মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : একটি জীবন কেবল একজন মানুষের একক জীবন তা কিন্তু নয়! এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরো অনেক  মানুষের জীবন। একটি জীবন বিচ্ছিন্ন হলে তখন অন্য জীবনেও বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসে। তবে চিরসত্য মৃত্যুকে যেমন অস্বীকার করা যায় না তেমনি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রিয়জন হারানোর বেদনার কথাও ভুলা যায় না। প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতা, এমনকি মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়েনি। গত বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে কঠোর আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি। ঈদ এলেই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সড়ক-দুর্ঘটনা একটি জাতীয় সমস্যা হলেও কোন সরকারই সড়কের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে সড়কে বের হওয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফিরে যাওয়ার গ্যারান্টি শূন্যের কোঠায়। ক্ষমতাসীন দল যখন ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে নিপীড়নের পথে হাটে তখন মজলুম মানুষের কান্নার আওয়াজ যেমন তারা শুনতে পায় না তেমনি দুর্ঘটনায় নিহত কিংবা আহত মানুষের স্বজনের আহাজারিও তারা শুনতে পায় না। শাসকেরা প্রায়ই বলেন সবকিছু ঠিক ঠাক আছে। অথচ প্রতিনিয়ত বাসচাপায় কত নারী,পুরুষ ও শিশুকে যে জীবন দিতে হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। এ নিয়ে কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান,স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিংবা যাত্রী কল্যাণ সমিতি কথা বললেই মন্ত্রীরা চড়ে গিয়ে বলেন সব অপপ্রচার। সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সরকার ভুল করলেও সমালোচনা করা যাবে না। কারণ শাসকেরা সত্য কথাটুকু সহ্য করতে পারছে না। আমাদের দেশে তো কোন যুদ্ধ নেই, তাহলে কেন যুদ্ধ ক্ষেত্রের চেয়ে বেশি মানুষ প্রতিদিন সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে এই বিষয়টি উদঘাটন করা প্রয়োজন। কিন্তু উদঘাটন করবে কে? বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সমস্যাটি নতুন নয়। এ নিয়ে হরতাল, অবরোধ, মিছিল, সমাবেশ মানববন্ধন অনেক কিছুই হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়কে ঝরছে মানুষের প্রাণ। তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে যাচ্ছে এক একটি পরিবারের স্বপ্ন। তবু থামছে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল। গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম ও দিয়া খান নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিবেকের তাড়নায় সহপাঠীর হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাইতে রাজপথে নেমেছিল কিন্তু তাদের প্রতিবাদ সুকৌশলে থামিয়ে দেয়া হল। তারা যে ভাবে যানবাহনের লাইসেন্স,ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখে জনগণকে সচেতন করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ওদের প্রতিবাদী স্লোগানে ছিল না কোন উত্তাপ, ছিল শুধু অশ্রুঝরা কান্নার আওয়াজ। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিল সারাদেশ। সহপাঠীর মৃত্যু যুন্ত্রণায় ছটফট করা শোকাহত শিক্ষার্থীদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল- নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ,ঘাতক বাসচালকের ফাঁসি, আমরা ৯ টাকায় এক জিবি চাই না,নিরাপদ সড়ক চাই,টনক কবে নড়বে তোমাদের,আর কত মায়ের বুক খালি হলে তোমরা শান্ত হবে,আমরা সবাই মরতে রাজি,তবুও বিনা বিচারের সংস্কৃতি মানতে রাজি নই, সন্তান হত্যার বিচার চাই,লাশের গন্ধ বাতাসে,কে সে নরপিশাচ আজো হাসে। ঘুড়ে বেড়ায় অপরাধী মার খায় প্রতিবাদী। এদেশের মন্ত্রী আমলারা যা পারেনি তারা তা করে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছিল বটে। কিন্তু পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। আমাদের দেশে যতগুলো সমস্যা পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও সড়ক ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনিক দুর্নীতি,অনিয়ম আর চাঁদাবাজি দূর করা সম্ভব হয়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও তা আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম। বাইরের দেশে লাইসেন্স অর্জন করা যত কঠিন,লাইসেন্স টিকাইয়া রাখা তার চেয়ে বেশি কঠিন। অথচ এই সরকারের এক মন্ত্রী বলেছিলেন গরু ছাগল বেড়া চিনতে পারলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যায় তখন আর কিছুই করার থাকে না। সড়ক দুর্ঘটনাকে এখন আর দুর্ঘটনা বলা যায় না। কারণ দুর্ঘটনার নামে নীরব হত্যাকান্ডের মহোউৎসব চলছে। একশ্রেণীর চালকদের বেপরোয়া মনোভাব,অদক্ষতা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন,সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা, আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর দায়িত্বে অবহেলা, ফুটপাত দখল, ওভারটেকিং, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তার মোড়, গাড়ির ক্রুটি, যাত্রীদের অসতর্কতা, মোবাইল ফোনে কথা বলা, নেশাগ্রস্থ অবস্থায় গাড়ি চালানো, বিআরটিএর অকার্যকর পদক্ষেপের দরুণ সড়কে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না। এবারের ঈদের ছুটির আগে-পরে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির চিত্র দেখলেই বোঝা যায়,সড়ক দুর্ঘটনার নামে একশ্রেণীর চালক যাত্রীদের হত্যা করার মিশনে নেমেছে। সড়ক দুর্ঘটনা যেভাবে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে,তাতে এটাই প্রতীয়মাণ যে,সড়ক পরিবহন ও শৃঙ্খলার সাথে জড়িত সংস্থা ও মন্ত্রণালয় পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যলয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ থেকে গত ঈদুল ফিতর পর্যন্ত সাতটি ঈদযাত্রায় দেশের সড়কে এক হাজার ৬১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতি ঈদে গড়ে ২৩০ জনের প্রাণ গেছে। সরকারি হিসাব অনুসারে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ৮ জন মানুষ মারা যায়। আর বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ৩০ জন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ৪৮ জন। গত ৬ আগস্ট থেকে ঈদ শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরা ১৮ আগষ্ট পর্যন্ত গত ১৩ দিনে সড়ক,রেল ও নৌপথে ২৫০টি দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত ও ৮১৮ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। ঈদযাত্রায় ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়া ও বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরা পর্যবেক্ষণ করে সংগঠনটির তৈরি করা  প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের লাউঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়,সড়ক পথে ১৯৯ দুর্ঘটনায় ২৫৩ জন নিহত ও ৭৬৫ জন আহত,নৌপথে ২১ দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত, ৫১ নিখোঁজ ও ২৩ জন আহত হয়েছে। তবে রেলপথে কোন দুর্ঘটনা না হলেও ট্রেনে কাটা পড়ে পূর্বঞ্চলে ২১ জন পশ্চিমাঞ্চলে ৯ জনসহ মোট ৩০ জন নিহত হয়েছে। (সূত্র নয়াদিগন্ত ২০.০৮.১৯) ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন ২০১৯ প্রকাশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এতে দেখা গেছে সারাদেশে ২০৩টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২২৪ জন এবং আহতের সংখ্যা ৮৬৬ জন। অপরদিকে রেল ও নৌপথ মিলিয়ে মোট ২৪৪ টি দুর্ঘটনায় ২৫৩ জন নিহত ও ৯০৮ জন আহত হয়েছেন। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ সঠিক নিয়ম নীতি ও কর্মসূচির মাধ্যমে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমিয়ে এনেছে ওই সব দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। এই ব্যর্থতার দায়ভার সরকার এড়াতে পারে না। নিকট অতীতে দক্ষিণ কোরিয়ায় এক ফেরি ডুবিতে ৩০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল। এতে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। আমাদের দেশে এ ধরনের নজির কোনো কালেই স্থাপিত হয়নি ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। কারণ শাসকের জনগণের ভোটের প্রয়োজন পড়ে না। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরকিল্পনা সরকারের রয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না যা সত্যিই দুঃখজনক। আমরা মনে করি সড়ক দুর্ঘটনা কেন রোধ করা যাচ্ছে না তার সুস্পষ্ট কারণ নির্ণয় করার পাশাপাশি প্রতিরোধের জন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ বাস্তবায়ন করা জরুরী। সড়ক দুর্ঘটনার নামে হত্যাকান্ড বন্ধে সরকার কঠোর হবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ