শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

আন্দোলনেই খালেদা জিয়ার মুক্তি

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো-খালেদা জিয়াকে আনব’। কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে দলের শীর্ষ নেতারা প্রতিদিন এভাবেই হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছেন। নতুন করে সারাদেশে মানববন্ধনসহ বিভাগীয় শহরে সমাবেশের কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপির হাইকমান্ড যেভাবে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে তাতে বেগম জিয়ার মুক্তি কখনোই সম্ভব হবে না। বেগম জিয়ার মুক্তি আটকে আছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপরই। তারা বলছেন, যেখানে ৩৬ মামলার মধ্যে ৩৪টিতেই বেগম জিয়া জামিনে রয়েছেন সেখানে বাকি দুটিতে সমস্যা কোথায়? বিএনপির আইনজীবীরা জামিনের জন্য বারবার আবেদন করে কোনো ব্যবস্থা করতে পারছেন না। তারা বলছেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় কেবলই রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে।
জানতে চাইলে রাজপথে সোচ্চার বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সনকে মুক্ত করতে আন্দোলনের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিবকে বের করতে শ্লোগান দেয়া হতো- জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব। তেমনি বর্তমানে শ্লোগান দিতে হবে- জেলের তালা ভাঙব খালেদা জিয়াকে আনব। শামসুজ্জামান দুদু বলেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে রাজপথে আন্দোলন করতে হবে, শ্লোগান দিতে হবে। দুর্বার আন্দোলন ছাড়া তাকে মুক্ত করার কোনো পথ নেই। জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করতেই খালেদা জিয়াকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ছাত্রদলের সাবেক এই নেতা।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমানও মনে করেন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব। তিনি বলেন, আদালতের মাধ্যমে বেগম জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। এই আদালত সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটাবে। সেলিমা রহমান বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে খালেদা জিয়াকে বন্দ করে রাখা হয়েছে।
সূত্র মতে, দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছর দ-িত হয়ে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। দীর্ঘ ১৯ মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্দীজীবন কাটাচ্ছেন তিনবারের এ প্রধানমন্ত্রী। তিন দশকের বেশি সময়কার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এত দীর্ঘসময় কখনই তাকে কারাগারে থাকতে হয়নি। স্বাভাবিক জীবনযাপনের বাইরে এসে চার দেয়ালে আটক থাকায় এরই মধ্যে নানা অসুস্থতায় ভুগছেন তিনি। এ কারণে গত ১ এপ্রিল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৩৬। বিএনপির দাবি, এসব মামলার সবকটি রাজনৈতিক বিবেচনায় করা। যে দুটি মামলায় তার ১৭ বছর সাজা হয়েছে, সেটিও সরকারের হস্তক্ষেপে হয়েছে বলে দাবি দলটির। ৩৬ মামলার মধ্যে ৩৪টিতে খালেদা জিয়ার জামিন মিলেছে। আর মাত্র দুটি মামলায় জামিনের অপেক্ষায় আছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। তার আইনজীবীরা বলছেন, সরকার ‘হস্তক্ষেপ’ না করলে তিনি শিগগিরই জামিনে বেরিয়ে আসবেন। যে দুটি মামলায় খালেদা জিয়া জামিনের অপেক্ষায় আছেন তা হলো- জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা। এই দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার ১৭ বছরের সাজা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আশাবাদী তার আইনজীবী প্যানেলের সদস্য ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার আর মাত্র দুটি মামলায় জামিন বাকি আছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে এবং সরকার কোনো হস্তক্ষেপ না করলে, আগামী দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে খালেদা জিয়া জামিনে বের হয়ে আসতে পারবেন। খালেদা জিয়ার আগের মামলাগুলোতে সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল দাবি করে বিএনপির এ আইনজীবী বলেন, আইনগতভাবে এ দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন না পাওয়ার কোনো কারণ দেখছি না।
জানা গেছে, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপির চেয়ারপার্স ন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হবে চলতি সপ্তাহের যেকোনো দিন। বিচারপতি ফরিদ আহমেদ ও বিচারপতি এ এস এম আবদুল মোবিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে রোববার জামিন আবেদন করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। আবেদনটি আদালতের কার্যতালিকায় আসার পর তার ওপর শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খান। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে হাইকোর্ট আপিল করেন খালেদা জিয়া। এই আপিল শুনানির জন্য গ্রহণের পর জামিন চেয়ে ৩১ জুলাই বিফল হন খালেদা জিয়া। গত ৩ সেপ্টেম্বর ফের জামিনের আবেদন করেন তিনি। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আবেদনটি আদালতে দাখিল করেন। পরে বেগম জিয়ার আইনজীবি কায়সার কামাল বলেন, বিএনপির চেয়ারপার্সনের জামিন চেয়ে করা আবেদনটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেছেন হাইকোর্ট। এখন চলতি সপ্তাহের যেকোনো দিন এই জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হতে পারে।
বিএনপির একাধিক নেতা মনে করেন, আইনী লড়াইয়ে বেগম জিয়ার মুক্তি মিলবেনা। এবারো খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন খোদ আইনজীবীরাই। তারা মনে করেন, সরকার সরাসরি খালেদা জিয়ার জামিনে বাধা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ চায় না যে খালেদা জিয়া মুক্ত হোক। আর তাই আইনী লড়াইয়ের পাশাপাশি তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সামনে অগ্রসর হতে হবে। খালেদা জিয়ার মুক্তি সরকারের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। এজন্য সাংগঠনিকভাবে আগে শক্তিশালী হতে হবে বলে মনে করেন রাজনীতি বিজ্ঞরা।
জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া হিসেবে আদালতে জামিনের আবেদন এবং আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করছে দলটি। আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর দলটির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে সারা দেশের জেলা ও সাংগঠনিক জেলাগুলোর কমিটি দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয় অঙ্গ সংগঠনগুলোকেও চাঙা করতে নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এ সকল কার্যক্রম দেখে এখন বিএনপি সঠিক পথে হাঁটছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে এখনো তেমন লক্ষণীয় কিছু ঘটেনি। কিন্তু তার মুক্তির জন্য পদক্ষেপ আছে। এখন বিএনপি যে অবস্থায় আছে সেখান থেকে সংগঠিত হওয়া উচিৎ। সেটাই তারা করার চেষ্টা করছে। কারণ ছাত্রদল, বিএনপির জেলা কমিটিসহ অঙ্গ সংগঠনগুলো কমিটি দিচ্ছে। এভাবে এগুচ্ছে, এভাবেই এগুতে হবে। তারপরে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে। আইনি প্রক্রিয়া ও আন্দোলন দুটোই এক সঙ্গে করতে হবে। মুক্তি তো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া হবে না। সরকার সব কিছু এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে যে কিছু বলার নাই।
এদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় দ্বিতীয়বার হাইকোর্টে জামিন না চেয়ে আপিল করলে ভালো হতো বলে মনে করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি খালেদা জিয়ার মুক্তির আইনি বিষয়ে বলেন, এটা রাজনৈতিক মামলা, সরকার যদি না চায় তাহলে জামিন হবে না। চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিনের আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় তার মুক্তি হবে না। এখন হাইকোর্টে একবার জামিনের আবেদন খারিজ হয়েছে। আবার সেই কোর্টেই জামিনের আবেদন করা হলো। এখানে আবার খারিজ করে দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ একবার খারিজ হলে সাধারণত সে রায় পরিবর্তন হয়ই না। তবে দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়। তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে রাজ পথ উত্তপ্ত করতে হবে, তা না হলে সম্ভব না।
অপরদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আমরা আইনিভাবে বার বার চেষ্টা করছি। এখানে কী বলার আছে? সরকার তার জামিন ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় জামিন চাওয়া হয়েছে। এবারো যদি খারিজ করে দেয়া হয় তাহলে কী করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আপিল করব। আইনী যত প্রক্রিয়া আছে সেগুলো শেষ করব। তারপরও যদি খালেদা জিয়া মুক্তি না পান তাহলে কী আপনারা আন্দোলনের পথে যাবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরাতো আন্দোলনেই আছি।
বিএনপির এই নেতার সঙ্গে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করেন বুদ্ধিজীবী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা সবাই মনে করি খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়া উচিৎ। তার মুক্তিতে বিএনপিকে আরও দৃশ্যমান হওয়া উচিৎ। তাদের মিটিং, মিছিল করার অনুমতি দিচ্ছে না। কিন্তু সেটা করতে হবে। তাদের রাস্তায় নামতে হবে। তবে তারা কোনো আন্দোলনে নাই। বিএনপি আন্দোলনেই আছে’ খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এ কথার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ওইটা কথার কথা বলেছেন। তবে এই কথা বলে আত্মতুষ্টির কোনো জায়গা নাই। তারা আন্দোলন করতে চায়, কিন্তু করতে পারছে না। তাদের ২৫-২৬ হাজার নেতাকর্মী জেলে আছে। আরও ২৫-২৬ হাজার জেলে যাবে। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়াতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা খুব পরিস্কার ভাষায় সরকাররের কাছে বলতে চাই, অবিলম্বে আইনগতভাবে প্রাপ্য তা যে জামিন, সেই জামিন তাকে দেয়া হোকে এবং মুক্ত করা হোক। অন্যথায় যেকোনো পরিস্থিতির দায় সরকারকেই নিতে হবে। খালেদা জিয়ার বর্তমান অবস্থার বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশনেত্রী প্রচন্ড অসুস্থ, প্রতিদিনই তার স্বাস্থ্যের অবণতি ঘটছে। যেকারণে আমরা বার বার করে বলছিলাম, দেশনেত্রীর যে জামিন প্রাপ্য, সেই জামিন তার পাওয়া উচিত। অনেকেই এই মামলাগুলোতে জামিনে মুক্ত আছেন। তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে না উদ্দেশ্যমূলকভাবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, এখানে তো আইনের চাইতে রাজনৈতিক বিষয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তো চেষ্টা করেছি এবং এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি আন্তরিকভাবেই যাতে করে আমরা তার জামিন পেতে পারি। কিন্তু পদে পদে বাঁধা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং তার স্বাস্থ্যগত কারণে আমরা আবার চেষ্টা করবো জামিনের জন্য। সাবেক এ আইনমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর সব সরকারের একটা মানবিক দিক থাকে। এই সরকারের কোনো মানবিক দিক নাই। মানবতা বোধ বলে যে একটা বিষয় আছে, তা এই সরকারের মধ্যে আমরা দেখতে পাই না। যার কারণে বেগম খালেদা জিয়ার এই করুণ অবস্থা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ