আবরারকে নির্যাতনের নির্দেশ মেসেঞ্জারের ‘এসবিএইচএসএল ১৫+১৬’ গ্রুপে’
তোফাজ্জল হোসেন কামাল : বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যাকান্ডের একদিন আগে (৫ অক্টোবর) মেরে শেরে বাঙলা হল থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দেয় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন। আর এই নির্দেশ দেয়া হয় শেরেবাংলা হলের ১৬তম ব্যাচের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। বুয়েট ও শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে তৈরি ফেসবুকের মেসেঞ্জার গ্রুপে ৫ অক্টোবর দুপুর ১২টা ৪৭ মিনিটে এই নির্দেশ দেওয়া হয়। ‘এসবিএইচএসএল ১৫+১৬’ নামে ওই গ্রুপে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে আবরারকে মেরে হল থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশের প্রমাণ পাওয়া গেছে। গ্রুপটি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে শেরেবাংলা হলের ১৫ ও ১৬তম ব্যাচের নেতাকর্মীদের যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হতো বলে জানা গেছে। এই গ্রুপের মেসেঞ্জার‘র কথোপকথন এখন আলোচনার শীর্ষৈ।
ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কথোপকথন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৫ অক্টোবর দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে ১৬তম ব্যাচের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে মেহেদী হাসান রবিন লেখে, ‘১৭-এর আবরার ফাহাদ; মেরে হল থেকে বের করে দিবি দ্রুত @১৬; এর আগেও বলছিলাম; তোদের তো দেখি কোনও বিগারই নাই; শিবির চেক দিতে বলছিলাম; দুই দিন সময় দিলাম।’
রবিন মেসেঞ্জার গ্রুপে আরও লেখে, ‘দরকারে ১৬ ব্যাচের মনিরের সঙ্গে কথা বলিস। ও আরও কিছু ইনফো দিবে শিবির ইনভলমেন্টের ব্যাপারে।’
‘ওকে ভাই’ জবাব দেয় ১৬তম ব্যাচের মনিরুজ্জামান মনির।
রবিনের নির্দেশ পাওয়ার পরদিন রোববার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৭টা ৫২ মিনিটে মনির গ্রুপে লেখে, ‘নিচে নাম সবাই’। এরপরই রাত ৮টা ১৩ মিনিটে আবরার ফাহাদকে তার রুম থেকে ডেকে নিয়ে যায় তানিম, বিল্লাহ, অভি, সাইফুল, রবিন, জিওন ও অনিক। যা শেরেবাংলা হলে থাকা সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়েছে। এরপর রাত ১২টা ৩৮ মিনিটে ‘এসবিএইচএসএল ১৬+১৭’ গ্রুপে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক উপ-সম্পাদক অমিত সাহা লেখে, ‘আবরার ফাহাদ কি হলে আছে’ জবাবে শামসুল ও সজীব জানায়, ‘২০১১-তে আছে।’ জানা গেছে ২০১১ নম্বর কক্ষে অমিত সাহা থাকে।
মেসেঞ্জারে অন্য আরেকটি কথোকথন পাওয়া গেছে, যা ছিল অমিত সাহা ও ইফতি মোশাররফ সকালের মধ্যে। এতে অমিত সাহা লিখেছে, ‘আবরার ফাহাদরে ধরছিলি তরা?’। ইফতি জবাব দেয়, ‘হ’। আবার প্রশ্ন করে অমিত, ‘বের করছোস?’ জবাবে ইফতি পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কি হল থেকে নাকি স্বীকারোক্তি’ এবার অমিত লেখে, ‘স্বীকার করলে তো বের করা উচিত।’
এরপর ইফতি জবাব দেয়, ‘মরে যাচ্ছে; মাইর বেশি হয়ে গেছে’। জবাবে অমিত সাহা লেখে, ‘ওওও বাট তাকে তো লিগ্যালি বের করা যায়’। এরপর একটি ইমোজি পাঠায় ইফতি। পরে এই দুজনের আর কোনও কথোকথন পাওয়া যায়নি।
ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে এই কথোপকথন প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আব্দুল বাতেন বলেন, ‘আমরা সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে এই হত্যাকান্ডের তদন্ত করছি। কথোপকথনের বিষয়টিও যাচাইবাছাই চলছে।’
গত রোববার (৬ অক্টোবর) রাতে আবরারকে হত্যার পরদিন সোমবার (৭ অক্টোবর) রাজধানীর চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এর তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি দক্ষিণ বিভাগ। এ পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিবির কর্মকর্তারা।
ভয় আর ভয়
শেরেবাংলা হলের একাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী জানান, তাঁরা সব সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ভয়ে তটস্থ থাকেন। আবরার যে রাতে খুন হন, সেই রাতে হলের প্রধান ফটকের সামনে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন মো. সেলিম। নিরাপত্তারক্ষীদের বসার চেয়ার-টেবিলের পেছনের সিঁড়িতে রাখা হয়েছিল আবরারের লাশ।
আবরার হত্যাকান্ডের বিষয়ে নিরাপত্তারক্ষী সেলিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছুই জানি না। যা ঘটেছে, তার সবই আছে সিসিটিভির ক্যামেরায়।’ সেলিম বলেন, ‘আমরা ছোট চাকরি করি। আবরার কীভাবে মারা গেছেন, কারা মেরেছেন, তা বলতে পারব না।’
আবরারকে মারধর করা হচ্ছে, সে খবর হলের অনেক ছাত্রই জানতেন। কিন্তু ভয়ে কেউ ২০১১ নম্বর কক্ষের দিকে যাননি বলে জানা গেল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রায়ই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে বা ধরে নিয়ে এই কক্ষে (২০১১) নির্যাতন করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ভয়ে কেউ কথা বলে না। এখনো আমরা ভয়ে আছি।’
শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন, এমন তিনজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, ছাত্রলীগের নেতারা তাঁদের কক্ষে ডেকে নিয়ে প্রথমে মোবাইল ও ল্যাপটপ কেড়ে নেন। এরপর বেধড়ক মারধর শুরু করেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করা তাঁদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
অমিত হাসান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই হলে (শেরেবাংলা) যাঁরা থাকেন, তাঁদের কেউ না কেউ র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন। আমিও হয়েছি। ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে না গেলে নেতারা আমাদের হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন।’
পলিটিক্যাল রুম
শেরেবাংলা হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘পলিটিক্যাল’ রুমের সামনে দিয়ে তাঁদের সতর্কতার সঙ্গে চলাচল করতে হয়। সালাম না দিলে ছাত্রলীগের বড় ভাইয়েরা মারধর করেন।
আবরারকে প্রথমে হলের যে কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করা হয়, সেই কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, চারটি ফ্যানই সচল। তবে কক্ষে কেউ নেই। আবরার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার বুয়েট ছাত্রলীগের উপ-সমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক ইফতি মোশাররফ ওরফে সকাল থাকতেন এই কক্ষে। তাঁর টেবিলের ওপর রাখা কম্পিউটারটি সচল অবস্থায় দেখা গেল। কক্ষের আরেক শিক্ষার্থী অমিত সাহার টেবিলের ওপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট। একই কক্ষের আরেক শিক্ষার্থী রাফিদের টেবিলের ওপর বইপত্র এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে। এই কক্ষে দেখা গেল, মোটা নাইলন দড়ি।
হলের একাধিক সাধারণ শিক্ষার্থীর অভিযোগ, আবরার হত্যার আগে তুচ্ছ কারণে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রাসেল এবং বুয়েট ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহতাছিম ফুয়াদ শিক্ষার্থীদের মারধর করতেন।
বুয়েটের রশিদ হলের ছাত্র ফাহিম আল হাসান মঙ্গলবার দুপুরে আসেন আবরারের কক্ষের সামনে। সাত মাস হলো ফাহিম হলে উঠেছেন। তিনি বলেন, ‘বুয়েটের একজন ছাত্রের গায়ে কেন হাত তোলা হবে? আবরার তো কোনো দোষ করেননি। আবরারকে কেন নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করল? আবরারের এই মৃত্যুকে আমি মেনে নিতে পারছি না। আমাদের আরেক বন্ধু অভিজিৎকে থাপ্পড় মেরে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়া হয়।’