সাকিবের বিকল্প তৈরি হবে তো?
মাহাথির মোহাম্মদ কৌশিক : সাকিব আল হাসানকে অনেক বছর ধরেই বিশে^র সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। মাঠে এর প্রমাণও রেখেছেন তিনি। এখন লম্বা সময়ের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হয়েছেন তিনি। আগামী এক বছর ঘরোয়া কিংবা আন্তর্জাতিক কোন ম্যাচেই মাঠে নামা হবেনা তার। এই সময়ে বাংলাদেশ যে ম্যাচগুলো খেলবে তাতে নিশ্চিত করেই মিস করবেন এই তারকাকে। কিন্তু এক সাকিবের উপর ভরসা আর কতদিন। ভবিষ্যতের সাকিবকে খুঁজতে অনেক আগেই তাগাদা দেওয়া হলেও কোন কাজ হয়নি। দেখা গেছে কোন সিরিজে তাকে না পাওয়া গেলে ৪/৫ জনকে রাখা হয়েছে রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে। ব্যতিক্রম হয়নি এবারের ভারত সফরেও।
সব রকম ক্রিকেট থেকে এক বছর নিষিদ্ধ হয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশকে এক বছর কাটাতে হবে সাকিব ছাড়াই। এ নিয়ে ভক্তদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। বাংলাদেশ জাতীয় দল যেমন তেমন বিপাকে আইপিএলের দল সানরাইজার্স হায়দরাবাদও। এই দলের নির্ভরযোগ্য তারকা সাকিব। নিষিদ্ধ থাকায় তিনি আইপিএল খেলতে পারবেন না। সাকিবের শূন্যস্থান কিভাবে পূরণ করা যায় তা নিয়ে এখুনি কাজ শুরু করেছে হায়দরাবাদ টিম ম্যানেজমেন্ট। ব্যাটিং-বোলিং, যিনি দুটোতেই সেরা সেখানে সাকিবের বিকল্প খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়। পাঁচজন ক্রিকেটারের কথা তারা ভাবছেন। পারফরম্যান্স যাচাই করে এ পাঁচজনকেই তারা সাকিবের বিকল্প মনে করছেন। কথা হচ্ছে দলে তো নেওয়া হবে একজনকে। বাংলাদেশের মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, দক্ষিণ আফ্রিকার যোজেস হেনরি, ইংল্যান্ডের ক্রিস ওকস, নিউজিল্যান্ডের জেমস নিশাম ও অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। সাকিব নিষিদ্ধ হওয়ায় রীতিমতো চাপে পড়ে গেছে সানরাইজার্স।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত শীর্ষ দৈনিক আনন্দবাজার উলেখ করেছে সাকিব কেন বিশ্বসেরা এতেই উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। তার অভাব পূরণ করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। এটি যেমন বাংলাদেশের জন্য আনন্দদায়ক খবর ঠিক তেমনি আবার কিছুটা হলেও কষ্টেরও। ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্মকর্তা, প্রত্যেকের মুখেই শোনা গেছে যে সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে করণীয় আছে সামান্যই। তবু কোনোভাবে কিছু করার আছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখছে দেশের সর্বোচ্চ ক্রিকেট প্রশাসন। বিসিবি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সুজন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন তেমনটাই। যদিও সবার আগে নিজেদের সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও আরেকবার জানিয়ে রেখেছেন তিনি, ‘দেখুন, আপনারা জানেন এই বিষয়টিতে বিসিবির করণীয় খুবই সীমিত। যেহেতু সংশিষ্ট ক্রিকেটার স্বীকার করে একটি সমঝোতার মধ্যে চলে গেছেন।’ অভিযোগ স্বীকার করার পাশাপাশি সাকিব শাস্তিও মাথা পেতে নেওয়ায় এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ দুই বছর নিষিদ্ধ হওয়া এই অলরাউন্ডারের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করারও সুযোগ নেই কোনো। এই দুঃসময়ে সাকিবের পাশেই থাকা বিসিবি তবু কোনো একটি পথ খোলার চেষ্টা করে দেখতে চায়। কিভাবে? সংস্থার প্রধান নির্বাহী বলেছেন সেটিই, ‘তারপরও আমরা অবশ্যই দেখব যে আইনগত বিষয়গুলো নিয়ে কতটুকু কাজ করার সুযোগ আছে। আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে এটি নিয়ে কথা বলেছি। এই বিষয়টি নিয়ে কিভাবে এগোনো যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করব।’
তবে কাজ করলেও তাতে ফল বের করার মতো জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হবে কি না, সেই সংশয় তবু রয়ে যাচ্ছে। কারণ পরিষ্কার বলে দেওয়া আছে যে এই শাস্তির বিরুদ্ধে কোনো পক্ষই আপিল করতে পারবে না। নিষেধাজ্ঞার প্রথম বছরে নতুন করে আর আইন না ভাঙলে পরের বছরের শাস্তি মাফ হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ২০২০ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে মাঠেও ফিরতে পারবেন তিনি। খেলতে পারবেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও। কিন্তু একই বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সামনে রেখে সাকিবের শাস্তি কমিয়ে আরো আগেই শেষ করার সম্ভাবনা আসলে কতটুকু? আইসিসির রায়ে অবশ্য সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই। তাই বলে এমনও নয় যে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার নজির বিশ্বেই নেই। তবে সেগুলো ঘটেছে দীর্ঘমেয়াদি নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেই। পাকিস্তানের মোহাম্মদ আমিরের কথাই ধরা যাক। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার ছয় মাস আগেই মাঠে ফিরতে পেরেছিলেন তিনি। তবে তাঁকে শুধুই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রিকেট খেলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। একই সুযোগ পেয়েছিলেন বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুলও। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেও এঁরা কেউই তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার অনুমোদন পাননি। শুধুমাত্র ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রিকেটে ফেরার ছাড়পত্র পেয়েছিলেন। আশরাফুলের ক্ষেত্রে যেমন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। যেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেই (বিপিএল) ফিক্সিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল। সাকিবের বিরুদ্ধেও আছে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সময় (২০১৮’র আইপিএল) জুয়াড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ। সুতরাং আন্তর্জাতিক বা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট নয়, বড়জোর ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রিকেটেই ফেরার সুযোগ মিলতে পারে তাঁর। সেটিও মিলবে কি না, সময়ের হাতেই তোলা আছে এর উত্তর।
এই সময়টাতে আবার নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল। একবার ভেবেছিলেন, পরিবারের কাছে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাবেন। নির্বাসনের লম্বা একটা সময় সেখানেই থাকবেন; কিন্তু আপাতত সেই সিদ্ধান্ত বদলেছেন সাকিব আল হাসান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় এসেছেন। আপাতত তাই দেশেই থাকছেন সাকিব। বিসিবি থেকেও চেষ্টা করা হচ্ছে সাকিবের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ কোনোভাবে কমিয়ে আনা যায় কি-না। ব্যাপারটি নিয়ে বিসিবি তাদের আইনজীবীর সঙ্গেও পরামর্শ করেছে। সেই সঙ্গে আইসিসির কাছেও জানতে চেয়েছে, নির্বাসনের সময় সাকিবকে সুনির্দিষ্ট কী ধরনের সুবিধা দিতে পারবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। সাকিবের ব্যাপারে আইসিসির পাঠানো ই-মেইল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করতেও কিছুটা সময় নিতে চায় বিসিবি এবং সেটা করার পরই আগামী বোর্ডসভায় সাকিবকে কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, সেটাও ঠিক করবে। আপাতত তাদের সামনে শাস্তি কমানোর একটি কেস স্টাডি রয়েছে, সেটা হলো পাকিস্তানের পেসার মোহাম্মদ আমির। যাকে পাঁচ বছরের শাস্তি ঘোষণার পর আইসিসি ছয় মাস আগেই মাঠে ফেরার অনুমতি দিয়েছিল। মোহাম্মদ আমির নির্বাসনের একটা সময় আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে অংশ নিয়ে ছয় মাস আগেই মাঠে ফেরার সুযোগ পেয়েছিলেন। সাকিবের জন্যও তেমন কোনো কার্যক্রম আয়োজন করা যায় কি-না, সেটা নিয়েও বিসিবি কর্মকর্তাদের একে অন্যের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা হয়েছে। তবে বোর্ড মিটিংয়ের আগে পূর্ণাঙ্গ কোনো সিদ্ধান্ত আসছে না বিসিবি থেকে। আইসিসির পাঠানো ই-মেইলে বলা হয়েছে, সাকিবের পরিচিত কেউ জুয়াড়ি দীপক আগরওয়ালকে বাংলাদেশি বেশ কিছু ক্রিকেটারের ফোন নম্বর দিয়েছিল। কিন্তু সেই ব্যক্তিটি কে? তার পরিচয় প্রকাশ করেনি আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ইউনিট (এসিইউ)।
বিসিবির পরবর্তী সভায় সেই ফোন নম্বর দেওয়া ব্যক্তিটির পরিচয় আইসিসির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চাওয়া যায় কি-না, তা নিয়েও নাকি কথা হবে। তবে আইসিসি সেই ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করবে কি-না তা নিয়েও সন্দেহ আছে। কেননা আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ইউনিট (এসিইউ) স্বাধীন একটি সংস্থা। তদন্তের স্বার্থে তারা অনেক কিছু আইসিসির কাছেও প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। তাই সাকিবের নির্বাসন কমিয়ে আনার ব্যাপারে আইসিসি কিংবা বিসিবির করণীয় আসলেই খুব সীমিত। তার পরও সরকারের উচ্চমহল থেকে বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপনকে বলা হয়েছে, যদি শাস্তি কমানোর ব্যাপারে সামান্যতম কোনো সুযোগও থাকে, তাহলেও যেন সেটা করা হয়।