শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ক্যাসিনো, মদ, জুয়া ও অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন

মোঃ মাঈন উদ্দীন : অর্থনৈতিক উন্নতির কথা আমরা বার বর শুনছি। শুনছি জিডিপির প্রবৃদ্ধির কথাও। সম্প্রতি এশিয়ার অর্থনীতি নিয়ে প্রকাশিত ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক ২০১৯ আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে চলতি অর্থবছরে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশের। জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮ শতাংশ। ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি  নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে থাকবে ভারত। ভাল ফলন ও বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম কম থাকায় বাংলাদেশে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে মুদ্রাস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে থাকবে।
এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশকে এশীয় অঞ্চলের সর্বাধিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির দেশ হিসাবে যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে তা আমাদের জন্য আশাজাগানিয়া ঘটনা। কিন্তু শুধু জিডিপির আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি দিয়ে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্র বুঝা যায় না। দেশে বর্তমানে ২২ শতাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে। তবে এটা গড় হিসাবে। কিছু কিছু জেলায় এ হার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। অর্থনীতিবিদ, গবেষকদের বক্তব্য ও পত্রপত্রিকায় যে বিষয়টি বার বার উঠে আসছে তা হলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট বৈষম্য বিরাজ করছে। এখানে গরীব দিন দিন গরীব হচ্ছে। ধনীরা হচ্ছে আরও ধনী। সরকারের উচ্চমহল থেকে তাদের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের নানা দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ, বিদেশে অর্থ পাচারসহ জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসা সহ নানা অবৈধ কর্মকা-ে জড়িতের খবর কারো অজানা নয়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে ঢাকা মহানগরীর ক্লাব গুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। ইতিমধ্যে মতিঝিলের ইয়ংমেন্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র, ওয়াল্ডারার্স ও বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাব, কলাবাগান ক্রীড়া চক্র, ধানমন্ডি ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবে অভিযান চালানো হয়েছে। ওইসব ক্লাব থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাসিনো বোর্ডসহ জুয়া খেলার বিপুল পরিমাণ সামগ্রী, নগদ টাকা, অস্ত্র ও মদ-বিয়ার জব্দ করেছে। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে দৈনিক কালের কন্ঠে ছাপা হয় যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় সাত ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রকের নাম। তারা হল- ঢাকা মহানগরী যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী স¤্রাট, সহসভাপতি- এনামুল হক আরমান, সহসভাপতি- সোহরাব হোসেন স্বপন, সহসভাপতি- সারোয়ার হোসেন মনা, যুগ্ম সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূইয়া ও নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন। যুবলীগ নেতা পরিচয় দানকারী- জি কে শামীমকে নিকেতনের তার অফিস থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর রিসিপ্টসহ আটক করা হয়। মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূইয়া যিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও (বিসিবি) পরিচালক ক্যাসিনো চালানোর জন্য ক্লাবের জায়গা ভাড়া দেন এবং র‌্যাব বলেছে, ক্যাসিনো থেকে লোকমান গত দু’ বছরে ৪১ কোটি টাকা কামিয়েছে, আর এ টাকার পুরোটাই জমা করেছে অষ্ট্রেলিয়ার এএনজেড ও কমনওয়েলথ ব্যাংকে। তেজগাঁওয়ের ফুওয়াং ক্লাবে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশী মদ, সিগারেট ও নগদ সাত লক্ষ টাকা উদ্ধার করে। ঢাকার আওয়ামী লীগের সহোদর দুই নেতার বাসা থেকে ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও অস্ত্র জব্দ করেছে র‌্যাব, ঢাকার ওয়ারীর লালমোহন সাহা লেনের ৮৩/১ নম্বর- বাড়ি থেকে ২ কোটি টাকা, অস্ত্র ও গুলি জব্দের ঘটনায়। আওয়ামী লীগের গেন্ডারিয়া থানার সহসভাপতি এনামুল হক অনুর কর্মচারী আবুল কালাম রহমানকে আসামী করা হয় (বাংলাদেশ প্রতিদিন- ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। শুধু ঢাকা শহরে নয় সাড়া দেশে এ রকম হাজারো রকমের ঘটনায় কোটি কোটি অবৈধ টাকা, মদ, জুয়ার আসর ছড়িয়ে আছে যা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অজানা নয়। দলীয় গডফাদাররা রাজনৈতিক অঙ্গন দখল করে অর্থনৈতিকভাবে দেশকে দেউলিয়া করে ফেলেছে। অথচ দেশের ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বেকারত্বের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। কৃষি ও শিল্প খাতে কর্মস্থানের হার হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষিত যুব সমাজের কর্মসংস্থানের হার অশিক্ষিত সম্প্রদায়ের তুলানায় কম। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক সাম্প্রতিককালে অনুমিত জ্ঞানের সূচকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থা সর্বনি¤েœ। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজ ও সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। লুটপাট, খুন, ধর্ষণ, মদ, জুয়া, ক্যাসিনো, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতা সারাদেশে এভাবে নির্বিঘেœ চলতে থাকলে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক ও জাতীয় নিরাপত্তায় বড় ধরনের ফাটল দেখা দিবে। রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা যদি পাবলিক পারসেপশান না বুঝেন তা হলে তাদের জনপ্রিয়তা যেমন শূন্যে পৌঁছবে তেমনি দেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়বে। দীর্ঘদিন থেকে শেয়ার বাজারে মন্দা, ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, বিনিয়োগে স্থবিরতা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাসহ বেশীরভাগ ব্যবসায়ে মন্দাভাব অথচ কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে বাসা ও ফ্ল্যাট বাড়িতে জমা রয়েছে চাঁদাবাজদের কোটি কোটি টাকা ও স্বর্ণমুদ্রা। প্রতিটি সেক্টরে ঘুষ, দুর্নীতিতে সয়লাবের কারণে অর্থনীতি দুর্বৃত্তায়নের কবলে নিমজ্জিত।
পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায়, তাদের ছত্রছায়ায় মদ, জুয়া, ক্যাসিনো ব্যবসা দীর্ঘদিন থেকে চলছে। রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা বিশেষ করে শাসক দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নানা অনিয়ম ও অপকর্ম টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, বাস, লঞ্চ, টেম্পু টার্মিনালে ও হাট বাজার দখল ও অবৈধ চাঁদা আদায়ে তাদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠন এবং অন্যান্যের বিরুদ্ধে যে শুদ্ধি অভিযান চলছে, তা যেন মাঝ পথে থেমে না যায়। শুধু রাজধানী নয় সারা দেশে যেন এ শুদ্ধি অভিযান চালানো হয় এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দৃঢ় মনোভাব ও কার্যকর পদক্ষেপই অর্থনীতিকে দুবৃর্ত্তায়ন থেকে রক্ষা করতে পারে এবং প্রধানমন্ত্রী যদি এতে সফল হন তাহলে তার প্রতি আস্থা আরও বাড়বে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক
ই-মেইলঃ [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ