বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সব নোবেলই নোবেল নয়

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী: বাঙাল আবেগপ্রবণ জাতি। অল্পতেই আপ্লুত হয়ে পড়ে। সামান্যতেই গদগদ হয়। যেটা নয়, সেটাও হয়ে বসে। অর্থাৎ বাড়াবাড়ি করে। বাড়িয়ে কেউ বললে তা টপ করে লুফে নিতে পছন্দ করে। এটা একটা ‘গুণ’ বটে। তবে ‘সদগুণ’ বলা যায় কি?

বাঙাল অবশ্য বুদ্ধির কাঙাল নয়। কৌশল করে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে। জাহির করে। এটাও একটা ভালো গুণ। বৈশিষ্ট্য। তবে যা নয় তা বলা বা নিজেকে দাবি করা প্রতারণার মধ্যে পড়ে নিশ্চয়ই। অন্যের চোখে ধুলো দেবার কাজটা ভালোতো নয়ই, বরং অপরাধ বলে বিবেচ্য। যেমন: রিক্সব্যাংক পুরস্কারকে নোবেল পুরস্কার বলে চালিয়ে দেয়া। অর্থাৎ সম্প্রতি অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি ও তাঁর স্ত্রী প্রায় নোবেলের মতোই একটা পুরস্কার জিতেছেন। এর অর্থমূল্যও নোবেলের মতো। তবে সেটা নোবেল পুরস্কার নয়। অথচ পার্থক্যটা স্পষ্ট করা হচ্ছে না। হয়নি এদ্দিনেও। 

সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা শান্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনুস যে নোবেল পেয়েছিলেন সেই নোবেল এটা নয়। রিক্সব্যাংক পুরস্কার এবং নোবেল পুরস্কারের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এ ফারাকটা সাধারণ মানুষকে বুঝতে না দেবার জন্য যে চাতুরী সেটা নিয়েই আমার আজকের এ লেখার অবতারণা। 

‘অর্থনীতিতে নোবেল’ বলে প্রকৃত অর্থে কোনও পুরস্কার নেই। যখন বলা হয় অমুক ‘অর্থনীতিতে নোবেল’ পেয়েছেন তখন ভুল বলা হয়। পুরস্কারটির অফিসিয়াল নাম ‘দ্য সুইডিশ রিক্সব্যাংকস প্রাইজ ইন ইকোনোমিক সায়েন্স ইন মেমোরি অব আলফ্রেড নোবেল’। বাংলাতে বলতে হবে ‘আলফ্রেড নোবেল স্মরণে অর্থনীতিবিজ্ঞানে সুইডিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকপুরস্কার’। নিজের নামে পুরস্কার প্রদান সংক্রান্ত যে উইল ১৮৯৫ সালে লিখে গিয়েছিলেন আলফ্রেড নোবেল, সেখানে অর্থনীতির উল্লেখ ছিল না। অর্থাৎ এ বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেয়া হতো না। অনেক পরে সুইডেনের জাতীয় ব্যাংকের ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৬৮ সালে এ পুরস্কারটির প্রবর্তন করেছিল ব্যাংকটি। প্রথমবার এ পুরস্কার দেয়া হয় ১৯৬৯ সালে। অন্যদিকে পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য এবং শান্তি; এ পাঁচটি ক্যাটাগরিতে নোবেল দেয়া হচ্ছে ১৯০১ সাল থেকে। আলফ্রেড নোবেল শুধু এ পাঁচটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদানের জন্য উইল করে গিয়েছিলেন। 

পরবর্তীতে রিক্সব্যাংকের সঙ্গে নোবেল একাডেমি একটি চুক্তি করে। পুরস্কারটির সঙ্গে ‘আলফ্রেড নোবেল স্মরণে’ কথাগুলো জুড়ে দেয়া হয়। বলা হয়, অক্টোবরের ‘নোবেল সপ্তাহে’র শেষপুরস্কার হিসেবে এ পুরস্কারটির প্রাপকের নাম ঘোষণা করা হবে। চুক্তিতে এটাও অন্তর্ভুক্ত ছিল যে, নোবেল কর্তৃপক্ষ নয় বরং পুরস্কারটির অর্থ ব্যাংকটিকেই বহন করে যেতে হবে। তবে এর অর্থমূল্য হতে হবে নোবেল পুরস্কারের সমান। এভাবেই সুইডিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরস্কারটি নোবেলের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়। 

উল্লেখ্য, সুইডিশ সরকার, নোবেল কমিটি, মিডিয়া বা অন্য কেউ কখনও এ পুরস্কারটিকে ‘নোবেল পুরস্কার’ বলে না। তবে নোবেল পুরস্কার না হলেও এটিকে অর্থবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার বলে গণ্য করা হয়। ‘নোবেল স্মরণে’ সংযুক্ত হবার পর অর্থমূল্য বা গুরুত্বের দিক থেকে সমপর্যায়ের হলেও  ‘নোবেল পুরস্কার’ বলা বারণ। এমনকি অর্থমূল্যে এটি বেশি হলেও। কেউ বললে সেটা হবে ভুল। বিভ্রান্তিকর। এছাড়া মূল ‘নোবেল পুরস্কার’ ব্যতীত অন্যকিছুকে ‘নোবেল পুরস্কার’ বলে উল্লেখ করলে আলফ্রেড নোবেলকে অসম্মান করা হয়। হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। অথচ আমরা সবাই এ ভুলটি অবলীলায় করে যাচ্ছি। 

খেয়াল করে দেখুন, পুরস্কারটির ঘোষণা, প্রেস রিলিজ, ওয়েব সাইট, পাশ্চাত্য মিডিয়া, সনদপত্র বা মেডেলের কোথাও ‘অর্থনীতিতে নোবেল’ এমন কথার উল্লেখ নেই। 

এর আগে বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও পেয়েছিলেন ‘নোবেল স্মরণে রিক্সব্যাংক পুরস্কার’, নোবেল পুরস্কার নয়। নোবেল পুরস্কার দেয়া শুরু হয় ১৯০১ সাল থেকে। সুইডিশ রিক্সব্যাংক পুরস্কার দেয়া শুরু ১৯৬৯ সাল থেকে। ব্যবধান ৬৯ বছরের। প্রথমটা দেয় নোবেল কমিটি। দ্বিতীয়টা দেয় সুইডিশ রিক্সব্যাংক। অর্থের যোগানও দেয় দুটো কর্তৃপক্ষ। কাজেই দুই পুরস্কারকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলবার সুযোগ নেই। সেই সুইডিশ রিক্সব্যাংক পুরস্কার এবার পেলেন আরেক বাঙালি অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি। তিনি পুরস্কারটি তাঁর ফরাসি স্ত্রী এস্থার ডুফলোর সঙ্গে ভাগাভাগি করে পেয়েছেন। অবশ্য ডুফলোর নাম গত বছরও শর্টলিস্টে ছিল। এবার একই পুরস্কারের আরেক জন অংশীদার আছেন। তিনি হলেন আমেরিকার অর্থনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক মাইকেল রবার্ট ক্রেমার। পুরস্কারের অর্থ সমানভাবে ৩ জনেরই প্রাপ্য।

বিষয়টি পরিষ্কার করবার জন্য একটা উদাহরণ দিতে চাই, সেটা হচ্ছে: আমাদের কবি, সাহিত্যিকদের অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয়। আবার কোনও কোনও ব্যাংকও কবি ও সাহিত্যিকদের পুরস্কার দিয়ে থাকে। বাংলা একাডেমির দেয়া এবং কোনও ব্যাংকের দেয়া পুরস্কার কি একই মর্যাদার? নিশ্চয়ই না। দুই পুরস্কারের গুরুত্ব এবং মর্যাদা দুইরকম। ঠিক তেমনই নোবেল কমিটি বা ফাউন্ডেশনের দেয়া এবং সুইডিশ রিক্সব্যাংকের দেয়া পুরস্কারের ফারাক অনেক। মান এবং মর্যাদাও ভিন্ন। অর্থমান সমান হলেও গুণমান বা স্ট্যাটাস সমান বা এক নয় কখনই। অথচ আমরা দুই পুরস্কারকে এক মাপে ফেলে দেই। এমনকি পুরস্কারপ্রাপকরাও তেমনই ভাবেন। বলেনও। দুঃখজনক হচ্ছে, অমর্ত্য সেন নিজেও ফারাকটা উল্লেখ করেননি বা কাউকে বুঝতে দিতে চাননি। বলা যায়, চেপেই গেছেন।

এটা স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, গীতাঞ্জলির জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন আর অমর্ত্য সেন যেটা পেয়েছেন দুটো এক পুরস্কার নয়। অমর্ত্য সেন কিংবা অভিজিৎ ব্যানার্জিদের খাটো করতে বিষয়টি উল্লেখ করছি না। শুধু ফারাকটা বোঝাতে চাচ্ছি। 

বিষয়টা সাংবাদিকদের কেউ বোঝেন না তেমনটা হয়তো নয়। বোঝেন। কিন্তু রহস্যটা কেন জানি চেপে যান অনায়াসেই। গোলটা এখানেই। এ প্রবণতা শুধু আমাদের না, অন্যদেরও। আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক উভয় মিডিয়ার কেউই বিষয়টা খোলাসা করেননি। ব্যতিক্রম দেখলাম একজনকে। তিনি হলেন স্টকহোম প্রবাসী আমাদের বাঙাল কবি শাকিল রিয়াজ। সম্ভবত নোবেল এবং রিক্সব্যাংক পুরস্কারের মধ্যকার বিরাট ফারাকটা তিনিই স্পষ্ট করেছেন। তাই ধন্যবাদ জানাই কবি শাকিলকে। 

উল্লেখ্য পুরস্কার দুটো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা সবার উচিত। যারা কম শিক্ষিত এবং নোবেল পুরস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মগজে ধারণ করতে অক্ষম তাঁদের কথা বাদই থাক। কিন্তু যারা শিক্ষিত এবং বিশ্ব সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন এবং নোবেল পুরস্কার, আলফ্রেড নোবেল ইত্যাদির খবর রাখেন তাঁদের কাছে নোবেল পুরস্কার ও রিক্সব্যাংক পুরস্কারের পার্থক্য এবং মর্যাদা সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারণা থাকা আসলেই জরুরি। আর যারা রিক্সব্যাংক পুরস্কার পেয়ে নিজেদের আসল নোবেলজয়ী বলে জাহির করেন বা ফারাকটা চেপে যান, তাঁদেরও এতোটা হীনমন্যতায় ভুগবার কোনও কারণ নেই। আর মনে রাখতে হবে, ‘নোবেল’ বললেই নোবেল হয় না। সব নোবেলই নোবেল নয়। এরও গুমর আছে। ফাঁক ও ফাঁকি আছে।

আলোচ্য রিক্সব্যাংক পুরস্কার জেতার জন্য অভিজিৎ-ডুফলো দম্পতি এবং মাইকেল ক্রেমারকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। বেস্ট অব লাক।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ