শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

করোনার প্রভাবে আগৈলঝাড়ায় কুঁচিয়া ব্যবসায় ধস বেকার হয়ে পড়েছে শতশত লোক

এস এম শামীম, আগৈলঝাড়া (বরিশাল): চীনে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় বরিশালের আগৈলঝাড়ায় উৎপাদিত কুঁচিয়া রফতানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কুঁচিয়া উৎপাদনে নিয়োজিত প্রান্তিক চাষিরা পথে বসার উপক্রম হয়েছে। কুঁচিয়া খামারে দেখা দিয়েছে মড়ক। ফলে আমদানি রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় কোটি কোটি টাকার ব্যাবসায়ীক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে উপজেলার কুঁচিয়া ব্যবসায়ীরা। কুঁচিয়া সংগ্রহকারী ও ব্যবসার সাথে জড়িত অন্তত চার শতাধিক পরিবার ব্যাংক ঋণ ও দাদন পরিশোধ নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। উপজেলার কুঁচিয়া ব্যবসায়ী অর্জুন মন্ডল, জহর মন্ডল, ভীম মন্ডল ও প্রদীপ বাড়ৈ জানান, উপজেলা থেকে আগে প্রতিমাসে অন্তত সাড়ে তিন কোটি টাকার কুঁচিয়া রপ্তানি হতো বিদেশে। বিশেষ করে রপ্তানির তালিকায় থাকা চীনেই রপ্তানি হতো ৯০শতাংশ কুঁচিয়া। বাকী ১০শতাংশ রপ্তানি করা হতো হংকং, তাইওয়ানসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে। ফলে এই ব্যবসার সাথে জড়িতরা ভাগ্য বদল করেছিল অনেক পরিবারই। চীনের নাগরিকদের দৈনন্দিক খাদ্য তালিকায় কুঁচিয়া ছিল অন্যতম একটি জনপ্রিয় খাদ্য। কিন্তু দেশটিতে সম্প্রতি করোনা ভাইরাস মারাত্মক আকারে বিস্তারের কারণে চলতি বছরের ২০জানুয়ারি থেকে চীনের সাথে কুঁচিয়া রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন আগৈলঝাড়া উপজেলার কুঁচিয়া সংগ্রহকারী, ব্যবসায়ী ও রপ্তানির কাজের সাথে জড়িত অন্তত চার শতাধিক পরিবার। ব্যবসায়ীরা জানান, তারা আগে মাছ এবং কচ্ছপের ব্যবসা করতেন। আবার অনেকে ছিলেন বেকার। ব্যবসার জন্য ঢাকা আসা-যাওয়ার সূত্র ধরে যোগাযোগ হয় ঢাকার উত্তরার টঙ্গীর কামারপাড়া ও নলভোগ এলাকার অর্কিড ট্রেডিং কর্পোরেশন, আঞ্জুম ইন্টারন্যাশনাল ও গাজী এন্টারপ্রাইজসহ অন্যান্য কুঁচিয়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সাথে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তাদের সংগ্রহ করা কুঁচিয়া বিদেশে রপ্তানি করে আসছিলেন তারা। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় কুঁচিয়া ব্যবসার সম্প্রসারনের জন্য স্থানীয় কুঁচিয়া ব্যবসায়ীদের দাদনে টাকা দিতেন। ওই সকল প্রতিষ্ঠান থেকে আগৈলঝাড়ার কুঁচিয়া ব্যবসায়ীরা পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত দাদনে (সুদে বা তাদের কাছে কুঁচিয়া বিক্রির শর্তে) গ্রহন করতেন। রপ্তানি কারকদের কাছে কুঁচিয়া বিক্রির মাধ্যমে দাদনের টাকা পরিশোধ করতেন ব্যবসায়ীরা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ পেশার সাথে জড়িয়ে নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়েছে উপজেলার সহস্রাধিক পরিবার। কুঁচিয়া আহরন ও বিক্রয়ের সাথে জড়িয়ে তারা এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার রাজিহার, বাশাইল, চেঙ্গুটিয়া, বাটরা, গৈলা, সাহেবেরহাট, মোল্লাপাড়া, পয়সারহাট, বড়মগড়া, কারফাসহ বিভিন্ন এলাকায় কুঁচিয়া সংগ্রহ হয় বেশি। সাধারণত জলাবদ্ধ এলাকা গুলোতে কুঁচিয়া বেশী পাওয়া যায় বলে কুঁচিয়া শিকারীরা জানান। অঞ্চল ভেদে কুঁচিয়া, কুঁচে, কুইচ্চা, বাইন নামেই পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম মনোপটেরাস। কুইচ্চা ৬০ থেকে ৭০ সেন্টি মিটার লম্বা হয়। অ-গভীর খাল-বিল, হাওর-বাওর, পুকুর ও মাটির নিচে আবাস এদের। কুঁচিয়া রাক্ষুসে স্বভাবের। খাদ্য হিসেবে প্রধানত ছোট মাছ তাদের প্রধান খাবার হলেও শামুকও অন্যতম খাবার। তাই কুঁচিয়া খেতেও বেশ সুস্বাদু হওয়ায় স্থানীয়ভাবেও কুঁচিয়ার বেশ চাহিদা রয়েছে। এটাকে মাছ হিসেবেই গ্রহন করছেন স্থানীয়রা। এমনকি ডাক্তাররা রক্ত শুন্যতার জন্য রোগীদের ব্যবস্থাপত্রের সাথে কুঁচিয়া খাবারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাই বিদেশেও রয়েছে কুঁচিয়ার ব্যাপক চাহিদা। বিদেশে কুঁচিয়ার ব্যাপক চাহিদা থাকায় বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে ব্যাপকভাবে। এভাবেই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে কুঁচিয়ার বাজারের ক্রমবিকাশ ঘটিয়ে কুঁচিয়া শিকারী, মজুদ ও ব্যবসার মাধ্যমে অন্তত চার শতাধিক পরিবার স্বচ্ছলতায় জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। করোনা ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ায় চীনের সাথে অন্যান্য ব্যবসা বানিজ্যর মতো কুঁচিয়া রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছে দাদন নেয়া কুঁচিয়া সংগ্রহকরী ও ব্যবসায়ীরা। বেকার হয়ে পড়েছে কুঁচিয়া ধরা শ্রমজীবী লোকজন। কিছুদিন আগেও রপ্তানিযোগ্য কুঁচিয়া সংগ্রহ ও রপ্তানির জন্য যে আড়ৎগুলো ছিল কর্মচঞ্চল আজ সেখানে শুধু শুন্যতা। জনশুন্য হয়ে পড়েছে কুঁচিয়ার আড়ৎগুলো। কাজ না থাকায় অলস শ্রমিকদের বেতনের জন্য ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে মাসিক বেতন। আগামী এক মাসের মধ্যে চীনে রপ্তানি কার্যক্রম পুনরায় শুরু না হলে ব্যবসায়ীদের মজুদ করা কুঁচিয়া সম্পূর্ণ মারা যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। রপ্তানি বন্ধ থাকায় কুঁচিয়া সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে কুঁচিয়া কিনতে চাচ্ছেন না আড়ৎদাররা। যে কারনে বেশিরভাগ গরীব জেলে এখন কুঁচিয়া ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন। আর্থিক অনটনের মধ্যে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে ওই সকল পরিবারের লোকজন। নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত কুঁচিয়ার মৌসুম থাকলেও জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারী দু’মাস কুঁচিয়ার প্রাপ্তীর ভরা মৌসুম। কিন্তু ভরা মৌসুমের শুরুতেই করোনা ভাইরাসের কারনে কুঁচিয়া ব্যবসায় পুরোপুরি ধ্বস নামায় মহা বিপাকে পড়েছেন কুঁচিয়া ধরা শ্রমিক, ব্যবসায়ি, আড়ৎদারসহ সংশ্লিষ্ট কাজের শ্রমিকরা। কুঁচিয়া সংগ্রহকারী কারফা গ্রামের সুমন দাস, হরষিত হালদার জানান, আগে আড়ৎদারদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে পুকুর, ডোবা-নালা, খাল-বিল থেকে কুঁচিয়া ধরে ৫শ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতাম। বর্তমানে রপ্তানী বন্ধ হওয়ায় কোন আড়ৎদার কুঁচিয়া কিনতে চাচ্ছে না। তাই তাদের সংসার চালানো এখন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।
উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা রোজিনা আক্তার বলেন, করোনা সংক্রমণের জন্য চীনে কুঁচিয়া আমদানী বন্ধ করে দিয়েছে। যে কারনে এলাকার কুঁচিয়া ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী রওশন ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, এই উপজেলার বহু মৎস চাষীরা কুঁচিয়া চাষ করার পাশপাশি মজা পুকুর, ডোবা-নালা, খাল থেকে কুঁচিয়া সংগ্রহ করে আড়তে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। যে কারণে এখানে কুঁচিয়া চাষের একটি পাইলট প্রকল্প চালু করেছিল সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর। সিডরের কারণে ওই মাস্টার প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। তারপরেও কুঁচিয়া সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ ও বিক্রির সাথে জড়িত থেকে অসংখ্য মানুষ কর্মজীবনের মাধ্যমে আর্থিক সচ্ছলতায় দিনযাপন করতেন। সম্প্রতি চীনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় কুঁচিয়া রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে কারও কিছু করার নেই। তারপরেও আমরা আশা করছি এটি একটি সাময়িক সমস্যা। আমরা ধারণা করছি অচিরেই এ সমস্যাটি দূর হয়ে যাবে। তবে মজুদকৃত কুঁচিয়া আমাদের দেশীয় বাজারে বিক্রি করলেও একটু হলেও লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পাবে কুঁচিয়া সংগ্রহকারী জেলে ও আড়ৎদাররা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ