শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

কবি গোলাম মোস্তফা ও তাঁর সাহিত্য সাধনা

ড. এম এ সবুর : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গোলাম মোস্তফা এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ইসলামি ভাবধারার সাহিত্য রচনায় রয়েছে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব। বাঙালি মুসলমানের জাতীয় জাগরণ তাঁর সাহিত্যেকর্মের মূল উদ্দেশ্য। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক বাংলা ১৩০২ সনের ৭ পৌষ, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামে কবি গোলাম মোস্তফা জন্মলাভ করেন। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক, ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে আই.এ, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ পাশ করেন এবং ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ডেভিড হেয়ার টেনিং কলেজ থেকে বি.টি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ব্যারাকপুর সরকারি হাইস্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। পরে কলিকাতার হেয়ার স্কুলে, কলিকাতা মাদ্রাসায়, বালিগঞ্জ গর্ভনমেন্ট ডিমনেস্ট্রেশন হাইস্কুলে সাধারণ শিক্ষক এবং বাকুরা ও ফরিদপুর জেলাস্কুলে হেডমাস্টার পদে চাকরি করে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। 

অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মাদী’তে ‘আন্দ্রিয়ানোপল উদ্ধার’ শিরোনামের কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্য জগতে প্রবেশ। পরে দীর্ঘ ৫০ বছর সাহিত্যকর্ম অব্যাহত রেখে বাংলা সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর লিখিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে রক্তরাগ, হা¯œাহেনা, খোশরোজ, সাহারা, বুলবুলিস্তান, কাব্যকাহিনী ও বনি আদম  নামের সাতটি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ, মুসাদ্দাস-ই-হালী, শিকওয়া ও জওয়াব-ই-শিকওয়া, ইখওয়ানুস সাফাসহ চারটি অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ, রূপের নেশা ও ভাঙ্গা বুক নামের দু’টি উপন্যাস গ্রন্থ; তারানা-ই-পাকিস্তান ও গীতি সঞ্চায়ন নামের দু’টি গানের সংকলন; ইসলাম ও কমিউনিজম, ইসলাম ও জেহাদসহ চারটি রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ; বিশ্বনবী, মরুদুলাল ও হযরত আবুবকর নামের তিনটি জীবনী গ্রন্থ, আল-কুরআন নামে কুরআনের একটি অনুবাদ গ্রন্থ; আমার চিন্তাধারা ও গোলাম মোস্তফাঃ প্রবন্ধ সংকলন নামের দু’টি প্রবন্ধ সংকলন পাওয়া গেছে। আলোকমালা (সিরিজ), আলোকমঞ্জুরী (সিরিজ), মঞ্জুলেখা, মণিমুকুর, খোকা-খুকীর বই, বাংলা ব্যাকরণ  নামে তাঁর বেশ কয়েকটি শিশু পাঠ্যপুস্তকও  আছে।

গোলাম মোস্তফার সাহিত্যের অধিকাংশের মূল বিষয় ইসলামি আর্দশ ও মুসলিম ঐতিহ্য। নিছক সৌন্দর্য্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি লিখেননি; বরং ইসলাম ও ইসলামি আদর্শ রূপায়নের জন্যই লিখেছেন তিনি। তিনি রসাত্মক কবিতা রচনা করলেও কুরআন-হাদীস তথা ইসলামি আদর্শ ঐতিহ্যের প্রতি ছিলেন তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন। কোন রচনাই যেন ইসলাম পরিপন্থী কিংবা ইসলামের বিকৃত উপস্থাপন না হয় সে দিকে তিনি ছিলেন সদা সতর্ক। ইসলামি চেতনার রূপায়ণই তাঁর সাহিত্য-সাধনার প্রধান উদ্দেশ্য এবং মুসলিম সমাজের সাহিত্য-সংস্কৃতির জাগরণ তাঁর লক্ষ্য। তিনি মুসলিম জাতির জাগরণমূলক ইসলামি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বিষয়াবলীকেই গীতি কবিতার আঙ্গিকে পরিবেশন করেছেন। তাঁর জীবন সাধনায় মুসলিম বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত বিষয়াবলীকেই সাহিত্যে রূপায়িত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘আমার লক্ষ্য আদর্শ’ প্রবন্ধে লিখেন, 

‘যে যুগে আমার জন্ম সে যুগ বাংলার মুসলমানদের অবসাদের যুগ। সে যুগে আমাদের সাহিত্যের না ছিল কোন স্বাতন্ত্র্য, না ছিল কোন স্বকীয়তা। প্রত্যেক জাতির মনন শক্তি, ঐতিহ্য, ধ্যান-ধারণা ও আশা-আকাঙ্খা রূপায়িত হয় তার মাতৃভাষার মধ্যে। জাতির অন্তরমূর্তি ছায়া ফেলে তার সাহিত্যের মনো-মুকুরে। সাহিত্য তাই জাতির মনের প্রতিধ্বনী। সাহিত্যের ভিতর দিয়েই গোটা জাতির সাচ্চা চেহারা দেখা যায়। সেই হিসেবে বাংলার মুসলমানের কোন সাহিত্যই তখন রচনা হয়নি। আমি তাই ছোট বেলা থেকেই চেয়েছিলাম মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য রচনা করতে।’ 

গোলাম মোস্তফা বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রতিভা ও খ্যাতনামা কবি। কবি হিসেবে অধিক পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, জীবনী লেখক, অনুবাদক, গীতিকার, সুরকারসহ বহু প্রতিভার অধিকারী। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ইসলামি চেতনার সাহিত্য রচনায় গোলাম মোস্তফার স্বতন্ত্র¿ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তাঁর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল আদর্শের ক্ষেত্রে অনমনীয়তা ও দৃৃৃৃৃঢ়তা। তাঁর সাহিত্য সাধনা মুসলিম সাহিত্যধারাকে করেছে প্রত্যয়নিষ্ঠ ও আত্মপ্রত্যয়বোধের মধ্যে সংস্থিত এবং বাংলা ভাষায় ইসলামি সাহিত্য-সংস্কৃতিকে করেছে বিকশিত। সাহিত্যের আঙ্গিক-প্রকরণে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দের অনুসারী হলেও তাঁর সাহিত্যকর্মের মূল উপজীব্য ইসলামি আদর্শ ও ঐতিহ্য। এ  সম্পর্কে তিনি বলেন,

রবীন্দ্রনাথ বা সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগী হলেও আমার মনে জেগেছিল আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির একটা দুর্জ্জয় আকাঙ্খা। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির তাকিদে নয়, সহজভাবে আমি বাংলার সাহিত্যে চেয়েছিলাম ইসলামি কৃষ্টির রূপায়ন।

গোলাম মোস্তফার অনন্য কীর্তি বিশ্বনবী। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় গ্রন্থগুলোর অন্যতম এ গ্রন্থখানি। বাংলা ভাষায় রচিত হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবনী গ্রন্থগুলোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ  বিশ্বনবী। গোলাম মোস্তফা রাসুল প্রেমিক সাহিত্যিক। তাই রাসূল স. এর প্রতি অগাধ প্রেম-ভালবাসা থেকেই তিনি বিশ্বনবী রচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে বইটির প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তিনি লিখেন, 

মহাপুরুষদের জীবন শুধু ঘটনার ফিরিস্তি নহে; শুধু যুক্তি-তর্কের কন্টক শয্যাও নহে; সে একটা ভক্তি, শ্রদ্ধা, বিস্ময় ও অনুভবের বস্তু, তাহাকে বুঝিতে হইলে একদিকে চাই সত্যের আলোক ও বিজ্ঞানের বিচার বুদ্ধি, অপরদিকে ঠিক তেমন চাই ভক্তের দরদ, কবির সৌন্দর্যানুভূতি, দার্শনিকের অন্তর্দৃষ্টি আর চাই প্রেমিকের প্রেম। আশেকে রসূল না হইলে সত্যকার রসূলকে দেখা যায় না।

প্রকৃতপক্ষে বিশ্বনবী গোলাম মোস্তফার ‘ইশক-ই-রাসূল’ (রাসুল প্রেম)-এর ফসল। বইটির পরতে পরতে তিনি নিজেকে ‘আশেকে রসূল’ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ইতিহাসের তথ্য, তত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, দার্শনিক যুক্তি ইত্যাদি উপস্থাপনের মাধ্যমে হযরতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তাঁর প্রয়াস এ গ্রন্থে সর্বত্র। হযরতের জীবন ঘটনার কল্পচিত্র, সাবলীল বর্ণনা, আকর্ষণীয় উপস্থাপনা বিশ্বনবীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। 

গোলাম মোস্তফার সমকালে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী কমিউনিজম ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এর প্রভাব ভারতীয় উপমহাদেশেও পড়ে। এতে অনেক তরুণ বাঙালি মুসলিম মার্কসবাদ-লেলিনবাদের কমিউনিজম আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে উঠে। এ প্রেক্ষাপটে গোলাম মোস্তফা ইসলাম ও কমিউনিজম নামে একটি রাজনৈতিক গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মার্কসবাদ ও লেলিনবাদের অসারতা প্রমাণ করেছেন। পাশাপাশি ইসলামই যে মুক্তির একমাত্র পথ সে কথাও তিনি তুলে ধরেছেন। এই গ্রন্থে তিনি ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম এবং ধর্মীয় চিন্তা-মতবাদ সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। এ গ্রন্থটি রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি ভূমিকায় লিখেন,

মুসলিম তরুণদের অনেকেই আজকাল কমিউনিজমের প্রতি বেশ খানিকটা ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে বলিয়া মনে হয়। ইসলামি আদর্শকে পরিত্যাগ করিয়া তাহারা কমিউনিজমের রূপে ভুলিয়াছে। কমিউনিজমই হইল তাহাদের কাছে আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যেন দুনিয়ায় এমন সুন্দর ব্যবস্থা আর কোথাও ছিল না, নাই বা হইবে না। ইসলামের বিধান অপেক্ষা কমিউনিজমের বিধানই যে শ্রেষ্ঠতর এবং বর্তমান যুগ সমস্যার সমাধানে এই ব্যবস্থাই যে সর্বাপেক্ষা উত্তম, ইহাই তাদের ধারণা। এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করিবার জন্যই আমার এই প্রয়াস। 

জিহাদ ইসলামের অন্যতম ইবাদাত। কিন্তু জিহাদ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকা এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের ষড়যন্ত্রের শিকার কিছু সংখ্যক মুসলিমের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জিহাদ সম্পর্কে জনমনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় জিহাদ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা নিরসন এবং এর ইসলামি জিহাদের স্বরূপ উম্মোচনের লক্ষ্যে গোলাম মোস্তফা ইসলাম ও জেহাদ গ্রন্থ প্রণয়ন  করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেন, 

অধিকাংশ মুসলমানই জেহাদকে সত্য করিয়া চিনে না। তাহারা শুধু জেহাদের নামই শুনিয়াছে, কিন্তু জেহাদের সাচ্চা চেহারা দেখে নাই। অনেকেরই ধারণাঃ জেহাদ বলিলেই বিধর্ম্মীদিগের সহিত যুদ্ধ, হত্যা, লুণ্ঠন ইত্যাদি বুঝায়। পক্ষান্তরে অ-মুসলমানদের মনেও জেহাদ সম্বন্ধে একটা ভ্রান্ত ধারণা বদ্ধমূল হইয়া আছে।.......এই জন্যই ইসলামের আলোকে আজ আমরা জেহাদের আলোচনা করিতে চাই।

গোলাম মোস্তফা রচিত কাব্য সাহিত্যের অধিকাংশই ইসলামি চেতনাসমৃদ্ধ। তাঁর সাহিত্যে তাওহিদ, ইসলামি বিধি-বিধান, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং নবী-রাসূল ও অন্যান্য মুসলিম মনীষীদের শৌর্য-বীর্য, মহানুভবতা ইত্যাদি গুণাবলী ও তাঁদের জীবনের বিভিন্ন দিক বেশি আলোচিত হয়েছে। তাঁর রচিত গানগুলোতেও ইসলামের আদর্শ-ঐতিহ্য রূপায়িত হয়েছে। যেমন- 

‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদ রসূল’।

এই কালেমা পড়রে আমার পরাণ বুলবুল ॥

উল্লেখিত গানে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের বর্ণনা দিয়েছেন। আবার নামাজের প্রতি গুরুত্বারোপ করে অন্য এক গানে লিখেছেন, 

নামাজের এই পাঁচ পিয়ালা গুলাবী শরবৎ

পান করে তোর দীল তাজা কর, হে নবীর উম্মত ॥

মহান আল্লাহর প্রশংসা করে (হামদ) লিখেন,

অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি

বিচার দিনের স্বামী ॥

এমনিভাবে গোলাম মোস্তফা হামদ-নাতসহ অনেক ইসলামি গান রচনা করেছেন। যা মুসলিম সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়ে থাকে। 

সাহিত্যকর্মে অনন্য অবদানের জন্য গোলাম মোস্তফা ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ‘প্রেসিডেন্ট পদক’ এবং ‘সেতারা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধী লাভ করেন। তিনি করাচির ইকবাল একাডেমী এবং ঢাকার বাংলা একাডেমীর  আজীবন সদস্য ছিলেন। তাছাড়া কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড-এর নির্বাহী সদস্য, ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তান (ঢাকা)-এর সদস্য, ইসলামিক একাডেমী, ঢাকা-এর সদস্য, উর্দূ-বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, লাহোর-এর সদস্য, জাতীয় উন্নয়ন ব্যুরো, পূর্ব পাকিস্তান স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড, পাকিস্তান মজলিশ, রওনক, পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের তিনি সদস্য ও কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক লেখক সংস্থা পি-ই-এন- এর কেন্দ্রীয় পাকিস্তান শাখা এবং পুর্ব পাকিস্তান শাখার অন্যতম কর্মকর্তা ছিলেন। এ মহান কীর্তিমান সাহিত্য সাধক ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ অক্টোবর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ