শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

পঞ্চদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক নিদর্শন ‘ছুটি খাঁ মসজিদ’

পঞ্চদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক নিদর্শন ‘ছুটি খাঁ মসজিদ’ -সংগ্রাম

বহু যুগের ইতিহাসকে নিজের বুকে ধারণ করে রেখেছে আমাদের এই জন্মভূমি। বাংলার এখানে সেখানে ছড়িয়ে থেকে আজও সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো আমলের নিদর্শনগুলো। শেকড় সন্ধানীদের নিরাশ করে না এই স্মৃতিচিহ্নগুলো। পরম আন্তরিকতায় হাত বাড়িয়ে টেনে নিয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়। এই অঞ্চলের ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন বাংলা বিভক্ত ছিল বিভিন্ন অংশে। এক এক অংশ ছিল এক এক রাজার পরাক্রম। সমগ্র অঞ্চলকে বিভক্ত ছিল পাঁচটি প্রাচীন জনপদে। পুন্ড্র, গৌড়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল। এর মধ্যে হরিকেল জনপদের একটি অংশ হচ্ছে আজকের বৃহত্তর চট্টগ্রাম।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে বহিরাগত আরবীয়, তুর্কি, ইরাকি, ইরানি, আফগানরা ক্ষমতা দখল করে শাসন প্রতিষ্ঠা করে। শুরু হয় খলিফা, শাহ বা সুলতানদের শাসন; এক কথায় মুসলিম শাসন। তলোয়ারের মাধ্যমে রাজতান্ত্রিক ইসলাম বিজয়ী হলেও, এই অঞ্চলে মানবতাবাদী ইসলামের সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটে মূলত পীর-আউলিয়াদের মাধ্যমে। তারাই এখানে এসে শুনিয়েছিলেন মানবপ্রেমের বাণী। কথিত আছে, বার জন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আউলিয়ার সম্মেলন হয় এই চট্টগ্রামের মাটিতে। তারা একসময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের (আরাকান সড়ক/ গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড) একটি জায়গায় মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন কে কোন জায়গায় ধর্ম প্রচারের জন্য যাবেন। আর তাই এই স্থানটির নাম হয়ে যায় ‘বারো আউলিয়া’। বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার আশেপাশের এলাকায় অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে এরকম আরো অনেক স্থান। মীরসরাই উপজেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। উপজেলা শহরটির কেন্দ্রস্থলে রয়েছে মীর সাহেবের মাজার। কথিত আছে, তার একটি আপ্যায়নশালা বা সরাইখানা ছিল। ‘মীরের সরাইখানা’ থেকে ‘মীরসরাই’ বা ‘মিরসরাই’ নামের উৎপত্তি। মীরসরাই উপজেলার একটি বাজার হলো জোরারগঞ্জ। এই বাজারের উত্তর দিকে অবস্থিত ঐতিহাসিক একটি মসজিদ। শাহী আমল তথা ইরানি মুসলিম শাসনামলের নিদর্শনসমূহের অন্যতম নিদর্শন এই মসজিদ। নাম- ছুটি খাঁ মসজিদ। পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিম পাশে জোরারগঞ্জ বাজারের দুইশ গজ উত্তরে ছুটি খাঁ দীঘি পাড়ে এর অবস্থান।  যতদূর জানা যায়, গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের আমলে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন লস্কর পরাগল খাঁ তারপরে শাসনকর্তা হন তাঁর পুত্র ছুটি খাঁ। পরাগল খাঁর পিতা রুকনুদ্দীন বারবাক শাহের আমলে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন। পরাগল খাঁ আর ছুটি খাঁর শাসনামলে চট্টগ্রামের শাসনকেন্দ্র ছিল পরাগলপুর। নাম শুনেই বোঝা যায় শাসনকর্তার নামানুসারেই পরাগলপুরের নামকরণ করা হয়েছে। প্রাচীন রাজারা প্রজাদরদী ছিলেন। নিজেদের সুনাম ও প্রভাব অক্ষুণœ রাখতে তারা বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করতেন। এলাকার পানীয় জলের অভাব মেটাতে তারা বিশালাকার দীঘি খনন করতেন। মুসলিমদের জন্য সুদৃশ্য মসজিদ আর হিন্দুদের জন্য নয়নাভিরাম মন্দির নির্মাণ করতেন তারা। ছুটি খাঁ-ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর শাসনামলে জোরারগঞ্জ সহ আশেপাশের বেশ কিছু অঞ্চলে দীঘি খনন ও মসজিদ নির্মাণ করা হয়। জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দেওয়ানপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ছুটি খাঁ মসজিদটি তারই সুশাসনের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। মসজিদের পার্শ্ববর্তী দীঘিটি নিয়েও রয়েছে মজার ইতিহাস। এটা আবার অনেক এলাকায় প্রচলিত জনশ্রুতির মতোই। ধারণা করা হতো, একদল জ্বীন এই দীঘির নিচে বাস করতো। তারা ছিল অগাধ সম্পদের মালিক। এদেরকে অনেক এলাকাতে বলে যক্ষ। শোনা যায়, মসজিদের পাশের এই দীঘিতে এলাকার কোনো অনুষ্ঠানের যেমন- বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠানাদি এলে দীঘির পাড়ে মাটি দিয়ে লেপে প্রয়োজনীয় থালা বাসনের সংখ্যা লিখে প্রার্থনা করলে পরের দিন সকালে তা নৌকাসহ ভাসতে দেখা যেত। প্রয়োজন শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার নৌকাতে রেখে দিলে তা ডুবে যেত। কিন্তু কেউ যদি একটা থালা বাসন কম দিত তাহলে নৌকা ডুবতো না পাশাপাশি তার ক্ষতি হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরু দিকে যেসকল মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয় তাঁর অন্যতম একটি নিদর্শন ছুটি খাঁ মসজিদ। মূল মসজিদটি অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে।
পরবর্তীতে নতুনভাবে মসজিদ ভবনটি নির্মাণ করা হয়। মূল মসজিদের বেশ কিছু ছোট বড় পাথর শিলালিপি সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। প্রতœতাত্তিক বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ঐতিহাসিক নিদর্শন সমূহের কিছু সংরক্ষণ করেছে। মূল মসজিদ তৈরিতে ব্যবহৃত পাথরগুলো ভারতের রাজস্থান ও অন্যান্য রাজ্য থেকে আনা হয়েছে বলে জানা য়ায়। কালো রঙের নানা ডিজাইন ও আকৃতির কিছু পাথর এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মসজিদের আঙিনায়। মসজিদের ভেতরে একাধিক শিলালিপির একটিতে সুন্দর লিখনচিত্র (ক্যালিওগ্রাফি) পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে আয়াতুল কুরশী লিখিত আছে। চট্টগামের ইতিহাস নিয়ে লিখিত বিভিন্ন বইয়ে ছুটি খাঁ মসজিদের কথা উল্লেখ রয়েছে। এসব বইয়ে লেখা আছে ছুটি খাঁ মসজিদ খোদিত পাথরের ব্লক দিয়ে নির্মিত ছিল। পাথরের সবগুলোতেই ছিল তোগরা হরফে আল-কোরআনের নানা আয়াত ও আরবী দোয়া।
তবে মসজিদটির নির্মাতা পরাগল খাঁ, না ছুটি খাঁ এ বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ১৫১৫ খ্রীঃ এর পরবর্তী সময়ে এ মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ আছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে কখনো ঐতিহাসিক মসজিদটির নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে প্রাচীন নিদর্শনগুলোর অনেকগুলো এখনো অযতেœ পড়ে আছে।
ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন নিদর্শনগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হলে ভবিষ্যত প্রজন্ম মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস এবং একই সাথে তৎকালীন সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবে।
যদিওবা এ মসজিদটি পঞ্চদশ শতাব্দীর নিদর্শন হিসেবে টিকে আছে। সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দেয় তৎকালিন সময়ের ত্রিপুরা ও আরাকানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক ছুটি খাঁ’র স্মৃতিকথা-ও। এ স্মৃতি রক্ষা কি প্রতœতত্ত্ব বিভাগ বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কারো দায়িত্বে মধ্যে পড়ে না ?
ঐতিহাসিক ছুটিখাঁ মসজিদের খতিব নূরুল আলম তৌহিদী জানান, প্রতি শুক্রবার শত শত মুসল্লির সমাগম ঘটে এ মসজিদে । আশে পাশের এলাকা ছাড়াও দূর দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা ছুটে আসেন ঐতিহাসিক এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে। এছাড়া ঈদ-উল ফিতর ও ঈদ-উল আযহার সময় এখানে বিশাল ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
ইচ্ছে হলেই গিয়ে দেখতে আসতে পারেন যে কোনো এক ছুটির দিনে। চট্টগ্রাম শহর থেকে যেতে সর্বোচ্চ সময় লাগবে ২ ঘন্টা। সকালে রওনা দিয়ে বিকেলেই ফিরে আসতে পারবেন। আবার হয়তো দুপুরবেলার নামাজটিও সেখানেই আদায় করে নিতে পারবেন।
চট্টগ্রাম শহরের মাদারবাড়ি শুভপুর বাসষ্ট্যান্ড থেকে চয়েস বা উত্তরা বাসে করে জোরারগঞ্জ বাজাারেই নামতে পারবেন। ভাড়া নেবে সর্বোচ্চ ৮০টাকা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে বারইয়ারহাট নেমে সিএনজি যোগে জোরারগঞ্জ আসলে দেখা মিলবে সড়কের পাশে দন্ডায়মান ঐতিহাসিক ছুটি খাঁ মসজিদটির।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ