ভিডিও দেখে আমাদের অনেকের মনে, ‘রিফাত দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারত, কোপ খাওয়ার পরও পালাল না কেন? –এমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
যখন একের পর এক কোপ রিফাতের ঘাড়ে, পায়ে, পিঠে ও বুকে পড়ছিল, তখন দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া সুযোগও ছিল- এরপরও পালাল না কেন? ঘটনার তিনদিন পর গতকাল শনিবার কে এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নিহত শাহ নেয়াজ রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি।
মিন্নির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদ্যবিবাহিত বউকে ছেড়ে চলে যেতে চায়নি রিফাত। এজন্য উপর্যুপরি রামদার কোপ সহ্য করতে না পেরে, দু’পা পিছিয়ে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ত রিফাত। তিনি বলেন, রিফাত চাইলে দৌঁড়ে পালিয়ে বাঁচতে পারত। শুধু আমি ওখানে ছিলাম বলে আমার কথা চিন্তা করে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমার গায়ে যেন কোপ না পড়ে, আমার যেন ক্ষতি না হয়। আমাকে বাচাঁতে রিফাত পালিয়ে যায়নি।
নির্মম সেই দিনের কথা স্মরণ করে মিন্নি বলেন, ঘটনার দিন সকালে আমাকে বাসা থেকে নিয়ে যায় রিফাত। তারপর আমরা বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। এক পর্যায়ে রিফাত আমাকে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যেতে চায়। আমি খেতে যেতে রাজি হচ্ছিলাম না। ঠিক ওই সময় চারদিক থেকে ৪/৫ জন ছেলে এসে রিফাতের সঙ্গে তর্ক শুরু করে দেয়। তখনও তাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। তর্কের এক পর্যায়ে রিফাতকে কিল ঘুষি দিতে থাকে। পরে নয়ন ও রিফাত ফরাজী রামদা নিয়ে এসে রিফাতকে কোপাতে শুরু করে। তখন রিফাত ওদের বারবার অনুরোধ করছিল, 'ছেড়ে দে, আর মারিস না' বলতে বলতে এক পা দু’পা করে পিছিয়ে যাচ্ছিল। আমি ওদের আটকানোর চেষ্টা করছিলাম আর চিৎকার করে মানুষকে ডাকছিলাম। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।
মিন্নি বলেন, রিফাত রামদার কোপ সহ্য করতে না পেরে একপা দু’পা করে পিছিয়ে যাচ্ছিল। তখনও তার পালিয়ে বাঁচার সুযোগ ছিল। পালাতে পারলে, সে বেঁচে যেত। সে আমার জন্যই পালাতে চায়নি। ওই জায়গায় আমার যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। তখন কি হবে!
রিফাতের কবরে আমাকে মাটি পর্যন্ত দিতে দেয়নি ওর বন্ধুরা -মিন্নি
সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করছে অন্যদিকে স্ত্রী সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বরগুনার রিফাত শরীফের হত্যাকান্ড নিয়ে ছড়িয়ে পরা এমন ভিডিওটি তীব্র আলোচনার জন্ম দেয় সারাদেশে।
প্রথম দিকে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির এই সাহসী প্রচেষ্টাকে সবাই প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখলেও কয়েক ঘণ্টা পরই উল্টো সমালোচনাও শুরু হয় স্বামী হারানো শোকে বিপর্যস্ত মিন্নিকে ঘিরে। এমনকি নিহত রিফাতের বন্ধুদের কেউ কেউ মিন্নিকে নিয়ে সমালোচনা শুরু করে। যার ফলে স্বামীর কবরে মাটি দিতে না পারার আক্ষেপ জানিয়েছেন মিন্নি।
স্ত্রী মিন্নিকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদের জের ধরে খুন হন স্বামী রিফাত শরীফ। ঘাতক নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও তাদের গ্যাং এর আক্রমণ থেকে স্বামীকে বাঁচাতে লড়েছিলেন মিন্নি। তার এই সাহসী কর্মকান্ডের প্রশংসা হলেও কেউ কেউ তাকে ‘ভিলেন’ বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বার্তা দেয়। নিহত রিফাতের বন্ধুরাও ক্ষিপ্ত হয়ে মিন্নির উপর আক্রমণের চেষ্টা চালায়।
গণমাধ্যমকে মিন্নি বলেন, ‘ঘটনার পর রক্তাক্ত অবস্থায় রিফাতকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করি। এরপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে দেখি রিফাত এখানে নেই। তাকে বরিশাল হাসপাতালে (শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। রিফাত মারা যাওয়ার পর বিকেলে লাশ দেখতে শ্বশুর বাড়ি গেলে রিফাতের বন্ধুরা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে।
মিন্নি বলেন, আমি শ্বশুর বাড়ি যাই তখন রিফাতের বন্ধুরা গালাগাল করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমার দিকে তেড়ে আসে। একপর্যায়ে আমি আমার চাচাশ্বশুরের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেই। আমার অগোচরেই রিফাতের দাফন সম্পন্ন হয়। আমি শেষ দেখাটাও দেখতে পারিনি। এমনকি আমাকে ওর কবরে মাটি পর্যন্ত দিতে দেয়নি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার চাই: রিফাতের বাবা
একমাত্র সন্তান রিফাতকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় তার বাবা-মা। বাড়িতে চলছে শোকের মাতম, বুকফাটা আর্তনাদ। রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল প্রেসক্লাবে এসে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেহত্যার বিচার চাইলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা প্রেসক্লাবের সামনে রিফাত হত্যার মূল আসামিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধন করা হয়। সেখানে এ দাবি জানান তিনি।এ মানববন্ধনে অংশ নেয় জেলা ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ সর্বস্তরের পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ।
মানববন্ধনে বক্তব্য দেওয়ার সময় একপর্যায়ে সবার সামনে কাঁদতে কাঁদতে রিফাতের বাবা বলেন, রিফাত আমার একমাত্র সন্তান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন, আমার ছেলে হত্যাকান্ড অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক।
এ ছাড়া মানববন্ধনের মাধ্যমে হত্যাকান্ডের মূল হোতা সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী ও রাব্বীসহ সব হত্যাকারীকে অবলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান বক্তারা।
এতে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জেলা যুবলীগের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজ, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সহাবুদ্দিন সাবু, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রইসুল আলম রিপন, জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুনাম দেবনাথ, জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন শিপন জোমাদ্দার প্রমুখ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ