বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ভূখণ্ডদাবির প্রলাপ ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

ড. মো. নূরুল আমিন : (দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি)
গত সপ্তাহে আমরা অবিভক্ত ভারতে দ্বিজাতিতত্ত্ব তথা মুসলমান এবং হিন্দু এই দু’টি ধর্মীয় জনগোষ্ঠি দু’টি স্বতন্ত্র আকিদা বিশ্বাস, শিক্ষা, সভ্যতা সংস্কৃতি ও আচার আচরণে বিশ্বাসী এবং অনুশীলনকারী হিসাবে দু’টি জাতি হবার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি এবং ভারত বিভক্তির যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। মুসলমানরা প্রথম অবস্থায় ভারত বিভক্তির চিন্তা করেননি, তারা হিন্দুদের সাথে অবিভক্ত ভারত বর্ষেই বসবাস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। একই সমাজে মুসলমানদের বসবাস এবং তাদের সহ্য করার মনোবৃত্তি হিন্দুদের ছিল না। আমরা নিজেরাও দেখেছি, স্কুলে সহপাঠী হিসাবে হিন্দু ছাত্ররা মুসলিম ছাত্রদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতো না। টিউবওয়েলে যদি মুসলিম ছাত্রদের স্পর্শ লাগতো তাহলে টিউবওয়েলের পানি তারা খেতনা, ফেলে দিত। পানি ভর্তি কলসী তারা ভেঙ্গে ফেলতো। মুসলমান বন্ধুদের বাড়ি ঘরে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে আসা যাওয়া ও খেলাধুলা করতো, কিন্তু কোনও হিন্দু ঘরে যদি মুসলমান ছেলেমেয়ে প্রবেশ করতো তাহলে তাদের জাত যেতো, খাবার দাবার অপবিত্র হয়ে যেতো এবং তারা তা ফেলে দিতো। তাদের কাছে হিন্দু নমশূদ্ররা যেমন ছিল অচ্ছ্যূৎ তার থেকে বেশি ছিল মুসলমানরা। হিন্দু জমিদার বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাড়ির সামনে দিয়ে কোনও মুসলমান, পুরুষ বা মহিলা জুতা পায়ে, ছাতা মাথায় সাইকেলে বা পাল্কীতে চড়ে কোথাও যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। শিক্ষা দীক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে এর প্রভাব ছিল বিপুল। ১৮৯২ সালে যখন বৃটিশ সরকার প্রারম্ভিকভাবে প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান ও নির্বাচন পদ্ধতির প্রচলন করেন তখন থেকেই বর্ধিত হারে মুসলমানদের বঞ্চনা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তারা সংখ্যালঘু হিসেবে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের নিপীড়নের শিকার হন। এবং তাদের মধ্যে বঞ্চনার অনুভূতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুসলিম নেতৃবৃন্দ এই অন্যায় আধিপত্যের বিরোধিতা করেন। সাধারণ মুসলমানরা অসহিষ্ণু সংখ্যাগুরু হিন্দুদের অব্যাহত আধিপত্যের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩০ সালের Indian statutory comission এর রিপোর্টের দ্বিতীয় খ-ের ২৫ পৃষ্ঠায় ভারতবর্ষে বিদ্যমান হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে তাদের একইদেশে ঐক্যবদ্ধ বসবাসের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। খ্যাতনামা বৃটিশ লেখক স্যার থিওডোর মরিশন (১৮৩২-১৯৩২) তার বিখ্যাত পুস্তক Political India তে লিখেছেন, “France and Germany were to Europians the standard example of enemy nation and yet a young frenchmen might go to Germany for bussines ar study, he might take his residence with a Germany family, share their meals and go with them to the same place of worship. Eventually he might marry the daughter of the house and nobody would find this a matter for scandal or surprise. No muslim, he concluded, can live on such terms within a Hindu family and vice versa.” অর্থাৎ ইউরোপবাসীদের কাছে ফরাসী এবং জার্মানরা পরস্পর পরস্পরের শত্রু জাতির দৃষ্টান্ত হিসাবে পরিচিত। তবুও একজন ফরাসী যুবক ব্যবসা বাণিজ্য অথবা শিক্ষা গ্রহণের জন্য জার্মানী যেতে পারেন, জার্মান পরিবারে বসবাস করতে পারেন, তাদের সাথে একই খাবার কেতে পারেন এবং একই উপাসনালয়ে উপাসনা করতে পারেন, এমনকি ঐ পরিবারের মেয়েও বিয়ে করতে পারেন। এই ঘটনাগুলোতে কেউ কোনও কলঙ্ক দেখতে পাবেন না, এতে কেউ বিস্মিতও হবেন না। কিন্তু এই অবস্থায় কোনও মুসলমান হিন্দু পরিবারে অথবা হিন্দু মুসলিম পরিবারে থাকা খাওয়া অথবা উপাসনালয়ে উপাসনা করা অসম্ভব। হিন্দু মুসলমানের এই পার্থক্য তাদের ধর্ম সংস্কৃতি শিক্ষা সভ্যতা, হালাল হারাম ও জীবনাচারের পার্থক্য। এই পার্থক্যই শুধু তাদের দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়নি বরং হিন্দুদের মুসলিম বিদ্বেষ এবং বৃটিশ সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলানদের সব দিক থেকে পঙ্গু করে রাখা এবং রাজনৈতিক  ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিত রাখার কুটিল ষড়যন্ত্রও এই পথে তাদের পা বাড়াতে বাধ্য করেছিল।
বৃটিশ আমলে বিশ্বে পাট উৎপাদনের শতকরা ৯০ ভাগই ছিল পূর্ব বাংলার অবদান। কিন্তু পূর্ব বাংলায় অল্প কয়েকটি জুট বেইলিং প্রেস ছাড়া কোনও পাট কল গড়ে উঠতে দেয়া হয়নি। কেননা পূর্ব বাংলা ছিল মুসলিম প্রধান। পক্ষান্তরে হিন্দু প্রধান পশ্চিম বাংলার হুগলি নদীর তীরে গড়ে তোলা হয়েছিল ১০১টি পাটকল। পূর্ব বাংলায় অবস্থিত চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দরের উন্নয়নের কাজ করা হয়নি। আমদানি রফতানির কোনও কাজ এখানে হতো না, হতো কোলকাতা বন্দর থেকে। সমুদ্র থেকে কোলকাতা বন্দরের দূরত্ব ছিল ৮৫ মাইল, চট্টগ্রামের মাত্র ১২ মাইল। কোলকাতা ও পশ্চিম বাংলার সমৃদ্ধির পেছনে ছিল পূর্ব বাংলার সম্পদ, কার্যতঃ পূর্ব বাংলাকে কোলকাতা বন্দরের পশ্চাদ্ভূমিতে (Hinterland) পরিণত করা হয়েছিল। দেশ বিভাগের সময় পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলা পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হবার কথা ছিল। কিন্তু হিন্দু নেতারা তা হতে দেননি। গঙ্গার উৎস মূল নিজেদের কব্জায় রেখে ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে হুগলী দিয়ে পানি প্রবাহিত করে কোলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার জন্য হিন্দু নেতৃবৃন্দ সীমান্ত কমিশনের নেতৃবৃন্দকে নানাভাবে প্রভাবিত করে খুলনা জেলাকে পাকিস্তানে দিয়ে তারা মুর্শিদাবাদকে ভারতভুক্ত করেন। ফারাক্কা ডকুমেন্টে এ বিষয়টি তারা স্বীকার করেছেন।
তথাপিও শিল্প ও অবকাঠামো খাতে পূর্ব বাংলার যে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি তা দেশ বিভাগেরই অবদান। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, চালনা প্রভৃতি বন্দরের উন্নয়ন, সমুদ্র বন্দরগুলো আমদানি রফতানির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠা বিভাগোত্তর সরকারেরই কীর্তি। বিভাগ-পূর্বকালে যেখানে পূর্ব বাংলায় একটা জুট মিলও ছিল না সেখানে বিভাগ-উত্তরকালে ৭০টি জুট মিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং পাটের অভাবে পশ্চিম বাংলার ভারতভুক্ত এলাকার জুট মিলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অথবা চোরাচালান নির্ভর হয়ে পড়েছিল। দেখা যেত যে পূর্ব বাংলা থেকে পাট চোরাচালান বৃদ্ধি পেলে সেখানকার জুট মিলগুলো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এখনকার অবস্থা ভিন্ন। এখন তো বাংলাদেশের পাট শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে, পোশাক শিল্পও ধ্বংসের পথে। দেশ বিভাগের পূর্বে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বড় ব্যবসায়ী শিল্পপতি বলতে কেউ ছিলেন না। ব্যাংক বলতে কোঅপারেটিভ ব্যাংকই (সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাংক, ল্যান্ড মর্গেজ ব্যাংক, আরবান ব্যাংক, টাউন ব্যাংক) ছিল প্রধান এবং এর সবগুলোই ছিল হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণে। বর্তমানে ব্যাঙ্কিং ও আর্থিক খাতে আমাদের যে সগর্ব পদচারণা তা বিভাগোত্তর কালেরই ঘটনা ও ধারাবাহিকতা। বাংলাদেশের অবস্থা এখন ভারতের তুলনায় অনেক ভাল এবং তা স্বাধীনতারই ফল। এ অবস্থায় ভারতীয় নেতাদের বাংলাদেশ ভূখ- দাবি, বাংলাদেশের পুনরায় ভারতীয় ইউনিয়নে ফিরে যাওয়ার উস্কানি অথবা কনফেডারেশন গঠনের পুরানো প্রস্তাব মুসলিম অধ্যুষিত এই অঞ্চলটিকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
একাত্তর সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারে তারা বাধ্য হয়েছিল। তাদের অনেক জেনারেল ও রাজনৈতিক নেতা সেই বেদনা ভুলতে পারেননি। তাদেরই কিছু অনুসারী এখন সুযোগ বুখে কখনো ভূখ- দাবি করছেন, কখনো এই অঞ্চলকে ভারতভুক্ত করতে চাইছেন, কেউ কেউ আবার হিন্দুদের জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্বতন্ত্র এলাকাও দাবি করছেন। আমরা এসবকে প্রলাপ বলে মনে করি। তবে দুঃখ হয়, যখন শুনি বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ‘স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক বলে অভিহিত করছেন। তিনি অবশ্য স্বামী কে, স্ত্রী কে তা বলেননি। স্বামী-স্ত্রী তো এক ঘরে থাকে এক বাড়ির বাসিন্দা। বাংলাদেশ-ভারত কি এক বাড়ি?
বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে কখনও বিলীন হতে পারে না। এই দেশের মানুষ তা হতে দিতে পারে না। অতীতের কথা বাদ দিলেও সাম্প্রতিকালে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক ভারতীয়রা সে দেশে কিভাবে মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে এই দেশের মানুষ তা জানে।
নাগরিকত্ব বাতিল করে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে পুশ ইনের ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও মানুষ অবগত। এই অবস্থায় ক্ষমতার লালসা ও প্রলোভন দেখিয়ে শতাধিক টিভি চ্যানেলে কৃষ্টি সভ্যতা সংস্কৃতি ও জীবনাচার বিরোধী ও আপাত দৃষ্টিতে মুসলিমবান্ধব নাটক-সিনেমা প্রচার করে, হিন্দু ছেলের কাছে মুসলিম মেয়ে বিয়ে দিয়ে অথবা হিন্দু পরিবারে মুসলিম চাকরানী রেখে তথাকথিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভিনয় তরুণ সমাজের কিছু কিছু সদস্যকে বিভ্রান্ত করলেও এই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসন ভুলে গিয়ে ভারতের সাথে লীন হয়ে যেতে পারে না।
অবশ্য শাসক দলের মধ্যে একটি গোষ্ঠী দেশের মানুষকে ইসলামী মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা যে করছে না তা নয়। তাদের এই চেষ্টা অবশ্যই ব্যর্থ হবে। দু’দেশের সম্পর্ক স্বাধীন ও সার্বভৌম নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হোক এটাই আমাদের কামনা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ