শাহজাদপুরে খেয়াঘাটের মাঝিদের মানবেতর জীবন
এম,এ, জাফর লিটন, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) থেকে : সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় এক সময় চলাচলের মাধ্যম ছিল নৌকা। কৃষক তার নিত্য প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সারতে নৌকা করে যাতায়াত করতেন। নদী বেষ্টিত গ্রামগঞ্জে বিবাহ কাজে ব্যবহার হতো নৌকা। নৌকায় করে জামাই-মেয়ে নিয়ে আসাসহ বিবাহের কাজ সম্পন্ন করতে বরযাত্রী আসতো নৌকায় করে। শাহজাদপুর উপজেলার করতোয়া নদীর থানা ঘাট, মসজিদঘাট, বাদলবাড়ীঘাট, নরিনাঘাট, চর নরিনাঘাট, তালগাছী নবীপুরঘাট, বাতিয়াঘাট, জামিরতার গুদারাঘাট, দুগালীর আমতলীঘাট, আন্দারমানিকঘাট, আহম্মদপুর ঘাটগুলোতে থাকতো সারি সারি খেয়া নৌকা। করতোয়া, হুরাসাগর নদীর সুবিশাল বুক জুড়ে ছিল নৌকার অবাধ বিচরণ। স্থানে স্থানে নদীর থৈ থৈ রূপালি পানির ধারে ছিলো খেয়া পারাপারের মুখরতা। ঘাটে ঘাটে সারাক্ষণ ছিল বৈঠা ও পানির শব্দ। কিন্তু সেই দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। যান্ত্রিক সভ্যতার দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নৌকা ও নদী। ফুরিয়ে গেছে মাঝিদের সোনালি দিন। একসময় নদী পূর্বপাড়ের কয়েকলাখ মানুষের সঙ্গে নৌকার সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। নদী তীরের বাসিন্দাদের জীবনের জন্য ছিল নৌকার নিবিড় প্রয়োজন। হাটবাজার যাতায়াত থেকে শুরু করে বিয়ের অনুষ্ঠানেরও একমাত্র বাহন ছিল পালতোলা নৌকা। উন্নত সড়কপথ না থাকায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেও নৌকা ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় এসে সড়ক যোগাযোগের উন্নতি হওয়ায় ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের দখলে চলে যাচ্ছে সবকিছুই। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের ঐতিহ্য নানা নামের বাহারি নৌকা। নদীতে নৌকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন নৌকার সঙ্গে জড়িত মাঝি পরিবারের সদস্যরা।
করতোয়া, হুরাসাগর, বড়াল নদীর খেয়া ঘাটের মাঝিরা এখন তাদের আদি পেশা পাল্টিয়ে ফেলছেন। মাছ ধরা, গাছ কাটা, ধান কাটাসহ দৈনিক শ্রমিক হিসাবে বিভিন্ন বিকল্প পেশায় চলে যাচ্ছেন তারা। এক সময় করতোয়া ও হুরাসাগর নদীকে ঘিরেই হাজারো মানুষের জীবনজীবিকা চলতো। নদীর দুই পাড়ে অর্ধশত ঘাট ছিল। এসব ঘাট দিয়ে নৌকায় চড়ে পারাপার হত যাত্রীরা। এখন সেই দিন আর নেই। আশাশুনির দু’এক জায়গায় নৌ পারাপার এখনো কিছুটা সচল থাকলেও মাঝিরা পেশা পাল্টাচ্ছেন। অধিকাংশ নৌকার মাঝি পেশা পাল্টিয়ে নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
করতোয়াপাড়ের নগরডালা গ্রামের থানা ঘাটের মাঝি নাছির উদ্দিন (৫০) জানান, এখন এ এলাকায় খেয়া পারাপার নেই বললেই চলে। নদীর খেয়াঘাটের মাঝিদের এখন চরম দুর্দিন চলছে। ছোটবড় খেয়াঘাটসহ নদীতে নৌকা চলাতে না পারায় কয়েক শতাধিক মাঝি পরিবারে চলছে অভাব অনটন। কিছু ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মালামাল পরিবহনেও এখন তাদের ডাক পড়ে না। আগের মতো তাদের নৌকায় চড়ে কেউ আর নদী পারাপার হচ্ছে না। তবুও যাত্রীর আশায় কেউ কেউ নদীঘাটে অলস সময় পার করছেন।
চর নরিনা ঘাটের আব্দুল কুদ্দুস (৬০) বলেন, ৪০ বছর ধরে এই নদীতে নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপার করছি। যখন নদীর যৌবন ছিল নৌকায় করে মালামাল আনা নেয়া করতাম। কয়েকবার ঢাকায় গেছি মালামাল আনতে। এখন নৌকায় পার হয়ে কেউ মন চাইলে টাকা দেয় আবার কেউ কেউ না দিয়েও চলে যায়। নদীর নাব্যতা হারানোর নদী ছোট হয়ে গেছে এবং সর্বত্র ব্রিজ হওয়ায় নৌকার কদর কমে গেছে। অনেক স্থানে ব্রিজ হওয়ায় এখন আর তেমন নৌকার ভাড়া নেই। আয় উপার্জন আগের মতো আর হয় না। রুটির রুজির তাগিদে মাঝিরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রোদ বৃষ্টি ঝড়, ঝড়–তুফান উপেক্ষা করে নৌকা চালিয়ে যা উপার্জন করি তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তিন বেলা ঠিক মত খেতে পারি না। পরনে কাপড়ও সময় মত জোটে না। তাই মাঝিদের অনেকেই এ পেশায় অনেক বছর যাবত জড়িয়ে রয়েছেন। তাদের উপায় নেই জেনেও অনেকে এই পেশা ছাড়তে পারছেন না। জীবিকার তাগিদে অনেকে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। মাঝিদের মধ্যে অনেক পরিবার ভূমিহীন। তাছাড়া এদের কোনো ঋণেরও ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।