শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

কাশ্মীর সমস্যা প্রসঙ্গ

খান শরীফুজ্জামান :  [গত কালের পর]
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টি সুন্দর সমাধানের মডেল। বাংলাদেশের মানুষ যেমন পাকিস্তানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তেমনি তারা ভারতের অন্যায়ও মেনে নেবে না। কারণ, এদেশের মানুষ স্বাধীনচেতা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদকারী। সরকার চুপ থাকলেও সাধারণ মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখাবেই।’’ অন্যদিকে কাশ্মীরে যা ঘটছে তার বড় কোনো প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে বলে মনে করেন না রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ তিনি বলেন, ‘‘টুকটাক প্রতিক্রিয়া হবে যা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পাহাড়ে এর কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। কাশ্মীর ইস্যুতে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন। তাঁর মতে, ‘‘ভারতে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার কাজ হচ্ছে, অন্য কোনো সম্প্রদায় বা মাইনরিটিকে তারা সহ্য করতে পারছে না।—- লাদাখ নিয়েও ঝামেলা হবে চীনের সঙ্গে ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। —- একটা কিছু শুরু হলে সেটা হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের পর্যায়ে চলে যেতে পারে। কাশ্মীরে আরো কিছু মুসলমান নিধন হলে তার প্রভাব পাকিস্তান, আফগানিস্তানে পড়বে। আর এদিকটায় উত্তর প্রদেশ হয়ে বাংলাদেশেও চলে আসতে পারে।’’ বাংলাদেশের মানুষ কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করে বলে মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান। কাশ্মীর ইস্যুতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয় হতে পারে উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। আসামে মুসলামানদের ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিলের যে প্রক্রিয়া চলছে তা যদি এখন মোদী সরকার আরো এগিয়ে নেয় তাহলে বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। জাতিসংঘে ইমরান খানের কাশ্মীর সংক্রন্ত বক্তব্য নিয়ে এর পক্ষে-বিপক্ষে জনসাধারণের মধ্যে ও সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে নির্যাতিত জনগোষ্ঠি বা মুসলিম জনগোষ্ঠির প্রতি আমাদের পররষ্ট্রনীতি কেমন হওয়া উচিত, বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের মাঝেই তার সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা আছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ লাভ করে এবং একই বছরে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে তিনি সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। ভাষণে তিনি বলেন, “আমরা যুদ্ধের জন্য শক্তি অপব্যবহার করতে দেখেছি, জনগণকে নিপীড়ন করতে দেখেছি। আমরা তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অস্বীকার করতে দেখেছি। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে তাদের ঠেলে দিতেও দেখেছি। আর এসব অকথ্য যাতনার চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে আছেন আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইয়েরা। আর এ জন্যই অতীতের তুলনায় আজ এই শক্তিকে প্রজ্ঞার সঙ্গে কাজে লাগানোর প্রয়োজন বেশি। ধ্বংস নয় সৃষ্টি, যুদ্ধ নয় শান্তি, দুর্ভোগ নয় মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা যদি মহানবী (স.) প্রচারিত মানবপ্রেম ও মানবমর্যাদার শাশ্বত মূল্যবোধ আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারি, তা থেকে বর্তমানকালের সমস্যা সমাধানে মুসলিম জনসাধারণ সুস্পষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এসব মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে শান্তি ও ন্যায়বিচাররের ভিত্তিতে আমরা একটি নতুন আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পারি। আরব ভাইদের ওপর যে নিারুণ অবিচার হয়েছে অবশ্যই তার অবসান ঘটতে হবে। অন্যায়ভাবে দখলকৃত আরবভূমি অবশ্যই ছাড়তে হবে। আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে জেরুজালেমের ওপর। আল্লাহর কৃপায় আমরা এখন আমাদের সম্পদ ও শক্তি এমনভাবে সুসংহত করতে পারি, যাতে আমাদের সবার জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচার অর্জন করা যায়। এই সাফল্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ সম্ভাব্য সব প্রকার সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের সবার যৌথ প্রচেষ্টা সফল করুন”। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের মাঝে যেমন মানবতা ও মুসলিমবিশ্বের প্রতি দরদ দেখা যায় সে ধরনের দরদ, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ ইমরান খানের জাতিসংঘ ভাষণের মধ্যেও দেখা গেছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত তথা ১৯৪৭ সালের রেজুলেশনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে, আন্তর্জাতিক সকল মানবাধিকার চুক্তিও নীতি লঙ্ঘন করে ভারত কাশ্মীরে জোর-জুলুম, নির্যাতন এবং দ্ইু মাসব্যাপী কারফিউ দিয়ে অমানবিক দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। যদিও ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে গণহত্যা , সাতদশকে ফিলিস্তিনি গণহত্যা, রোহিঙ্গা ও কাশ্মীরে গণহত্যা সবকালেই মুসলিম হত্যার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিষ্ক্রিয় বা নিরব দর্শকের ভূমিকা আবার কখনো কখনো রেফারির ভূমিকাও পালন করেছে। যেহেতু, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ কাশ্মীরের মানুষের মতো প্রায় একই ধরনের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিল, তাই তারা কাশ্মীরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনকে বরাবর সমর্থন করে আসছে। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান-ভারতের দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোতেও বিছিন্নতাবাদী আন্দোলন দানা বেধে উঠতে পারে এবং পাশ্ববর্তী দেশগুলোতেও রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সম্পূর্ণ দুই পরমানু শক্তিধর পাক-ভারত উত্তেজনায় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে, তবে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পরমানু শক্তিধর দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কাও রয়েছে।
কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, আরাকান, উইঘুর, যে দিকেই তাকাননা-কেন মুসলিম নির্যাতনের একই দৃশ্যই দেখা যায়। সবখানেই মুসিলিমদের ভূ-খ- দখল করে নিচ্ছে সা¤্রাজ্যবাদীরা। ভূ-খ-গুলাতে জনবিচ্ছিন্ন দালাল শাসকগোষ্ঠী বসিয়ে নানা রকম বিভাজন সৃষ্টি করে নষ্ট করছে মুসলিমদের ঐক্য ও সংহতিকে। এমন সময় প্রয়োজন মুসলমানদের একজন যোগ্য নেতৃত্ব, যিনি সকল প্রকার কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তাদের কাশ্মীরি মুসলিম ভাই-বোনদেরকে তথা মুসলিমবিশ্বকে অপশক্তির করাল গ্রাস হতে মুক্ত করবেন। যার সরকার মুসলিমদের মাঝে ঐক্য ও সুশাসন কায়েম করবেন। [সমাপ্ত]
-লেখক: পিএইচডি গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ