শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মহাসড়কগুলোতে কি অরাজকতা চলবেই?

আখতার হামিদ খান : কয়েকদিন আগের কথা। গাড়িতে বাংলাদেশ বেতারের এফএম ব্যান্ডের রেডিও বাজছিল। উপস্থাপিকা দিনের অনুষ্ঠানসূচি বলছিলেন। এর মধ্যে একটি ছিল, ‘... সময় শুনবেন সড়ক দুর্ঘটনার খবরগুলো।’ আমি বিস্মিত হয়ে একটি চরম সত্য অনুভব করলাম।
এখন ভয়ংকর সব সড়ক দুর্ঘটনা এতটাই নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে তা বেতারের প্রতিদিনের অনুষ্ঠানসূচিতে একটি অবধারিত বিষয় হিসেবে যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ যেন বলতে চাইছে এসব দুর্ঘটনা ঘটে চলছে এবং ঘটতেই থাকবে।
আগে কোনো জীবননাশী দুর্ঘটনা ঘটলে সান্ত¡না দেয়া হতো এই বলে যে, দুঃখ করে কী করবেন। দুর্ঘটনার ওপর তো কারও হাত নেই। অর্থাৎ দুর্ঘটনা একটি আকস্মিক বিষয়। দৈবাৎ ঘটে গেছে। আর এখনকার বাস্তবতায় দুর্ঘটনা- বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনা আকস্মিক বিষয় নয়, অনিবার্য বিষয় এবং অপ্রতিহত। তাই প্রতিদিন টিভি চ্যানেলগুলোর স্ক্রলে সবচেয়ে বড় জায়গাজুড়ে থাকে সারা দেশের সড়ক দুর্ঘটনা আর জীবনহানির খবর।
অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাংলাদেশ সরকারের সাফল্যকে উজ্জ্বল করেছে। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে বিশ্বকে বিস্মিত করেছে বাংলাদেশ। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ বা হ্রাস করতে সাধারণের চোখে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। রাস্তায় বেরোলে কতগুলো দৃশ্য অবধারিতভাবে চোখে পড়বে। লেগুনা বা টেম্পোজাতীয় যানে গোফ না গজানো বালক ড্রাইভাররা বিনা প্রতিরোধে গাড়ি চালাচ্ছে।
ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকাটা এখন জরুরি কোনো বিষয় নয়। যাত্রী নেয়ার প্রতিযোগিতায় বাস-মিনিবাসগুলো আঁকাবাঁকা করে রেখে সড়কপথকে বিশৃঙ্খল করে রাখছে। ছাল-বাকলহীন ভাঙাচুরা গাড়িগুলো সদম্ভে চলছে রাজধানীর রাস্তাগুলোয়। সিংহভাগ ড্রাইভারের কাছে সঠিক ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। গাড়ির বাহ্যিক চেহারা দেখে বলাই যায় এসবের ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকার কারণ নেই। শহর এলাকা পেরোলেই দেখা যাবে আরেকটি অরাজকতা।
ধরি, আশুলিয়ার দিকে যাচ্ছেন বিলের ওপর রাস্তা দিয়ে। দীর্ঘ জ্যাম পড়ে গেল। কারণ কিছুই না। নির্দিষ্ট লেন মানছেন না ড্রাইভাররা। এদেশের ড্রাইভার এবং অনেক সময় বাসযাত্রীরাও সামান্য ধৈর্য ধরতে পারেন না। উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির লেনের তোয়াক্কা না করে ফাঁকা পেলেই গাড়ি ঢুকিয়ে দেন। ফলে উভয়পক্ষের গাড়ি স্থবির হয়ে যায়। সড়কে ডিভাইডার থাকলেও রক্ষা নেই।
একদিকে জ্যাম পড়ে সড়ক স্থবির হলে ড্রাইভাররা ধৈর্য ধারণ করতে পারেন না। উল্টো পথে গাড়ি ঢুকিয়ে দেন। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে আমিনবাজার থেকে বলিয়ারপুর পর্যন্ত সন্ধ্যা বা রাতে এমন দৃশ্য প্রায় প্রতিদিনের। বিস্মিত হতে হয় এই উল্টো পথে আসা গাড়ির মধ্যে প্রায়ই পুলিশের গাড়িও দেখতে পাই। তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা আসবে কেমন করে? ড্রাইভারদের বিবেক আর ট্রাফিক আইনের প্রতি সবার শ্রদ্ধা থাকলে তো কোনো কথাই ছিল না।
সড়ক শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব পালন প্রসঙ্গটিও এসে যায়। এত বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এক্ষেত্রে পুলিশের অসহায় আত্মসমর্পণই বাস্তবতা। জানি না এ প্রসঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী কী জবানবন্দি উপস্থাপিত হবে। অথচ অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি (বিশেষ করে জরুরি অবস্থার সময়) রাস্তার দু’পাশে দু’জন সামরিক বাহিনীর সদস্য দাঁড়ালেই সুশৃঙ্খলভাবে যার যার লেনে ড্রাইভাররা গাড়ি চালাতেন। অন্যথা হলে শাস্তি ভোগ করতে হতো। তখন শ্রমিক নেতা কাম-মন্ত্রী এবং বাস মালিক সমিতির নেতা কাম-মন্ত্রীরা অবৈধ ড্রাইভারদের পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়াতেন না।
একই ড্রাইভার সব সময় অস্থির থাকেন তেমন নয়। যে বাস-মিনিবাসের ড্রাইভার গুলিস্তান থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত আসতে কোনো ট্রাফিক আইনের প্রতি তোয়াক্কা করেননি, অবৈধ ওভারটেক করে যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতা করেছেন, গাড়ি আঁকাবাঁকা করে প্রতিবন্ধক তৈরি করেছেন; ওভার স্পিড দিয়ে অনর্থ বাধাচ্ছেন- সেই ড্রাইভারই তার বাস নিয়ে জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে ঢুকে সেনানিবাস এলাকায় গিয়ে আমূল পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছেন। সুশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন। ট্রাফিক আইন মানায় নিবেদিত যেন। এতে বোঝা গেল সুবচনে কাজ হবে না। সাধারণ দায়িত্বে সজাগ না থাকলে শাস্তির বিকল্প নেই। কিন্তু অন্যায় করে শাস্তি যদি বিকিকিনি হয়, তখন আর পরোয়া কিসে!
পুলিশ কর্তারা স্বীকার করুন বা না করুন, সড়কে শৃঙ্খলা বিধানের নৈতিক শক্তি এখন তাদের হাতে খুব একটা নেই। আন্তঃজেলা ট্রাক যখন মাল পরিবহন করে, তখন ড্রাইভার বা মালিকের প্রতি ট্রিপের খরচের হিসাবে দেখা যাবে ‘পুলিশ খরচ’ বলে একটি হিসাব রাখতেই হচ্ছে। অনেক আগে অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখেছিলাম ট্রাক থেকে পুলিশ মাসোয়ারা নেয় টোকেন সিস্টেমের মাধ্যমে। গাবতলীর গাড়ি পার্কিংয়ের অরাজকতা নিয়ে অতীতে অনেকবার লিখেছি।
তাৎক্ষণিক ফল ফলতেও দেখা যেত। আমরা পরীক্ষিতভাবে দেখিয়েছিলাম গাবতলী থেকে উত্তরে যেতেই দীর্ঘ জ্যামের অন্যতম দুটি কারণের একটি দুই-তিন লাইনে গাড়ি পার্ক করে রাস্তা সংকুচিত করে ফেলা। দ্বিতীয়টি দূরপাল্লার গাড়িগুলো মাজার রোডের সামনের সিগন্যাল দিয়ে ইউটার্ন নিয়ে টার্মিনালের দিকে যাওয়া। অনেক লেখালেখির পর এই ইউটার্ন বন্ধ হল। বাস এখন বাঙলা কলেজের দিকে ঘুরে টেকনিক্যাল দিয়ে গাবতলীর দিকে আসবে।
এ পদ্ধতিতে সুফলও পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন আবার সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক বাস অত কষ্ট না করে মাজার রোডের সিগন্যাল দিয়েই ইউটার্ন নেয়। শুধু মোড় ঘোরার সময় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের হাতে কিছু গুঁজে দেয়। হয়তো দেখা যাবে কয়েকশ’ গজ দূরে রাস্তার পাশে মোটরসাইকেলের গায়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট। আড়চোখে দেখে নিচ্ছেন। এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, সন্ধ্যায় নাকি সারা দিনের হিসাব হয়। দিনের আয় ভাগাভাগি হয়ে যায় নানা পর্যায়ে।
কতগুলো মর্মস্পর্শী দুর্ঘটনা ঘটে গেল রাজধানীর সড়কগুলোয়। দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় রাজীব প্রথমে হাত হারাল, পরে জীবনের কাছে পরাজয় মানল। প্রাণ হারাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। গৃহবধূ পা হারালেন। হানিফ ফ্লাইওভারে প্রতিবাদকারী প্রাইভেট কারের ড্রাইভারকে পিষে মারল বাস ড্রাইভার।
সবশেষে (প্রার্থনা করি লেখাটি প্রকাশের আগ পর্যন্ত এটিই ‘সর্বশেষ’ হোক) ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপন কর্মকর্তাকে এই হানিফ ফ্লাইওভারেই বেআইনি প্রতিযোগিতায় নামা বাস মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দিয়ে চাকায় পিষে মারল।
গভীর কষ্ট আর আতঙ্কে এমনি অনেক দুর্ঘটনার মিছিল দেখতে হচ্ছে এখন। কিন্তু এতে ড্রাইভারদের মধ্যে কোনো ভাবান্তর আসছে না। ৯ মে’র একটি উদাহরণ দিই। সপরিবারে যাচ্ছিলাম মিরপুর। আমাদের গাড়ি সনি সিনেমা হলের কাছে এলো দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে। সামনে দেখলাম ট্রান্স সিলভা নামের একটি বাস একপাশে থামিয়ে যাত্রী নামাচ্ছে।
রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই। হঠাৎ পেছন থেকে বাহন পরিবহনের একটি বাস (১১-৩৫৬৮) শাঁ করে এসে ট্রান্স সিলভার গা ঘেঁষে লুকিংগ্লাস ভেঙে দিয়ে এগিয়ে গেল। আমার ড্রাইভার বলল, পথে এদের মধ্যে হয়তো ঝগড়া হয়েছে। এখন শাস্তি দিল। ওর ধারণা এবার প্রতিশোধ নেবে ট্রান্স সিলভা। কথা শেষ হল না; সামনের সিগন্যালে বাহন দাঁড়ানো। শাঁ শাঁ করে এগিয়ে এলো ট্রান্স সিলভা। একটি হালকা গুঁতো বসিয়ে দিল বাহনের পেছনে। যাত্রীরা চেঁচিয়ে উঠল। তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই ড্রাইভারদের। কে নিয়ন্ত্রণ করবে এদের?
উন্নত বিশ্বের কথা ছেড়ে দেই। আমাদের প্রতিবেশী দেশ কলকাতা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কথাই বলি। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লে লম্বা গাড়ির সারি চোখে পড়ে। পাশের লেনটি একবারে ফাঁকা। কোনো চালক চিন্তাই করেন না এই ফাঁকা লেন দিয়ে এগিয়ে যেতে।
১৯৯০ সালের কথা। তখনও মেট্রো রেল চালু হয়নি। আলীপুর থেকে একটি বাসে যাচ্ছিলাম যাদবপুর। আলীপুর জেলখানা পেরোতে এক বৃদ্ধ যাত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন। তিনি নামতে ভুলে গেছেন। সামনের স্টপেজ অনেকটা দূরে। সবার অনুরোধে রাস্তার পাশে গাড়ি থামালেন ড্রাইভার। কোথা থেকে ভোজবাজির মতো ট্রাফিক সার্জেন্ট এসে তার মোটরবাইক দাঁড় করালেন। কোনো কথা খরচ করলেন না।
পঞ্চাশ টাকা জরিমানার কাগজ ধরিয়ে দিয়ে লাইসেন্স নিয়ে চলে গেলেন। সে সময়ই দেখেছি কত কঠোরভাবে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করা হতো। ইউরোপের অনেক দেশেই দেখেছি রাত ৩টায় জন ও যান-বিরল রাস্তায় সিগন্যালে লাল আলো জ্বললে গাড়ি থামিয়ে বসে থাকেন ড্রাইভার। ফাঁকা রাস্তায়ও নির্ধারিত গতির বেশি গাড়ি চালান না। এটি শুধু নিয়ম মানার অভ্যাসের কারণেই নয়। সেখানে সবাই নিয়ম মানতে বাধ্য। কারণ ক্যামেরায় সব ধরা পড়ছে।
নিয়মিত গাড়ির (অথবা ড্রাইভারের) অ্যাকাউন্ট থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জরিমানার টাকা আদায় হয়ে যায়। এদেশে রাস্তা পারাপারের সময় অনেক পথচারী দুর্ঘটনার শিকার হন। যেখানে ওভারব্রিজের সুযোগ আছে সেখানে অনেকে তা ব্যবহার করেন না। এটি অবশ্যই পথচারীর অন্যায়। স্পেন, ফ্রান্স, ব্রাসেলস কোথাও রাস্তার ওপর ফুটওভারব্রিজ চোখে পড়েনি। গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পথচারীর পারাপারের জন্য জেব্রাক্রসিং আছে।
রাস্তার দু’পাশে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি। সিগন্যালের লালবাতি জ্বললে পথচারী না থাকলেও গাড়ি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। আর সবুজবাতি থাকলেও জেব্রাক্রসিংয়ের কাছে সব গাড়ির গতি কমে যায়। লালবাতি জ্বলার আগেই ভুল করে কোনো পথচারী যদি জেব্রাক্রসিং পার হতে যায়, সেখানেও নিন্দা না করে পথচারীর অধিকারকে আগে বিবেচনা করে। গাড়ি থামিয়ে তার পার হওয়ায় সহযোগিতা করে।
আমাদের দেশে পথচারী, গাড়ির ড্রাইভার আর সড়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের কারও মধ্যে আইন মানার প্রবণতা নেই। ট্রাফিক আইন থাকলেও এর তেমন প্রয়োগ নেই। লেনদেনের মাধ্যমে আইনকে ঘুরিয়ে দেয়ার সহজ সুযোগ আছে।
এখন যে বাস্তবতা বিরাজ করছে তাতে সরকারের কোনো সংস্থার কী ক্ষমতা আছে অপরাধকারী যানবাহন কর্মীদের শাস্তি দেয়ার? একটি সঙ্গত গ্রেফতার হলেই পরিবহন শ্রমিক-মালিক ইউনিয়ন অচল করে দিতে পারে সড়ক-মহাসড়ক। এদের পেছনে ক্ষমতাধরদের নির্ভরতার পরশ আছে- অতীতে তার অনেক নজির আমরা পেয়েছি। সাধারণ মানুষ ও যাত্রী সাধারণকে রক্ষা করার জন্য এমন নির্ভরতার হাত কি পাওয়া যাবে না? সরকার কি দায়িত্ব নিয়ে এই নির্মম বাস্তবতা থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে পারবে?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ