শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মিরপুরের চলন্তিকা বস্তি পুড়ে ‘নিশ্চল’ জীবনযাত্রা ছাইভস্মে চাপা সব স্বপ্ন

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : মিরপুরের ‘চলন্তিকা বস্তি’ রাজধানীর বস্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেই বস্তি পুড়েছে আগুনে। আগুন কেড়ে নিয়েছে বস্তির সবই। যত ধরনের অবকাঠামো আর বসবাসের যত আয়োজন ছিল-তার বিন্দুমাত্রও নেই আগুনে পোড়ার পর। আগুনে ওই সব পোড়ার সাথে সাথে পুড়েছে স্বপ্নও। পোড়া বস্তির জীবনযাত্রা এখন একেবারেই ‘নিশ্চল’। বস্তিবাসীর যে স্বপ্ন ছিল তা এখন চাপা ‘ছাই ভস্মে’।
এখন মিরপুর ৭ নম্বরের বস্তিতে পোড়া ধ্বংসস্তুপ হাতড়ে বেড়াচ্ছে সব-হারানো মানুষ। সেখানেই খুঁজে ফিরছে কিছু অবশিষ্ট আছে কি না। বেশির ভাগ ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেনি বাসিন্দারা। হাজারো ঘর পুড়ে গেছে। ওপরে শুধু টিন দেখা যাচ্ছে। ঈদের কারণে বস্তিতে থাকা বেশির ভাগ বাসিন্দা গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। আগুনের খবর পেয়ে অনেকে ফিরে এসেছে ঢাকায়। পোড়া বস্তিতে ঘর খুঁজছে তারা।
আগুন লাগার প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় চারজন আহত হয়েছে। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ক‘টা দিন আগেও যেখানে জনারণ্য ছিল, ঠিক সেখানটার চিত্র এমন-বাতাসে পোড়া গন্ধ, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কিছু মানুষ হাতড়ে ফিরছে কিছু; আসলে আগুনে সব গিলে খাওয়ার পর চলছিল ‘উচ্ছিষ্ট’ খোঁজা। আধাপোড়া কিছু পাওয়া গেলে সেসব বিক্রি করে অন্তত দুই-একদিনের খোরাক তো হতে পারে। শুক্রবার রাতে পুড়ে যাওয়া মিরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে গতকাল শনিবার আরেক দল মানুষেরও দেখা মিলল, যাদের ছাইভস্মে চাপা পড়া স্বপ্নের ‘অবশিষ্টাংশ’ খোঁজারও যেন শক্তি নেই। আগুনে সব হারিয়ে নিঃস্ব তারা। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে মিরপুর-৭ নম্বরে রূপনগর থানার পেছনে চলন্তিকা বস্তিতে লাগা আগুন রাত সাড়ে ১০টার দিকে যখন নিয়ন্ত্রণে আসে, ততক্ষণে বস্তির প্রায় সব ঘরই পুড়ে ছাই। 
চলন্তিকা মোড় থেকে রূপনগর আবাসিক এলাকা পর্যন্ত ঝিলের ওপর কাঠের পাটাতন দিয়ে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে গড়ে তোলা বস্তিতে কয়েক হাজার পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বসবাস করতেন বলে এলাকাবাসীর ধারণা।
গতকাল শনিবার চলন্তিকা বস্তিতে দেখা হয় মর্জিনার সঙ্গে। আগামী ১ সেপ্টেম্বর তার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। বাবা-মা মেয়ের বিয়ের জন্য ৫০ হাজার টাকা ছাড়াও খাট, আলমারী, শোকেসসহ বিয়ের বিভিন্ন আসবাবপত্র ঘরে এনে রেখেছিলেন। শুক্রবারের আগুন মর্জিনাদের সবই কেড়ে নিয়েছে।
মর্জিনার চিরকশাচালক বাবা মহসিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “প্রথম মেয়ের বিয়ে দিতে অসুস্থ শরীর নিয়া দিনরাত খাইটা এইসব জোগাড় করছিলাম। এখন আমার মেয়ের কি হবে?”
মহসিন জানান, আগুন লাগার সময়ও তিনি রিকশা চালাচ্ছিলেন। খবর পেয়ে বস্তিতে এসে দেখেন সব শেষ। “আমি টাকা বাইর কইরা আনতে চাইছিলাম, কিন্তু কাছেই যাইতে পারি নাই।”
আগুনে সর্বস্ব হারিয়েছেন গার্মেন্টকর্মী মরিয়ম বেগমও। কয়েক মাস আগে ছয় লাখ টাকা খরচ করে গড়ে তোলা তার স্বামীর ডেকোরেশনের দোকানটিও ছাই হয়েছে। নিঃস্ব মরিয়ম এখন দুই মেয়ের পড়ালেখা কীভাবে চলবে, সেই চিন্তাতেই অস্থির। “ওই ব্যবসা (ডেকোরেশনের) শুরু করতে গিয়া অনেক ধারদেনা হইছে। এখন ওই চিন্তাই সবচেয়ে বড়,” বলেন মরিয়ম।
আগুন লাগার খবর শুনে কাছাকাছি জেলার অনেকে গতকাল ভোর থেকে এলাকায় এসেছে।
নরসিংদীর মনোহরদী থেকে এসেছেন সুমাইয়া (২৫)। বলেন, ঈদের ছুটিতে স্বামী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। তিনি গৃহকর্মীর কাজ করেন। তাঁর স্বামী একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। বস্তির সাত নম্বর রোডের নয় নম্বর গলিতে তাঁর ঘর ছিল। আগুন লাগার খবর রাতে শুনেই স্বামীকে নিয়ে ভোরে এসে পৌঁছেছেন। পৌঁছেই ঘরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যাবেন কোথায়? কোথাও ঘর বলে কিছু নেই। সব সমান হয়ে গেছে। তিনি ঈদের আগে কাপড়চোপড়সহ যেসব জিনিস সঙ্গে নিয়ে গেছেন, তা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন কোথায় থাকবেন, তা জানেন না। তাঁদের স্কুলে থাকতে দেয়া হবে বলে শুনেছেন। কিন্তু এখনো কেউ কোথাও যায়নি। এখনো সবাই বস্তির আশপাশেই আহাজারি করছে।
বস্তির বাসিন্দা শামীম হাসান বলেন, ‘আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। সকাল থেকে ঘর খোঁজার চেষ্টা করেছি। ঈদে বউ আর বাচ্চা জামালপুরে বাড়ি গেছে। আগুন লাগার কথা শুনে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছি। কিছু সঙ্গে আনতে পারিনি।’
বস্তির পাশেই দুই নম্বর রোডের বাসিন্দা দিলদার আহমেদ বলেন, আগুন দেখে তাঁরা ভয় পেয়েছিলেন। আগুন দ্রæত ছড়িয়ে পড়ছিল। বস্তির পাশাপাশি মসজিদসহ আশপাশের চারটি বাড়িতে ওই আগুন ছড়াতে দেখেন তিনি। সরেজমিনে দেখা যায়, বস্তির পাশে একটি বাড়ি ও মসজিদ আগুনে বেশি পুড়ে গেছে।
স্থানীয় অনেক লোক বলছেন, মিরপুর ৭ নম্বরের বস্তিটি অবৈধ। এখানে বেশির ভাগ বাড়ি টিন ও কাঠের। একেকটি বাড়ি টিন দিয়েই তিন-চারতলা করা হয়েছে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তৈরি করা এসব ঘরের কারণে আগুন দ্রæত ছড়িয়েছে। বস্তির আশপাশের বাড়িগুলোতেও আগুন নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়।
স্থানীয় বাসিন্দা খায়রুল বাশার বলেন, বস্তির পাশেই তাঁদের বাসা। তাঁরা আগুন ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে ছিলেন। দ্রæত বাড়ি ছেড়ে সবাই বাইরে চলে আসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আগুন নেভানো সম্ভব হওয়ায় তাঁরা রক্ষা পেয়েছেন।
ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিট কাজ করেছে। র‌্যাব, পুলিশ, ওয়াসা ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মী জাহিদ হোসেন বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে। পরে তদন্ত করে বিস্তারিত বলা যাবে।
আগুনের খবর পেয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস মোল্যা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সহায়তা আশ্বাস দেন।
সাংসদ ইলিয়াস মোল্যা বলেন, ৫০ থেকে ৬০ হাজার লোক বস্তিতে থাকত। সবাই ঈদে বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু ফিরে এসে কেউ কিছু পায়নি। এখানে যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে।
পুলিশ সূত্র বলছে, এ ঘটনায় চারজন আহত হয়েছে। তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কেউ নিখোঁজ নেই।
গতকাল দুপুরে মিরপুরের আরামবাগের ছয় নম্বর রোডের শেষ মাথায় বস্তির কাছে শত শত নারী পুরুষ রাস্তায়, বা খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতে দেখা গেছে। দুপুর সাড়ে ১১টার দিকে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজ্জব হোসেন বস্তিবাসীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন। অগ্নিকান্ডে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর রজ্জব বলেন, “এখনও ক্ষয়ক্ষতির হিসাব চূড়ান্ত করতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করছি সরকারের পক্ষ থেকে কী সহযোগিতা তাদের করা যায়।”
বস্তিবাসীদের জন্য সহায়তা
চলন্তিকা বস্তির পাশে বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনে শুক্রবার রাতে খোলা হয়েছে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র। আগুনে সর্বস্ব হারানোদের অনেকে সেখানে ঠাঁই নিয়েছেন।
তাদের একজন রোকেয়া বেগম বলেন, “আমাদের যাদের যাওনের কোনো জায়গা নাই, এইখানে ঠাঁই পাইসি। রাইতে এইখানে জায়গা না পাইলে রাস্তায় থাকতে হইত।”
বস্তিতে আগুন লাগার পরপরই ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ১০ হাজার লিটার ধারণক্ষম ১০টি পানির ট্যাংকে এক লাখ লিটার পানি সরবরাহ করে। পাশাপাশি একটি টাওয়ার লাইট এবং মেডিকেল টিম নিয়োজিত হয়।
গতকাল শনিবার সকাল থেকে সেখানে অস্থায়ী বাসস্থান, খাবার ও ভ্রাম্যমাণ শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়।
মেয়র আতিকুল ইসলাম বেলা ২টার দিকে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ডিএনসিসির বিভিন্ন ধরনের সেবা পরিদর্শন করেন। এছাড়া ডিএনসিসির স্বাস্থ্য ক্যাম্পে গিয়ে ডাক্তার, নার্স ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন।
অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ডিএনসিসি আরামবাগ মাঠে প্যান্ডেল করে রান্না ও খাবারের বন্দোবস্ত করেছে। মেয়র সে এলাকাও পরিদর্শন করেন। পরে তিনি বলেন, যদি ফায়ার হাইড্রেন্ট বসিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে বস্তিবাসীরাই আগুন নিভিয়ে ফেলতে পারত। “যদি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা লাগে, তা সিটি করপোরেশন অবশ্যই করবে। ক্ষতিগ্রস্তদের খাবার আমরা তিন বেলাই চালিয়ে যাব। কাজ করব কালেকটিভ ওয়েতে।”
তদন্ত কমিটি গঠন
অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, “আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন দেবে। “আজ পুরো বস্তিকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে হাউজ টু হাউজ তল্লাশি করা হয়েছে। আমরা কোনো মৃতদেহ পাইনি।”
নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি ফখরুলের
গতকাল শনিবার দুপুর ১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে তিনি বলেন, “অতীতেও মিরপুরে এমন ঘটনা ঘটেছে। এ অগ্নিকান্ডের পেছনে কোনো ব্যক্তি জড়িত কিনা, তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দেখতে হবে।” ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা করতে সরকারের প্রতি আহŸান জানান তিনি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ