বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

অপসংস্কৃতির হিংস্র ছোবলে তরুণ সমাজ

মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন : একটি দেশের ভবিষ্যত হলো সে দেশের তরুণ সমাজ। এ ভবিষ্যতকে নষ্ট করার অপকৌশল হচ্ছে অপসংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে বাস্তবে তা প্রয়োগ করা। এ অপসংস্কৃতির প্রভাবে যখন তরুণ সমাজ বিপদগামী হয়, তখন দেশের সার্বিক ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়।
অপসংস্কৃতি হলো সংস্কৃতির বিকৃতরূপ। সংস্কৃতির কাজ জীবনকে বিকশিত করে, সুন্দর করে, সভ্য করে এবং মহৎভাবে বাঁচতে শেখায় আর অপসংস্কৃতি মানুষের বিকৃতি আনে, মানুষের চিন্তা চেতনাকে নষ্ট করে তথা সংস্কৃতির সম্পূর্ণ এর বিপরীত। যে আচার আচরণে মানুষের আত্মার অবনতি ঘটে তাই অপসংস্কৃতি। মোট কথা সংস্কৃতি হলো জীবন চর্চা আর অপসংস্কৃতি হলো জীবন ধ্বংস।
আমাদের তরুণ সমাজে যে অপসংস্কৃতির হিংস্র থাবা বিস্তার করেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। আমাদের সমাজের তরুণ-তরুণীদের পোশাক-পরিচ্ছদ, চালচলন, আচার-আচরণ দেখলেই অপসংস্কৃতির অশুভ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অবহেলা করে আমাদের তরুণ সমাজ বিদেশী জীবনবোধের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। আধুনিক যুগে সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির ভয়াবহ দিক অশ্লীলতার বিস্তার। আমাদের দেশে পাশ্চাত্য স্টাইলে ডিসকো নাচ, গান, অশ্লীল ছবি ও ভিডিও প্রদর্শিত হচ্ছে অহরহ। এ অশ্লীল ও যৌন উদ্দীপক নৃত্য, নারীদের দেহ প্রদর্শন ইত্যাদির ফলে তরুণ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সুষ্ঠুভাবে সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠার পরিবর্তে যৌনচারী অসভ্য মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে উঠছে।
যার ফলে ব্যাপক বিস্তার ঘটছে ইভটিজিং, ধর্ষণ, পরকীয়া প্রেম, পারিবারিক কলহ, এসিড নিক্ষেপ, সন্ত্রাসী,  সম্ভ্রমহানী  কার্যকলাপ। আধুনিক সমাজ সভ্যতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও প্রচার মাধ্যমসমূহ। বিশেষ করে ভিনদেশী চ্যানেল তথা স্টার প্লাস, স্টার জলসা, জলসা মুভিস, জি বাংলা ইত্যাদি চ্যানেলগুলি। আমাদের তরুণ সমাজ তথা যুবক-যুবতীরা সিনেমার উদ্ভট, অবাস্তব জীবনকেই অনেক সময় বাস্তব জীবন বলে ভুল করে এবং সিনেমা জগতের নিয়ম-কানুন, পোশাক-পরিচ্ছদ অন্ধভাবে অনুকরণ করতে গিয়ে কৃত্রিমতা ও অপসংস্কৃতির শিকার হয়। আমাদের সমাজে বর্তমানে যে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে তার মূলে রয়েছে অবাধ দুর্নীতি। দুর্নীতি যে সমাজে একবার আসন গেড়ে বসে, সে সমাজে সংস্কৃতি থাকতে পারে না। তাই সংস্কৃতির স্থান দখল করে নিয়েছে অপসংস্কৃতি। সত্য ও সুন্দরকে ত্যাগ করে তরুণ সমাজ তাই উগ্র জীবনযাপনে উৎসাহিত হয়ে উঠেছে এবং চরম অবক্ষয়ের মাঝে জীবনবোধ খুঁজে বেড়াচ্ছে। সিনেমা, নাটক ও সিরিয়াল, ভিডিওতে যেসব ছবি দেখানো হচ্ছে তার অধিকাংশই আমাদের মন-মানসিকতার সঙ্গ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রযুক্তি আমাদেরকে যতটুকু এগিয়ে নিয়ে তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের তরুণ সমাজের চরিত্রকে বিনষ্ট করার জন্যও সমান ভূমিকা রাখছে। বাসায় কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপে বসে সৃজনশীল কাজ কর্ম করার বদলে অশ্লীল  ভিসিডি দেখা, ইন্টারনেটে অশ্লীল পর্ণোগ্রাফীতে নিমগ্ন থাকে। যা ছাত্র ও তরুণ সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব অশ্লীল ছবি আমাদের তরুণ সমাজ তথা যুবক-যুবতীদের কাছে অতি প্রিয় হয়ে গেছে। তাদের আচার-আচারণ যেমন কুরুচিপূর্ণ, তেমনি অপসংস্কৃতির সহায়ক। এছাড়া দেশের মোবাইল কোম্পানিগুলি তরুণ সমাজের চরিত্র ধ্বংসের জন্য গভীর রাতে ফ্রি প্যাকেজ দিচ্ছে যা আমাদের তরুণ সমাজকে মেধাশূন্য করে দেয়ার একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। অপসংস্কৃতি ছোবলে তরুণ প্রজন্ম এর দায় কিছুটা রাষ্ট্র এবং সরকারের।
অপসংস্কৃতি হতে আমাদের তরুণ সমাজকে বাঁচাতে পরিবার,  সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা, ইসলামিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষা, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি  উপায়ে অপসংস্কৃতি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অপসংস্কৃতির  প্রতিরোধের জন্য সুস্থ, রুচিশীল, এবং দেশীয় সংস্কৃতির ধারক বাহক মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে এগিয়ে আসতে হবে। শক্তিশালী মিডিয়ার মাধ্যমে সকল আগ্রাসনের যুক্তিপূর্ণ জবাব দিতে হবে। হতে হবে দেশীয় ও নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক বাহক। দেশপ্রমিক ও নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে শক্তিশালী মিডিয়া প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনা করতে হবে। আর অপসংস্কৃতির প্রতিকার দিক সমূহ মিডিয়ার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। তাছাড়া সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মসজিদের ইমাম ও খতীব এবং ওয়ায়েজীনগণকে আজগুবি কিচ্ছা কাহিনী না বলে অপসংস্কৃতির কুফল সম্পর্কে ওয়াজ নসীহত করতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা ক্লাসে কিংবা এসেম্বলিতে সকল ছাত্র- ছাত্রীদেরকে সুস্থ সংস্কৃতির শিক্ষা দিতে হবে। 
সাহিত্য চর্চার মাধ্যমেও অপসংস্কৃতি দূর করা অনেকটা সম্ভব। কেননা সাহিত্য মানবসভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ।  সাহিত্য মানুষকে যথার্থ মানুষ গড়ে তোলে। মানুষের দেশ, কাল, ইতিহাসকে জানার জন্য সাহিত্য সাহায্য করে। অতীত ও বর্তমান জীবন সাহিত্যের রসময় উপজীব্য। জাতির ভবিষ্যৎ রচনায়, সমাজ-সংস্কৃতি সম্ভাব্য রূপায়ণে সাহিত্য অপরিহার্য উপাদান। সাহিত্য হিংসায় কোলাহলমুখর উন্মত্ত পৃথিবীতে দু'দণ্ডের শান্তি আনে, জরাগ্রস্ত মনে আনে উৎসাহের জোয়ার, একই চেতনায় উজ্জীবিত মানুষকে পরস্পরের কাছাকাছি এনে মানসিক প্রেরণা যোগায়।
সংস্কৃতি জীবনচেতনার প্রতিশ্রুতি। পরিশীলিত সংস্কৃতি চর্চা অত্যাবশ্যক। আমাদের তরুণ সমাজ যেহেতু জাতির আগামীদিনের কর্ণধার, তাই সংস্কৃতি চর্চার নামে তারা যেন বিধ্বংসী আচরণে লিপ্ত না হয় এজন্য তাদেরকে সচেতন করে তুলতে হবে। যে সংস্কৃতি জীবনকে মহিমা দেয়, হৃদয়কে প্রেমপূর্ণ করে, মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়,  তরুণদেরকে সে সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। তবেই তারা দেশপ্রেমিক ও দেশীয় সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সেবক হয়ে গড়ে উঠবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ