বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিলে আরও বেকায়দায় পড়বে পুঁজিবাজার

 

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : ক্রান্তিকাল যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারের। অব্যাহত দরপতনে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা। এ সময়ে বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসিত, আধা-স্বায়ত্বশাসিত ও করপোরেশনের উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা নেওয়া হলে ব্যাংকের পাশাপাশি পুঁজিবাজার আরও বেশি বেকায়দায় পড়বে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের মতে, হঠাৎ করে এসব প্রতিষ্ঠানের রিজার্ভে থাকা অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নেওয়া হলে ওইসব প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির আইন না মেনে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সরকারি কোম্পানির রিজার্ভের টাকা নেওয়া হলে পুঁজিবাজার বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন এই বাজারের প্রতি কারো আস্থা থাকবে না। দেশী বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তারা বাজার বিমুখ হয়ে পড়বে।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারে সূচকের ব্যাপক দরপতন হচ্ছে। গত বুধবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচক ৭৫ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৯৩৩ পয়েন্টে নেমে আসে। এটি আগের তিন বছরের মধ্যে সূচকের সর্বনি¤œ অবস্থান। এর আগে ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর ডিএসইর প্রধান সূচক নেমেছিল ৪ হাজার ৯২৪ পয়েন্টে। ওইদিনের পর বুধবার সূচক সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে আসে।  পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতনের পেছনে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন ডিএসইর সাবেক সভাপতি মো: শাকিল রিজভী। তিনি বলেন, দেশের আর্থিক সেক্টরের সার্বিক প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে একটি লিজিং কোম্পানি অবসায়নের কারণে এই খাতে ব্যাপক ধস নেমেছে। যার প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়েছে। এছাড়া গ্রামীণফোনের শেয়ার নিয়ে অস্থিরতা এবং আইপিও‘র মাধ্যমে ৫শ কোটি টাকা তুলে নেওয়ায় পুঁজিবাজারে কিছুটা তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে পুঁজিবাজারে এমন দরপতন হচ্ছে। এছাড়াও সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে এমন ঘোষণা নিয়ে বাজারে নানা ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, এসব কারণে পুঁজিবাজারে দরপতন হচ্ছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থের একটা বড় অংশ বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর হিসাবে রয়েছে। এই টাকা ব্যাংক খাত থেকে চলে গেলে তারল্য সংকট দেখা দেবে। অন্যদিকে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিজার্ভের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হলে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমে যাবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে সব প্রতিষ্ঠানে এই বিপুল পরিমাণ টাকা ছিল সেখান থেকে টাকাগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এইসব টাকা কোনো প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত অর্থ না, এটাকে আমরা বলি, রিজার্ভ ফান্ড বা সংরক্ষিত তহবিল। এই তহবিল থেকে ভবিষ্যতে কোম্পানির বিভিন্ন জিনিসে যে অপচয় হয়, যেমন একটি গাড়ি কিংবা বিল্ডিং ব্যবহার হতে হতে এক সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন এগুলো ঠিক করতে টাকা লাগবে। আবার কোম্পানি প্রয়োজনে বর্ধিত করতে কিংবা নতুন ভবন নির্মাণ করার প্রয়োজন হলে এই টাকা থেকে খরচ করা হয়। এইসব কারণে এই ফান্ডগুলো রাখা হয়। সরকার এসব ফান্ড নিয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলো স্থবির হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ব্যাংক কিংবা শেয়ার মার্কেটে বিরুপ প্রভাব পড়বে কিনা এটা গুরুত্বপূর্ণ না। কারণ ব্যাংকের টাকা আসবে যাবে, এটা নিয়মিত একটি প্রক্রিয়া। সবচেয়ে বড় কথা হলো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)‘র সাবেক সভাপতি মো: রকিবুর রহমান বলেন, সরকারি কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়ার সময় তাদের রিজার্ভের অর্থ দেখানো হয়েছে। যেমন তিতাসের মতো ইজিএম না করে, শেয়ারহোল্ডাদের সাথে কথা না বলে এবং বিএসইসির অনুমতি না নিয়ে রিজার্ভের টাকা কিভাবে নেওয়া হবে? তালিকাভুক্ত কোম্পানির আইন না মেনে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সরকারি কোম্পানির রিজার্ভের টাকা নেওয়া হলে পুঁজিবাজার বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন এই বাজারের প্রতি কারো আস্থা থাকবে না। দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তারা বাজার বিমুখ হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, এটা করার আগে বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা করা দরকার ছিল। সরকারের যদি এতই টাকার প্রয়োজন হয়, তাহলে সরকারি ভালো কোম্পানিগুলো পর্যায়ক্রমে পুঁজিবাজারে ছেড়ে সেখান থেকে অর্থ নিতে পারতো।

সরকারি ও স্বায়িত্বশাসিত ৬৮ প্রতিষ্ঠানের কাছে ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা: বর্তমানে সরকারি ৬৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছে রিজার্ভের পরিমাণ ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানে রিজার্ভ আছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে ২১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, পেট্রোবাংলার ১৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, পিডিবিতে ১৩ হাজার ৪৫৪ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে ৯ হাজার ৯১৩ কোটি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে ৪ হাজার ৩০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে। নতুন আইনের ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ নিজ বাৎসরিক ব্যয় রেখে বাকি অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হবে। সরকার এই অর্থ উন্নয়ন কাজে খরচ করবে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ২০ প্রতিষ্ঠান: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৫৬টি কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি সরকারি কোম্পানি। কোম্পানিগুলো হলো বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের অধীনে ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল। পেট্রোবাংলার আওতাধীন তিতাস গ্যাস, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি, ঢাকা ইলেকট্রনিক সাপ্লাই কোম্পানি। এছাড়াও রয়েছে, রেইন উইক যজ্ঞেশ্বর, ন্যাশনাল টিউব, রূপালী ব্যাংক, ইস্টার্ন ক্যাবল, আইসিবি, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল, উসমানিয়া গ্লাস, বাংলাদেশ সার্ভিস, এটলাস বাংলাদেশ, শ্যামপুর সুগার, জিলবাংলা সুগার, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পনির আয় কমবে: বিভিন্ন করপোরেশনের উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা নেওয়া হলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের আয় কমে যাবে বলেও বিনিয়োগকারীদের অভিমত। তাদের মতে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর করা আছে। এফডিআর থেকে সুদ বাবদ পাওয়া অর্থ কোম্পানির আয় হিসাবে দেখানো হয়। এতে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় বাড়ে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হলে এসব প্রতিষ্ঠানের আয় ও বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ কমে যাবে।

উল্লেখ্য, গত ২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকারি সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন ২০১৯’র খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। 

এদিকে শেয়ারবাজারে বুধবার বড় দরপতনের পর গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মূল্য সূচকের সামান্য উত্থান হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) পতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। মূল্য সূচকের পাশাপাশি ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। তবে কমেছে লেনদেনের পরিমাণ। এদিন ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া ১৫৮ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার বিপরীতে কমেছে ১৩৭টির। আর ৫৯টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়ার ফলে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের কার্যদিবসের তুলনায় দশমিক ৭১ পয়েন্ট বেড়ে ৪ হাজার ৯৩৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে। বাকি দুটি সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ্ এক পয়েন্ট বেড়ে এক হাজার ১৫৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আর ডিএসই-৩০ সূচক দশমিক ৮৭ পয়েন্ট বেড়ে এক হাজার ৭৩৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

মূল্য সূচক ও বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়লেও এদিন ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণও কিছুটা কমেছে। দিনভর বাজারে লেনদেন হয়েছে ৪০৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৫০২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। সে হিসাবে লেনদেন কমেছে ৯৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৩২ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৯৮২ পয়েন্টে। বাজারে লেনদেন হয়েছে ১২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৪১ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম বেড়েছে ৮৯টির, কমেছে ১১৫টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৭টির দাম।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বন্ড মার্কেট ও শেয়ারবাজারের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক কাজ করবে। ব্যাংক খাতের উন্নয়নেও বিভিন্ন পরামর্শ দেবে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে নিজ কার্যালয়ে  গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক পরিচালক জুবিদা খেরুস অ্যালাউয়্যার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের মন্ত্রী এ কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, বন্ড মার্কেট ও শেয়ারবাজারের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক কাজ করবে। যেসব জায়গায় আমরা পিছিয়ে রয়েছি, সেসব জায়গার উন্নয়নে বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংক সহায়তা করবে। বিশ্বব্যাংক আরও বেশি বেশি করে সাহায্য করতে প্রস্তুত। এজন্য আমাদের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে।

আমাদের বন্ড মার্কেটটা টোটালি ডেভেলপ করা হয়নি মন্তব্য করে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এ মার্কেটের উন্নয়ন করতে হবে। এ মার্কেটের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি উভয় সেক্টরকেই এগিয়ে আসেত হবে। বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন হলে শেয়ারবাজারেরও উন্নয়ন হবে। বন্ড মার্কেটের উন্নয়নে বিভিন্ন ফি কমানো হয়েছে। বন্ড মার্কেটকে প্রাণবন্ত (ভাইব্রেট) করার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হবে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, বন্ড মার্কেটকে আমরা ডেভেলপ করবই।

বন্ড মার্কেট প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, বন্ড মার্কেটের উন্নয়নে কর্পোরেট সেক্টরের প্রভিডেন্ড ফান্ডগুলোও নিয়ে আসা হবে। এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও একমত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের অর্থনীতিতে আর্থিক খাতের উপাদান কম। উপাদান কম থাকলে ছোট হয়ে যায়। অর্থনীতিকে বেগমান করতে হলে আমাদের অনেক টুলস দরকার। এগুলোই করা হচ্ছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ